তখন আমি নতুন নতুন প্রেম করি । আমি সদ্য যুবক আর সে কিশোরী । অল্প কিছু টাকা যোগাড় হলেই ছুটতাম খুলনায় । উদ্দেশ্য কিছু সময় তার সাথে কাটানো । কাটানোর মত সময় দুজনের হাতেই ছিল । কিন্তু সময় কাটাবো বললেই তো আর হল না । এর জন্য আয়োজন চাই । সময়ের পরিমাপ ও একটি নির্জন নিরাপদ জায়গা । কিন্তু বাংলাদেশে একটু একান্তে সময় কাটানোর জায়গা কোথায় ??
যেখানেই যাই সেখানেই অতৃপ্ত পুরুষের ছুক ছুক চোখ পিছু নেয় । তবে প্রেম আর মুক্ত চিন্তা এমন দুইটি বিষয় যা বুলেট বোমা বা সংবিধান দিয়ে আটকে রাখা যায় না । তাই আমরা রাস্তা দিয়ে হাটতাম,হুড তোলা রিকশায় স্বপ্নময় কাব্য রচনা করতাম । “লিটনের ফ্ল্যাটে” যাওয়ার বাসনা তখন আমাদের ছিল না । যেদিন আমার পকেট টা ভারি থাকত সেদিন কোন চাইনিজে বসতাম । আর শুধু ভাড়ার টাকা সম্বল করে যেবার খুলনা যেতাম সেবার আবাসিক এলাকায় হাটাহাটি করেই আমরা সময় পার করতাম । কারণ কিশোরীটিকে স্কুলে যাওয়া আসার রিকশা ভাড়ার বাইরে কোন টাকা তখন বাসা থেকে দেওয়া হত না ।
এরকমই একদিন আমি উদ্ভ্রান্তের মত খুলনা পৌঁছলাম । দেখা করতেই হবে । আর সে তার জীবনের সবচেয়ে দুঃসাহসিক কাজ স্কুল পালিয়ে বের হয়ে আসল আমার সাথে । সময় টা সম্ভবত মে-জুন মাস । প্রচন্ড গরম,একটুও বাতাস নেই । কিন্তু হুট করে ঝুম ঝুম বৃষ্টি ও ঝড়ো হাওয়া শুরু হয়ে গেলো । কিশোরীটিকে নিয়ে এই ঝড় বৃষ্টি তে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবো ? আমি দিশেহারা হয়ে গেলাম । না পারছি কোন দোকানের মধ্যে ঢুকতে,না পারছি সাহস করে কোন বাড়িতে আশ্রয় নিতে । কিন্তু মাথার উপর একটু ছাদ তো যোগাড় করতেই হবে । শেষে কাছাকাছি একটি টিনের ঘরের কার্নিশের নিচে গিয়ে দাড়ালাম ।
কিছুক্ষণ পর টিনের ঘরের জানালা খুলে এক মধ্য বয়স্কা মহিলা আমাকে ডেকে বললেন, “এভাবে না ভিজে তোমরা ভিতরে এসে বস” । উপায় না থাকায় আমি আর সে ভিতরে গিয়ে বসলাম ।এখনও স্পষ্ট মনে আছে সব কিছু । একটি পরিচ্ছন্ন ছোট বসার ঘর,বেতের সোফা আর দেয়ালে টাঙানো অসংখ্য সাদা কালো ছবি । ছবি গুলো এই মহিলার বিভিন্ন বয়সের । পাশে একটা বুক শেলফ আর তার পাশে একটা বড় আয়না । সব মিলিয়ে স্পষ্ট যে এখানে ভদ্র লোকেরা বসবাস করে । কিন্তু ভিরু প্রেমিক মন প্রেমিকার নিরাপত্তার কথা ভেবে একটুও স্বস্তি পাচ্ছিল না । আমি জানলা দিয়ে বার বার দেখার চেষ্টা করছিলাম বৃষ্টি থেমেছে কিনা । মহিলাটি আমাকে একটি গামছা দিল মাথা মোছার জন্য । আর তাঁর দিকে তাকিয়ে বলল “ভেজা মোজা খুলে ফেলো” । কিশোরীটির কোন বিকার নেই , আমার সাথে আছে তাই সে পুরোপুরি নিশ্চিন্ত । কিন্তু মহিলাটি ধরে ফেলেছিল আমি ভয় পাচ্ছি । উনি আমার দিকে তাকিয়ে মিস্টি হেসে বললেন, “চিন্তা কর না,বৃষ্টি থেমে যাবে । আর আমি এখানে একাই থাকি,তোমাদের কোন ভয় নেই” ।কেন জানিনা আমার ভয় শুধু এই কথায় একটু একটু কমে যাচ্ছিল ।
ছোট বেলা থেকেই শিখেছি প্রেম মানেই অপরাধ , তারপর আবার মায়ের বয়সি এক নারীর সামনে প্রেমিকা সহ বসে থাকার কারণে আমার আড়ষ্টতা কাটাছিল না । এরপর উনি আমার নাম,কিসে পড়ি,বাসা কোথায় ,কিভাবে আসলাম ইত্যাদি জিজ্ঞাস করেছিলেন । অবাক করা বিষয় তিনি কিশোরীটিকে একটা কথাও জিজ্ঞাস করেন নি । এরপর তিনি বললেন, “তোমরা বৃষ্টি না থামা পর্যন্ত গল্প কর,আমি রান্না চাপিয়ে আসি” । বলেই চলে গেলেন এবং বৃষ্টি না থামা পর্যন্ত ওনার ছায়াও আমরা দেখলাম না ।
বৃষ্টি যখন ধরে এসেছে তখন মহিলাটি গলা খাকারি দিয়ে রুমে ঢুকলেন । হাতে সেমাই এর বাটি নিয়ে । আমাদের বললেন “দুজনে এক বাটি থেকে খাও,এতে ভালোবাসা বাড়ে” । শুনে আমি আর সে লজ্জায় মাটিতে মিশে গিয়েছিলাম । কিন্তু উনি আমাদের বাধ্য করেছিলেন এক বাটি থেকে খাওয়ার জন্য । যখন বের হব তখন উনি আমাকে বললেন “এরপর তোমরা যেদিন ঘুরতে বের হবে সেদিন আমার বাসায় এসো । আমি সারাদিন একাই থাকি । এখানে তোমাদের কোন সমস্যা হবে না” শুনে আমি একটু হাসলাম । জবাবে কি বলব বুঝে উঠতে পারি নি । একটু থেমে উনি আবার বললেন “পৃথিবীটা প্রেমের জন্য একটুও নিরাপদ নয় । তুমি বাইরের ছেলে যদি হঠাৎ কিছু হয়ে যায় কাউকে ডাকতেও পারবে না। তাই এখানে আসতে লজ্জা কর না” । আমি এবারেও কি বলব বুঝতে না পেরে মুখ বিকৃত করে আবার একটু হাসলাম । বিদায় নেয়ার সময় ধন্যবাদ টা পর্যন্ত ওনাকে দিয়ে আসি নি । এরপর আমি শত শত বার খুলনা গিয়েছি । মেয়েটি কিশোরী থেকে যুবতী হয়েছে , আমিও সদ্য যুবক থেকে পরিপূর্ণ যুবক হয়েছি । কিন্তু ঐ মহিলার বাড়িতে আর কোনদিন আমাদের যাওয়া হয় নি ।
প্রেম বিরোধী জনতার মধ্যে উনি কেন আমাদের প্রশয় দিয়েছিলেন আমি এখনও ভেবে পাই না । হয়ত ওনার অসৎ উদ্দেশ্য ছিল । হয়ত ২য় বার গেলে আমরা কোন বিপদে পড়তাম । তারপরও আমার ভাবতে ভালো লাগে এখনও এমন মানুষ আছে যারা নারী-পুরুষের প্রেম কে পবিত্রতার চোখে দেখে । এরপর কত ঘটনা ঘটে গিয়েছে । কত টানা-পড়েন , কত আবেগ ভালোবাসায় ভেসেছি আমি । কত কিছু বদলে গেছে কিন্তু সেদিন কার এই স্মৃতিটা এখনও আমার মনে সজীব হয়ে আছে ।
২৮টি মন্তব্য
ছাইরাছ হেলাল
কিছু স্মৃতি আমাদের বুক পকেটেই থাকে, রাখিও,
বায়রনিক শুভ্র
থাকুক,থেকে যাক।
ইলিয়াস মাসুদ
কিছু কিছু স্মৃতি স্মৃতিতেই ভাল থাকে 🙂
বায়রনিক শুভ্র
হ্যা, আসলেই।
রিমি রুম্মান
স্কুল পালানো কিশোর কিশোরীকে প্রশ্রয় দেয়া ঠিক হয়নি কিন্তু উনার…
বায়রনিক শুভ্র
আমি মোটেও কিশোর ছিলাম না। অবশ্য আমি নিজেও এখন পশ্রয় দিতাম না। 🙂
নীলাঞ্জনা নীলা
রিমি আপুর সাথে আমিও একমত। ওই মহিলার জায়গায় আমি হলে কিছুতেই অমন করে বলতাম না।
নীলাঞ্জনা নীলা
আপনার ‘ফেরা’ পোষ্টটি কোথায়? ওটা আবার নিয়ে আসুন, তা নইলে আমার অদেখা মন্তব্য যাবেনা।
বায়রনিক শুভ্র
আপনারা এত নিষ্ঠুর কেনে?
ফেরা পোস্ট টা আমার অনুমতি নিয়েই জিশান ভাই হাইড করেছেন।
নীলাঞ্জনা নীলা
ওহ! অদেখা মন্তব্য থেকে যাচ্ছেনা আপনার ওই পোষ্টের মন্তব্য।
বায়রনিক শুভ্র
জিশান ভাই এর সাথে যোগাযোগ করেন।
নীলাঞ্জনা নীলা
মুক্তি পেয়েছি। 😀
মোঃ মজিবর রহমান
জিবনে স্কুল না পালালে মজা নায়, হোক প্রেম,আর অন্য আনন্দ বা দুস্টামি।
সৃতি সৃতি বহমান জিবনে
বায়রনিক শুভ্র
স্কুল পালিয়ে আমি অবশ্য প্রেম করার সুযোগ পাই নি। তবে স্কুল পালানো প্রেমিকা আমার ছিল।
মোঃ মজিবর রহমান
হুম!
মনির হোসেন মমি(মা মাটি দেশ)
প্রেম হউক খোলা আকাশেরঁ মতো সর্বত্র নির্ভয়ে -{@
বায়রনিক শুভ্র
হয় না রে ভাই।
শুন্য শুন্যালয়
অজানা অচেনা দুটো ছেলেমেয়েকে বৃষ্টিতে আশ্রয় দিয়েছে এটা ভালোই লেগেছে।
আমরা কৈশরের ভালোবাসাকে একটু বাঁকা চোখে দেখে অভ্যস্ত আসলে। আমার বাবা মা দেখেছেন, হয়তো আমিও দেখবো। পজিটিভলি দেখলে সমস্যা হয়তো কমই হতো।
স্মৃতিতে থাকুক। আমার ধারণা সেই প্রথম তোমরা এভাবে একা হয়েছিল 🙂
বায়রনিক শুভ্র
হ্যা। ওই সময়ে আমরা নির্জনতা পেলে উল্ট ফাকা হয়ে বসতাম।
অপার্থিব
বাহ ! দারুণ। আসলেই মনে রাখার মত ঘটনা। ভাবতেই ভালই লাগে যে ভদ্র মহিলা সময়ের চেয়ে অনেক এগিয়ে!
বায়রনিক শুভ্র
কেউ কেউ মানুষ। 🙂
ইঞ্জা
কিছু স্মৃতি মনের কোঠাই রয়ে যায় আর প্রেমিক মন প্রেমিকাকে রক্ষার্থে ভীরুই হয়।
বায়রনিক শুভ্র
হুম
ইঞ্জা
লিখে যান পাশে আছি।
মুহাম্মদ আরিফ হোসেইন
কি সাংঘাতিক প্রেম রে বাপু!!
বায়রনিক শুভ্র
হা হা হা
জিসান শা ইকরাম
কিশোর প্রেম, স্মৃতিতে উজ্জ্বল সব সময়।
ভাল লেখা।
বায়রনিক শুভ্র
ধন্যবাদ ভাই ।