ছুঁয়ে দেয়া

নাসির সারওয়ার ১ ডিসেম্বর ২০১৫, মঙ্গলবার, ০১:৪১:৩০অপরাহ্ন একান্ত অনুভূতি ৪০ মন্তব্য

আত্মীয় হাসপাতালে তার ২ সপ্তাহের শিশু নিয়ে। তেমন কিছু না, হেপাটাইটিস। ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টার ফটো থেরাপিতে সাধারণত ভালো হয়ে যায়। বলাটা খুব সহজ হলেও গিয়ে যা দেখলাম, তাতে মনটাই খারাপ হয়ে গেলো। আত্মীয়টা এন আই সি উ এর অপেক্ষা রুমের এক কোনায় বসে মেঝের দিকে তাকিয়ে আছে। আমার উপস্থিতিতেও নড়াচড়া নাই। কেমন জেনো একটু অস্বস্তি ভর করে বসলো, কঠিন কিছু নাতো? শিশু ডাক্তারটা আমার বন্ধু। অপেক্ষার বাঁধ ভেঙ্গে ওকেই কল করলাম। আমার ধারনার মধ্যেই আছে এবং একদিনেই ভালো হবার কথা। চেষ্টা করলাম পরিবেশটা হালকা করার। “কত নম্বর বেডে আছে”? যাক, বাঁধতো ভাঙল। কিন্তু হায়, “আমিও যাবো”। চোখ দুটো শুধু ছলছলে নয়, আরো যেন কি বলছে। কিছু খুঁজছে কি? বৃথা চেষ্টা করছি পড়ার। এই সময়গুলো আমার জন্য বেশ পীড়াদায়ক। কি বলতে হয়, কি করতে হয় বুঝি না। সত্যি যদি ভ্যানিসিং ক্রিম থাকতো, এটা হতো উত্তম সময় তা ব্যবহারের। “আমাকে ওরা ...কে ছুঁয়ে দিতে দেয়নি”। এটাইতো এই চিকিৎসার একটা অংশ। উদাম শরীরে একটানা ফটো থেরাপি। নির্দিষ্ট সময়ে নার্সরাই ফিড দেবে। কোন ভাবেই ব্যাহত করা যাবেনা চিকিৎসা।  “আমি শুধু একবার ছুঁয়েই চলে আসবো”। কী আছে সেই ছোঁয়ায়? আমার মা ও কি তাই ছেয়েছিলেন?

সময়ের প্রয়োজনেই হয়তো এঘাট ওঘাট করে একসময়ের স্বপ্ন দেশে খুঁটি গেড়েছিলাম সেই তারুণ্য নিয়ে। অদম্য চেষ্টায় পড়ালেখায় শান দেয়া, মায়ের খোঁজ খবর, সংসার এবং অফিসের কাজ কাম, সামাজিক যোগাযোগ, সবইতো চলছিলো ওদেরই মতো। মাঝে মাঝেই মা বলতেন অনেক দিন তোকে দেখিনি। বলা হয়নি কোনদিন, আমি যে উচ্চ প্রত্যাশায় অন্ধ হয়ে গেছি মা। একসময় হতাশা এসে ঝাপটে ধরলো টুটি। তাইতো, দেখতে দেখতে দেড় যুগ হয়ে গেলো মাকে ছুঁয়ে দেইনি। এ হতাশার তো সোজা সমীকরণ।

একরাশ অস্থিরতায় হঠাৎ করে দেশে কাজ করবার একটা প্রস্তাব পেয়ে গেলাম। যাক, কিছুদিনতো মায়ের সাথে কাটাতে পারবো। তেমন কোন চিন্তা ভাবনা না করেই রাজী হয়ে ঘোঁজঘাঁজ রব শুরু করলাম যা একটু কঠিন ব্যাপারই। অনেক দিনের সংসারতো। হাতের জমানো কাজগুলো শেষ করা, ধূমধাম কেনা কাটা, কত কী। কতো জনের কতো চাহিদা। একজনতো আস্ত স্ট্যাচু অব লিবার্টিটা খুঁড়ে নিয়ে আসতে বলল। আর মা, আমার হাত ধরে বসে থাকবি কিছুক্ষণ।

আমার সাথে আরো একটা বন্ধু যাবে আর এই দুইজনের উপরেই আমাদের প্রকল্পটার ভীত। সে আবার বড়োসড়ো একজন ক্যানসার গবেষক। ঝামেলা বাঁধল ও যখন নিজের গবেষণার বিষয় নিজেই বনে হাসপাতালে শুয়ে পরলো। প্রকল্প ভবিষ্যৎ মোটামুটি চরক গাছে উঠার মত। তারপরও আমরা আশা নিয়েই বেঁচে থাকি, ভালো হয়ে যাবে একসময়। সময় চলছে সময়ের তালে। এইতো আর মাস খানেক বাকী মার কাছে যাবার।

ট্রেনে চেপে যাচ্ছি পাশের শহরে একটা ফাইনাল প্রডাক্ট ডেলিভারি দিতে। ফাইনাল টাচটা ট্রেনে বসেই করে নিচ্ছি যা ড্রাইভ করলে করা হতোনা। মনে হচ্ছে সবাই ট্রেনের এই সুবিধাটা ভালো ভাবেই ব্যাবহার করছে। আশেপাশের সবাই নিজের মাঝেই ব্যাস্ত ল্যাপটপ, খবরের কাগজ, মুঠোফোন কিছুনা কিছু নিয়ে। দাদার (বড় ভাই) কল আসলো দেশ থেকে যা সবসময়ই আনন্দের। আস্তে করে আমার অবস্থান জানালাম। আমি আবার আমার ফিরিস্তি দিয়ে কাউকে বিরক্ত করতে চাইনি। “আচ্ছা, বাসায় গিয়েই কল দিস”। অপেক্ষা আমার বন্ধু হতে পারেনি আজও। আমারতো রাত হবে ফিরতে। “মা ক্যামন আছে?” ওপাড়টা ক্যামন জেনো থমথমে হয়ে গেলো। কাল রাতেই তো কথা হলো মার সাথে যে এখন ২৮ দিন গুনছে। “দাদা, মা ক্যামন আছে?” কিছু অস্পষ্ট কথা মাথাটা ভারী করে দিলো। খুট করে একটা শব্দ। না, লাইনটাতো এখনো আছে। আমি ভুল শুনছি, অবশ্যই ভুল। এমনতো কথা ছিলোনা। আশেপাশের মানুষগুলোকে বলতে ইচ্ছে হচ্ছে, কেউ আমার পিঠে একটু হাত বুলিয়ে দাও। সেই স্পর্শে যেন মায়ারা আসে জলকন্যার বেশে।

পুনশ্চঃ আত্মীয় মা কে তার শিশুর ছুঁয়ে দেয়া দেখেছি। তখন তার চোখের কথা আমার পড়া হয়নি, পারিনি পড়তে। দেখা হোলোনা আমার মায়ের সেই না পড়া চোখ দুটি। আমিযে তাকে ছুঁয়ে দিতে দেখিনি।

0 Shares

৪০টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ