তামান্নার মনের আবেগ যেন কুয়াশায় ঘূর্ণিপাকে মহা সাগরের ঢেউয়ে উতাল পাতাল, কি করবেন বুঝতে পারছেন না,বাবা জেলে মা নেই,নেই কোন ভাই বোন যাদের সাথে আড্ডা মেরে নিজের দুঃখ সুখ বলার সাথী বানিয়ে মনকে হালকা করবেন।ঘরে অনেক দিন যাবৎ বাহিরে তেমন একটা না বের হওয়াতে মন কেবল ছটফট করছিল তাই একটি রিক্সা নিয়ে বেড়িয়ে পড়েন মা নেই ,ধনীর একমাত্র দুলালী হওয়ার সুবাদে বাড়ীর বাহির কিংবা ভিতরে ঢুকবার কাউকে কৈফিয়ত দিতে হয় না এবং বাবার প্রচুর অর্থবিত্তের ব্যাবহারও তার সীমিত করেছেন, তাইতো প্রাইভেট কার থাকা সত্ত্বেও সে তা ব্যাবহার করেন না।রিক্সা থেকে নেমে কিছুটা পথ পায়ে হেটে চারুকলার দিকে যাচ্ছিলেন পথেই দেখা হয় সূর্য্যের এক বন্ধু সমরের সাথে।
-এই সমর....
হাতে কিছু কাগজপত্র নিয়ে আনমনে হাটছিলেন ডাক শুনে পিছনে তাকায়।
-আরে তামান্না যে,তা কি ব্যাপার কোথাও যাচ্ছো নাকি?
-না,উদ্দ্যেশ্য বিহীন ঘরে মন বসছিল না।
-ভালই হলো চলো হাটতে থাকি,চলো.. আদালত পাড়ায় ঘুড়ে আসি অবশ্য যদি তোমার সময় আর আপত্তি না থাকে।
-না না আপত্তি থাকবে কেনো তবে,ঐখানে ঐ আদালত পাড়ায় যেতে আমার নিষেধ।
-কে নিষেধ করল?
-আমার মন,ওখানে গেলে নিজেকে অপরাধী মনে হয়।
-হুম!বুঝেছি,সরি.. তা তোমার বাবার মামলার কি কোন খবর আছে?
-আমি ঠিক, সে দিন থেকেই খবর রাখিনি যখন সে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে গ্রেফতার হয়েছিলেন।
-দেখা করতে যাওনি?
-না,
-হাজার হলেও সে তোমার বাবা,তাকে অন্ততঃ তোমার দেখতে যাওয়া সন্তান হিসাবে কর্তব্য ছিল।এইতো সে দিন বুদ্ধিজীবি হত্যা সহ ১৬টি অভিযোগে অভিযুক্ত মতিউর রহমান নিজামীর মৃত্যু দন্ডের রায় হল, তার আত্ত্বীয় যারাই আছেন তারা আইনজীবি সহ সবাই এ রায়কে মিথ্যে বলছেন,তুমি কেনো তার ভিন্ন হবে।
-আমি জানি খবরে আমিও দেখেছি  কামরুজ্জামানের মৃত্যু দন্ডাদেশ বহাল রাখলেন বিজ্ঞ ট্রাইবুনাল এবং যার কোন রিভিউয়ের আর কোন সুযোগ নেই । ছেলে এর প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছেন, একজন নিরাপরাধ ব্যাক্তিকে শাস্তি দিল....অথচ আমরা সকলেই জানি তার কি অপরাধ।আমিতো তাদের মত হতে পারিনি পারিনি নিজের জন্মদাতাকেও মেনে নিতে কেনো যেন হয়ে উঠেনি, তা বলতে পারবনা, হয়তো তোমাদের সাথে মিশেছি বলে,জানো যখনই মনে আসে তখনি আমার কেনো জানি যুদ্ধপরাধীরদের বিরুদ্ধে ঘৃণাই আসে।
কথাগুলো বলতে বলতে তার চোখে জলের আর্বিভাব।কিছুক্ষণ দু'জনের মাঝে মৌনতা।
-সরি তামান্না, তুমি এ ভাবে কষ্ট পাবে বুঝতে পারিনি।তোমার মত যদি ওরা বুঝত তাহলে মুক্তিযুদ্ধের প্রজন্মের মাঝে এ বিবেদ থাকত না।যাক,তুমি এখন কোন দিকে যাবে?সূর্য্যের সাথে দেখা করবে?
-ইচ্ছেতো ছিল,কিন্তু কি ভাবে যোগাযোগ কবর,ওরতো মোবাইল নম্বরটিও আমার কাছে নেই।
-নাও... আমি দিচ্ছি.....

মোবাইল টিপে সমর তামান্নাকে নম্বরটি একটি কাগজে লিখেদিয়ে সে চলে গেল আদালতের দিকে আর তামান্না একলা চলার নীতিতে রাজপথ দখল করে হাটছেন আর মোবাইলে সূর্য্যকে বার বার যোগাযোগ করার চেষ্টা করেই যাচ্ছেন...হঠাৎ পিছন হতে একটি দেড় টনি মালবাহী ট্রাক তামান্নাকে ধাক্কা দিয়ে পাশে আরো একটি চলন্ত গাড়ীতে ধাক্কা খেয়ে পথটিকে রক্তাক্ত করে দ্রুত প্রস্হান নেয় ঘাতক।তামান্না ছিটকে পড়ে মাথায় আঘাত লাগে।কিছুক্ষনের মধ্যেই রোড ঘাটে গাড়িতে জ্যাম সৃষ্টি হয়।পুলিশ ঘটনা স্হলে এসে কিছুক্ষণ অবস্হান নিয়ে তামান্নার রক্তাক্ত মুষ্টি বদ্ধ হাতটি খুলে সমরের দেয়া সূর্য্যের মোবাইল নম্বরের কাগজের টুকরোটি খুলেন। নম্বরটি টিপতে থাকেন পুলিশ এরই মাঝে এম্বুলেন্স এসে দ্রুত তামান্নাকে তুলে হাসপাতালের নিয়ে যাবার চেষ্টা করেন কিন্তু জ্যামের কারনে এগুতে পারছেন না।
ভাবতে অবাক লাগে আমরা স্বাধীনতার তেতাল্লিশ চৌয়াল্লিশটি বছর পার করে দিলাম অথচ এখনও আমাদের রাস্তা ঘাটে আধুনিকতার ছোয়াঁ লাগেনি অথচ বিদেশে দেখেছি ভিন্ন রূপ এম্বুলেন্সের জন্য,ফায়ার সার্ভিসের গাড়ীর জন্য এক একটি করে মার্ক কৃত লাইন সব সময়ের জন্য খালি পড়ে থাকবে ঐ লাইনে নিদিষ্ট এ্যাম্বুলেন্স কিংবা ফায়ার সার্ভিসের গাড়ী ব্যাতিত অন্য কোন গাড়ী যেতে পারবে না কিংবা যাবেও না।
অবশেষে দূর্ঘটনাকৃত তামান্নার এ্যাম্বুলেন্সটি হাসপাতালে গিয়ে পৌছল ততক্ষণে অনেক দেরী হয়ে গেল।জরুরী অপারেশ শেষে অবস্হা খারাপ দেখে তামান্নাকে হাসপাতালের জরুরী বিভাগে রাখা হয়।এ দিকে পুলিশ অফিসার অনেক চেষ্টার পর সূর্য্যের মোবাইলের রিসিভ পান।
-হ্যালো....
-জি,কে বলছে?
-আমি পুলিশ অফিসার হায়দার আলী বলছি,আপনার কি হয় জানি না তবে একটি মেয়ে মানুষ রোড এ্যাকসিডেন্ট করেছেন এবং তিনি এখন হাসপাতালে...নম্বরটি তার হাতের মুষ্টি হতে সংগ্রহ করেছি।

আবারও হরতাল অবিলম্বে এই রায়গুলির কার্যকর করতে প্রজন্ম নগরের চাপের নমুনা হিসাবে নগরে মিছিল করছেন সূর্য্য সহ আরো অনেকেই, পুলিশ ফোন করার সময় সে মিছিলেই ছিল।সেই মিছিল হতে তার বন্ধুকে নিয়ে দ্রুত হাতপাতালের দিকে যাচ্ছেন।সূর্য্য মনে করেছিলেন তার মায়ের কোন দূর্ঘটনা হলো কি না, সে নিশ্চিত হন যখন মাকে সে ফোনে পেয়ে যায়।
-যাক,বাচা গেল। মা আমি কিছুই জানি না, কে এ্যাকসিডেন্ড করেছেন তার কাছে আমার মোবাইল নম্বর কি ভাবে গেল,আমি হাসপাতাল যাচ্ছি সেখানে গিয়ে তোমাকে ফোন করব।
পাগলের মত দৌড়াচ্ছেন হাসপাতালে সূর্য্য এবং তার বন্ধু।প্রথমে রিসিপসনে গিয়ে নিশ্চিত হন জানতে পারেন তাদের রোগী জরুরী বিভাগেই আছেন ডাক্তার পুলিশ সবাই রোগীর অভিবাবকের জন্য অপেক্ষা করছেন,সূর্য্য সামনে যেতেই পুলিশের জেরা।
-আপনার সাথেই কি আমি ফোনে কথা বলেছিলাম?
-হ্যা,ওটা আমার নম্বর।কিন্তু আমারতো আমার মা ছাড়া আর কোন মহিলা নেই,আমার মা তো আমাদের বাসায়।আমি বুঝতে পারছি না সে কে?
-ওহ্ আইসি,ঠিক আছে চলুন রোগীর কাছে তবে সে মহিলা নয় মেয়ে মানুষ।

জরুরী বিভাগে ঢুকে সূর্য্য,অভি থ'খেয়ে যান, নিথর নিশ্চুপ মায়া ভরা তামান্নার সুন্দর সুশ্রী মুখটির মাঝে মাঝে কুৎসিত কালো আঘাতের চিহ্ন দেখে।পা যেন আর চলে না সূর্য্যের এমন প্রিয় মানুষটি এত অল্প বয়সে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে যাবেন ভাবতে অবাক লাগে, বড্ড বেশী ভালবাসত সে তামান্নাকে তা তামান্নাকে কখনই বুঝতে দেয়নি, বাবা যুদ্ধাপরাধী না হলে হয়তো এতো দিনে তামান্না সূর্য্যের অর্ধাঙ্গীনি হয়ে যেতেন ,সূর্য্য মাথা ঘুড়িয়ে পড়ে যাবার মুহুর্তে বন্ধু অভি দু হাত দিয়ে ধরে ফেলাতে নিজেকে কন্ট্রোলে এনে ধীরে ধীরে তামান্নার কাছে যায়।
.....ডাকতে থাকেন,...তামান্না...তামান্না, এই... তামান্না চেয়ে দেখো আমি ফিরে এসেছি আর ফিরে যাবো না, তোমাকে এবার হাসপাতাল থেকে একে বারে আমার মায়ের কাছে নিয়ে যাবো,আর কোন বাধা নেই,আর কোন বাধাই আমি মানবো না...তুমি শুধু একটি বার নয়ন দুটি খোল.....।
তামান্নার যেন কোন হুস নেই, এত কথা বলে যাচ্ছেন সূর্য্য, কোন কথাই যেন তার কর্ণ ইন্দ্রিয়ে ভেদ করে না,তবুও সূর্য্যের যেন কথা থামে না মনের ভিতরে লুকানো অপ্রকাশিত গভীর রোমান্টিকতার গল্প যেন না বলাই রয়ে গেল।তবু সে শুনুক আর নাইবা শুনুক কাদো কাদো কন্ঠে সূর্য্য অনবরত বলে যাচ্ছেন তার সুখ দুঃখের না বলা কথাগুলো।
-তুমি শুনলে খুশি হবে, আজ সকালেই অঢেল অর্থ ঢেলেও রেহাই পায়নি , মীর কাসেমর  ফাসির রায় হয়েছে। এখন আমাদের দিন, মুক্তিযুদ্ধের এই নতুন প্রজন্মের দিন। আজ তেতাল্লিশটি বছর পর  আগুনে পানি ঢালার মতোই শান্তি পাবে নির্যাতীতদের হৃদয় ও শহীদদের আত্ত্বা।

তামান্নার যেন কিছুটা জ্ঞান ফিরে পেল কম্পিউটারের বক্র কারে চলন্ত দাগগুলোর যেন বলে দিচ্ছে আর কোন ভয় নেই সে সুস্হ হয়ে উঠছেন।সূর্য্য সিটে বসে নাক-মুখে অকসিজেন লাগানো তামান্নার মাথাটা তার বাম হাতের বাহুতে নেন।ডান হাত দিয়ে তার মুখবয়ে আলতো ভাবে ভালবাসার স্পর্শ ছুয়েঁ যেতেই তামান্না এবার চোখ খুলেন যেন তার পরশে শিহরণ জাগল হৃদয়ে।সূর্য্য বলতে থাকেন বহু দিনের জমে থাকা তার হৃদয়ের কথা।

-আমার আর কোন চাওয়া নেই যা ছিল তা পূরণ হতে চলছে....এখন,...এখন শুধু তোমাকে চাই,তোমার মুখের ভাষা চাই...তুমি আর একটি বার বলো আমি তোমায় ভালবাসি....আবার বলো সে দিনের মতো "যতই দূরে ঢেলে দেইনা কেনো তুমি রবে অন্তরে অনন্তকালের রাজাটি হয়ে...বলো,বলো তামান্না।
তামান্নার ভালবাসার সূর্য্য ডুবু ডুবু অনবরত এত কথা বলে যাচ্ছেন সূর্য্য তামান্না তখনও নিশ্চুপ হয়তো তার ডাক এসে গেছে বিধাতার দরবারে যাবার।হঠাৎ তার চোখঁ স্পষ্টতর ভাবে খোলে দু'নয়নের কার্ণিশ বেয়ে সূখের জল গড়িয়ে পড়ল সূর্য্যের বাহুতে আর সেই সাথে জীবন নামক রুহুর যেন বিদায়ের পালা...সূর্য্য বুঝতে পারছেন তাকে পর করে চলে যাবার তামান্নার বিদায়ী অনুভূতি...সূর্য্য যেন পাগলের মত এদিক সেদিক চেয়ে বার বার বলে যাচ্ছেন...না,তামান্না না তুমি আমাকে একাকিত্ত্বের জীবন দিয়ে চলে যেতে পারো না...তুমি চলে যেতে পারো না....পারো না।হঠাৎ চোখের পাতা খোলা স্হির নয়নের সমাপ্তির নীরবতা...সূর্য্যেকে ধরে রাখা তামান্নার বাম হাতটি নিষ্ক্রীয় হয়ে ঢলে পড়ে সিটে.........................................................।
চলবে....

প্রজন্মের ঋণ শোধ ১৫তম পর্ব(বিশেষ পর্ব)

ছবি:শুন্য শুন্যালয়

0 Shares

১৬টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ