জীবন চিতা-(পর্ব১খ)

আবু জাকারিয়া ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৫, বৃহস্পতিবার, ০৭:০৪:৩৯পূর্বাহ্ন সাহিত্য ১১ মন্তব্য

(১খ)

জামিলা বলল, তুমি বাড়ি আছো, হারামজাদারা তা টের পেয়ে গিয়েছে। এখন আর আসবেনা ইট পাথর ছুড়ে মারতে।
মুহাম্মাদ বলল, হারামজাদাদের ধরতে পারলে যা করতাম, একদম কান টেনে ছিড়ে ফেলতাম। মানুষরে ভয় দেখানোর মজা দেখাতাম।
হারিকেনের পাওয়ার কমিয়ে আবার শুয়ে পরল মোহাম্মদ।
মোহাম্মদ শহরে কাজ করতে যাবে, তাই খুব সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে পরল জামিলা। ডাল আর ভাত রান্না করল। মোহাম্মদ বলল, বাড়ি ফিরে আসতে এক সপ্তাহ লাগবে, এ কদিন একটু স্বাবধানে থাকবা। কেউ কিছু বললে কথা বলবা না।
জামিলা মাথা নাড়ে, ঠিক আছে।
মোহাম্মদ বলে, আর একটা কথা, সানি আর মনিরে এদিক ওদিক বেশি ঘোরাফেরা করতে দেবানা, কি ক্ষতি করে বিশ্বাস করা যায় না হারামিদের।
জামিলা আবার মাথা নেড়ে হা সূচক উত্তর দিল।
মোহাম্মদ বলল, আর যদি রাতে ঘরের চালে ইট পাটকেল মারে, কথা বলবা না। দেখবা, হারামজাদারা কত রাত পর্যন্ত যেগে থেকে ইট মারতে পারে, সারা রাততো আর মারতে পারবে না।
জামিলা এবারও একই ভাবে মাথা নেড়ে হা সূচক জবাব দিল।
মোহাম্মদ জামাকাপড় পরে শহরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হল, টানা একসপ্তাহ শহরে থাকবে কাজ করার উদ্দেশ্য। মোহাম্মদের কাজের নির্দিষ্ট কোন ধরন নেই। গরীব মানুষ তাই টাকা কামাই করার জন্য যেকোন কাজ করতে পারে। কিন্তু গ্রামে কোন কাজ পাওয়া যায় না, তাই শহরে যায় কাজ করতে। শহরে গিয়ে প্রায়ই কুলির কাজ করে, জোগাল খাটে। কখনও কখনও তাও জোটে না। তবে ইদানিং শহরে অনেক মানুষের সাথে পরিচয় হয়েছে মোহাম্মাদের। তারা মুহাম্মাদকে খুব বিশ্বাসও করে ফেলেছে। তাই কাজের লোক দরকার পরলেই মোহাম্মদকে ডেকে নিয়ে যায় কাজ করানোর উদ্দেশ্যে। তারাই তাকে কাজের বিনিময়ে খেতে দেয়, ঘুমাতে দেয়। কিন্তু মাইনে কম দেয়। তবুও ভাল, মাইনে কম হলেও সংসারটাতো চালাতে পারছে, এতেই খুশি মুহাম্মাদ।
মুহাম্মদ বলল, আচ্ছা, যাবার আগে জব্বারকে আরো একবার বুঝিয়ে দেখব নাকি?
জামিলা বলে, কি লাভ তাতে, ওরাতো তোমার কথা বিশ্বাসই করতে চায় না, ভেবেছে আমরা সারাজীবন এখানে পড়ে থাকার চেষ্টা করছি। ওরা ভেবেছে, বাড়ি আমরা ছাড়ব না।
মুহাম্মাদ বলল, তবুও একবার বুঝিয়ে দেখি, যদি কোন লাভ হয়।
জামিলা সায় দিল, দেখতে পার।
মোহাম্মদ জব্বারের বাড়ির দিকে রওনা দিল। মোহাম্মদ যে বাড়িটায় থাকে, তার বর্তমান মালিক জব্বার। জব্বারের বাড়িটা খুব বেশি দুরে না। হেটে যাওয়া যায়। মোহাম্মদ এসে দেখল, জব্বার বাড়ির বারান্দায় দাড়িয়ে আছে, গায়ে নতুন লম্বা পাঞ্জাবি, মাথায় উচু টুপি। হয়ত কোথাও যাওয়ার উদ্দেশ্যে আছে। তাই লম্বা লম্বা সাদা দাড়িগুলো ভাল করে চিরুনি দিয়ে আছড়ে নিচ্ছে। যদিও আধপাকা চুলগুলো এখনও এলেমেলো, চিরুনীর অপেক্ষায় আছে।
জব্বার মোহাম্মদকে দেখেও না দেখার ভান করল। মোহাম্মদ নিজেই জব্বারের কাছে এগিয়ে আসল। বলল, দেখুন ভাই, আমরা আপনার বাড়িতে আর বেশি দিন থাকতে চাইনা, একটা ব্যাবস্থা করতে পারলেই চলে যাব। এই কদিন আমাদের বিরক্ত করবেন না। জব্বার কোন কথা বলল না, এমন ভাব নিল যেন কিছুই শুনছে না।
মুহাম্মদ বলল, ভাই আপনার কোন ভয় নেই, আমরা আপনার কেনা বাড়ি দখল করব না, আপনি দয়া করে আর বিরক্ত করবেন না।
জব্বার এবার কথা বলে উঠল, কিছুটা রাগের সুরে বলল, কে আপনাদের বিরক্ত করে?
মুহাম্মদ স্বাভাবিকভাবেই উত্তর দিল, আপনি।
জব্বার আরো বিরক্ত হয়ে বলল, কিভাবে বিরক্ত করি আমি?
মুহাম্মাদ বলল, রাতের বেলা ঘরের চালে ইট মারেন,আমার স্ত্রি ছেলেমেয়েরা ভয়ে ঘুমাতে পারেনা।
জব্বার বলল, আপনি আমাকে দেখেছেন ইট মারতে? জব্বার যেন কিছুতে মেনে নিতে পারছে না তার উপর এমন অপবাদ। হুজুর মানুষ, মাদ্রার শিক্ষক, এলাকায় ভাল ক্ষ্যাতি আছে তার, শিক্ষক হিসেবে সন্মান আছে তার। অথচ মোহাম্মদ তাকে সম্মানহানি করছে, বলছে, সে নাকি রাতের বেলা তাদের ঘরের চালে ইট মেরে ভয় দেখায়।
কিন্তু মুহাম্মদ শতভাগ নিশ্চিত, এই কাজটা জব্বার নিজে না করলেও অন্য কাঊকে দিয়ে করাচ্ছে। কারন, জব্বার বাড়িটা মুহাম্মদের ভাইয়ের কাছ থেকে কিনেছে এক বছর হয়ে গেছে, অথচ মুহাম্মদের যাওয়ার নাম নেই। বরং যাব যাব করছে অনেকদিন ধরে। কিন্তু যাচ্ছে না। সেই রাগেই জব্বার মুহাম্মদকে ভয় দেখায়, রাতে ঘরে ঢিল ছুড়ে মারে।
মুহাম্মাদ বলল, আপনি মারেন তা বলচি না, আপনার লোকেরা আপনার কথা মত মারে। আপনি ওদের নিষেধ করে দিয়েন।
নরম গলায় বলল মোহাম্মদ।
জব্বার বলল, দেখ ভাই, সমাজে আমার একটা সম্মান আছে, এসব বলে আমাকে মানহানি করার চেষ্টা করবেন না। তাছাড়া আপনি তারাতারি আমার বাড়ি ছেড়ে চলে যান, ১ বছর হয়ে গেছে বাড়িটা কিনেছি আমি। কিন্তু আপনি এখনও আমার বাড়িটা ছেড়ে যাচ্ছে ননা।
মোহাম্মদ শান'ত গলায় বলল, দেখুন ভাই, আমি যত তারাতারি পারি আপনার বাড়ি ছেড়ে দেব, এখানে বেশিদিন থাকব না।
জব্বার বলল, আপনিতো সেই কবে থেকেই বলছেন বাড়ি ছেড়ে দেব, আজ না কাল, কাল না পরশু। এরকম আর কতদিন করবেন?
মোহাম্মদ কোন কথা বলল না, যেন কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। নিজেকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছে পরের বাড়ি দখল করে থাকতে। এই কাজটাকে একটা বড় ধরনের অন্যায় বলেও মনে হল মোহাম্মদের কাছে।
জব্বার আর কিছু না বলেই বাড়ি থেকে বের হয়ে হন হন করে হাটতে শুরু করল। সম্ভবত মাদ্রাসায় যাবে ক্লাস নিতে। বিকেল ৩ টা ৪ টা পর্যন্ত ক্লাস করাবে মাদ্রাসার ছাত্রদের। মোহাম্মদের বড় ছেলে সানি জব্বার যে মাদ্রাসায় চাকরী করে সেই মাদ্রাসারই ছাত্র। তবে জব্বার সানিদের কোন ক্লাস করায় না, করায় বড় ছাত্রদের ক্লাস। এটাকে মোহাম্মদ সৌভাগ্য হিসেবেই মনে করে। জব্বার যদি সানিদের ক্লাস করাতো, তাহলে হয়ত বিনা দোষেও ছেলেটাকে পেটাতো।
মোহাম্মদ বাড়ি ফেরত আসল। বেলা অনেক হয়েছে। পূর্বের আকাশের সূর্যটা তেতে উঠেছে মারাত্মকভাবে। মোহাম্মাদের এখনই রওয়ানা দিতে হবে শহরের উদ্দেশ্য। আজকে হয়ত কোন কাজ নাও পাওয়া যেতে পারে, তবে আগামীকাল যে কাজ পাবে সেব্যাপারে নিশ্চিত মুহাম্মাদ।
মোহাম্মদের স্ত্রী জামিলা মোহাম্মদকে বলল, কি, জব্বারকে বুঝিয়ে বলেছ?
-হ্যা। বলেছিতো।
-কি বলেছে জব্বার?
-কিছুই বলেনি জব্বার।
-তাহলে? জামিলার চোখে মুখে আতংক আর বিস্ময় দুটো এক সাথে খেলা করে গেল মুহুর্তে।
মোহাম্মদ বলল, আজকে থেকে হয়ত আর ভয় দেখাতে আসবে না। আমি জব্বারকে বুঝিয়ে বলেছি যে আপনার বাড়িটা আমরা তারাতারি ছেড়ে দেব। হয়ত আমার কথা বিশ্বাস ও করেছে সে।
জামিলা বলল, ভয় না দেখালেই ভাল, জানো কতদিন ধরে রাতে ঘুমাতে পারিন? আর তুমি না বাড়ি না থাকলেই ওরা সুযোগে পায়, ভয় দেখায়।
মুহাম্মাদ বলল, যাই হোক, তুমিও এইকদিন একটু সাবধানে থাকবে।
জামিলা মাথা নাড়ল, আচ্ছা।

মুহাম্মাদ স্ত্রী ও দুটি ছেলে সানি আর মনিকে বিদায় জানিয়ে শহরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে গেল, কাজ করার জন্য। জাবার সময় সানিকে বার বার বলে গেল, বাবা ঠিক মত মাদ্রাসায় যাস, কামাই করিশনা। তোদের ভালোর জন্যইতো এত কষ্ট করে কাজ করে পয়সা কামাই করি।
সানি শুধু মাথা নেড়ে, হ্যা হ্যা জবাব দিয়েছে।
সানি মাদ্রাসায় ক্লাস ফোরে পড়ে আর ওর ছোট ভাইটার এখনও মাদ্রাসায় ভর্তি হবার বয়স হয়নি। তবে বাংলা বর্নমালা দেখে পড়তে শিখেছে এত দিনে। আগামী বছর ক্লাস ওয়ানে ভর্তি করার ইচ্ছা আছে জামিলার।

রাত অনেক হয়েছে। জামিলা তার দুই ছেলেকে নিয়ে ঘুমিয়ে পরেছে। হঠাৎ ঘরের চালার উপর ধুপ ধাপ শব্দে ঘুম ভেংগে গেল জামিলার। উঠে বসল জামিলা। হারামিরা আবার ভয় দেখাতে এসেছে। জব্বারের বাচ্চা মানুষ না, ওর কলিজায় মায়া দয়া আছে বলে মনে হচ্ছে না।
আবার একটা ইট এসে পরল ঘরের চালে। জামিলার ইচ্ছা হচ্ছিল কশে গালাগালি করতে। কিন্তু ভাবল, এই মুহুর্তে গালাগালি করা ঠিক হবেনা, তাহলে আরো ক্ষেপে যাবে ওরা। জামিলা চুপ করে বসে রইল বিছানার উপর। ছেলেদুইটা ঘুমাচ্ছে। ওদের ঘুম গাড়। ছোট খাট শব্দে সহজে ঘুম ভাংগেনা ওদের। পরাপর আরো কয়েকটা ইটের টুকরো এসে পরল ঘরের চালে। কয়েকটা পরল রান্নাঘরের চালে আরো কয়েকটা বারান্দায়।
জামিলা মনে মনে ভাবল, দেখি হারামজাদারা কতক্ষন ঘুম নষ্ট করে ঢিল ছুড়তে পারে। ঘুমতো আমার একার নষ্ট হচ্ছেনা, বরং ওদেরও নষ্ট হচ্ছে। অনেক্ষন চলল ঢিল ছোড়াছুড়ির কান্ড। তারপর এক পর্যায় বন্ধ হয়ে গেল। জামিলা বুঝতে পারল, হারামজাদারা চলে গেছে, জব্বারের চামচাগুলো। এখন ওর চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা করছে, ও হারামজাদার দল, জব্বারের চামচা চলে গেলি কেন, আয় আরো ঢিল মার। সারা রাত ধরে ঢিল মার আমার ঘরের চালের উপর। দেখি কতক্ষন মারতে পারিশ। কত রাত জেগে থাকতে পারিশ, একটু দেখতাম।
কিন্তু কিছুই বলল না জামিলা। ওরা চলে গেছে, এটাই অনেক কিছু। তা না হলে ছেলে দুটোর ঘুম ভেংগে যেতে পারে।

(চলবে)

0 Shares

১১টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ