পহেলা বৈশাখ শব্দটির সাথে এখন “পান্তা ইলিশ ও মঙ্গল শোভাযাত্রা” শব্দ দুইটি ওতপ্রত ভাবে জড়িত । মঙ্গল শোভাযাত্রা মূলত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের অনুষ্ঠান হলেও এটি এখন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে । সেই সাথে ছাগু,সু-শীল,মুক্তমনা নির্বিশেষে কিছু মানুষের এগুলো নিয়ে আশেষ চুলকানিও আছে । বামপন্থীদের মতে বছরের শুরুর দিনটিতে পান্তা খেয়ে গরীব মানুষদের হেয় ও উপহাস করা হয় । আর ছাগু সম্প্রদায়ের মতে মঙ্গল শোভা যাত্রার নামে বিজাতীয় সংস্কৃতি পালন করা হয় । এই দুই পক্ষেরই অভিমত “পান্তা ইলিশ ও মঙ্গল শোভাযাত্রা” বাঙালী সংস্কৃতির সাথে জড়িত নয় । আসলেই কি তাই ? আসুন খুজে দেখি এর সাথে আমাদের স্থানীয় সংস্কৃতির কোন যোগ সুত্র আছে কি না ।

আশ্বিনে রাঁধে বাড়ে কার্তিকে খায়
যে বর চায় বুড়ি সেই বর পায় ।।

এটি একটি খনার বচন । এই বচনে খনা আশ্বিনে রান্না করা খাবার কার্তিক মাসে খেতে বলেছে । কিন্তু ফ্রিজ বা প্রযুক্তিগত সুবিধা ছাড়া এতদিন পর্যন্ত রান্না খাবার টিকিয়ে রাখা প্রায় অসম্ভব । পান্তই একমাত্র রান্না করা খাবার যা প্রযুক্তিগত সুবিধা ছাড়া টিকিয়ে রাখা যায় । তাই বলে একমাস পান্তা ভাত রেখে দিলে তা বাঙলা মদ হয়ে যেতে পারে । তাহলে কি করা ? আমি ছোটবেলায় আমার মামাবাড়িতে দেখেছি আশ্বিন মাসের শেষ দিনের রান্না করা ভাত পান্তা করে রেখে দেওয়া হত আর কার্তিক মাসের প্রথম সকালে সেই পান্তা খাওয়া হত । মূলত এভাবেই এই খনার বচনটি পালন করা হত । তবে এই কালচারটি এখন পালিত হয় কিনা আমি জানি না ।

স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন জাগে “এরকম একটি ফতোয়া খনা মাসি কেন দিলেন” । খনার প্রতিটা বচনেরই একটি গুড় রহস্য আছে এবং প্রতিটা বচনই মানব জাতির কল্যানের উদ্দেশ্যে সৃষ্টি । এই বচনটির মূল কথা হল “সঞ্চয়ী হওয়া” । একদিনের অতিরিক্ত রান্না করা খাবার ফেলে না দিয়ে তা জমিয়ে রেখে পরের দিনে খাওয়া অবশ্যই সঞ্চয়ী মনোভাবের প্রকাশ । আর এই কারণেই খনা এই বচনটি দিয়েছেন । এর সাথে ধর্মের যেমন কোন সম্পর্ক নেই , একই ভাবে গরীব মানুষদের উপহাস করারও কোন সম্পর্ক নেই ।আর এই কালচার টি ১০০ ভাগ বাঙালী কালচার ।

বৈশাখের সকালে যে পান্তা ভাত খাওয়া হয় তাও এই একই কারণে । মানুষকে সঞ্চয়ী করার জন্যই এই ধারাটি বৈশাখে চালু হয়েছে । কিন্তু হুজুকে বাঙালী হুজুকের কারণে অনেক কিছু পালন করলেও পিছনের ইতিহাস খুব একটা ঘাটতে যায় না । তাই “পান্তা খাইতাছ ক্যালা”? জিগাইলে মুখ বন্ধ করে রাখা ছাড়া উপায় থাকে না । ফলে ছাগু,বাম-পন্থী,সু-শীল এটা নিয়ে ত্যানা প্যাচানোর বিশাল একটা সুযোগ পেয়ে যায় । কিন্তু ইলিশ মাছ কেন খাওয়া হয় তা আমার জানা নেই । বই , ইন্টারনেট ঘেটে আমি এই বিষয়ে তেমন কোন তথ্য পাই নি । কারো কিছু জানা থাকলে জানাবেন । উপকৃত হব ।

মঙ্গল শোভা যাত্রা নিয়ে মূল চুলকানি আমাদের ছাগু সম্প্রদায়ের । মুখোশ,হাঁস,বাঘ,সিংহ,কুমির,শয়তান কেন বানানো হয় এবং এর সাথে মঙ্গলের কি সম্পর্ক আছে এটা নিয়ে গবেষণা করতে করতে তাদের পায়ের ঘাম মাথায় উঠে আসে । আর “যেহেতু চারুকলা অনুষদ ১৯৮৯ সাল থেকে এটি চালু করেছে, সেহেতু এটি বাঙালীর হাজার বছরের সংস্কৃতি নয়,ফলে ইহা পালন করা হারাম” এটা বলে আমাদের সু-শীল সমাজ ছাগু সম্প্রদায়ের সাথে জিকির তোলে । তবে অন্যান্য বিষয়ের মত তাদের মঙ্গল শোভা যাত্রা নিয়ে চুলকানিও অমূলক ।

প্রাচীন বাংলায় পুন্যাহ নামে একটি অনুষ্ঠান ছিল । যা বছরের প্রথম দিনে পালন হত । “পুণ্যাহ মূলত সংস্কৃত শব্দ। অর্থ ভালো কাজের সুফল পাবার দিন। জমিদারী প্রথার সময় বছরের সূচনার দিন অর্থাৎ পয়লা বৈশাখে অনুষ্ঠান করা হত। অনুষ্ঠানটি ছিল রাজা-প্রজার দেখা হবার এবং কথা বলার দিন”। মূলত এই দিনে জমিদার প্রজাদের নিকট থেকে খাজনা আদায় করত । এবং ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে একসাথে বসে খাবার খেত । জমিদার প্রজাদের নতুন পোশাক উপহার দিতেন । প্রজারাও জমিদারের জন্য উপহার নিয়ে আসত ।

গ্রাম থেকে জমিদার বাড়িতে আসার সময়ে প্রজারা ঢাক-ঢোল বাজাত । সেই সাথে অশুভ শক্তির প্রতীক বানিয়ে নিয়ে আসত । বাঘ,কুমীর,সাপ ইত্যাদি গ্রাম বাংলার জন্য আতঙ্ক ছিল । এই প্রতীক গুলো তারা তৈরি করে আনত । এবং পুন্যাহ শেষে জমিদার এগুলোকে ধংস করত । যাতে এগুলো প্রজাদের ক্ষতি না করতে পারে । বিষয়টা পুরোপুরি প্রতীকী । যেমন হজ্বের সময় শয়তানের প্রতীকে মুসল্লিরা পাথর ছোড়ে , যেমন ভাবে কমন ওয়েলথ ভুক্ত দেশ গুলো ইংল্যান্ডের রানীকে রানী মানে । একই ভাবে মঙ্গল শোভা যাত্রা একটি প্রতীকী অনুষ্ঠান । এর দ্বারা অশুভ শক্তির পতন কামনা করা হয় । যা খুব ভালোভাবেই বাঙালী সংস্কৃতির সাথে যড়িত ।

0 Shares

১৩টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ