খুব ছোটবেলায়, স্কুল বন্ধের সময়টাতে ঢাকায় খালার বাসায় বেড়াতে যেতাম ক'দিনের জন্যে। খালু এখানে ওখানে ঘুরতে নিয়ে যেতেন। তখন তো আর যানজট ছিল না। বেবিট্যাক্সি শাঁ শা করে ঢাকার রাজপথ দিয়ে ছুটে চলতো। বিশুদ্ধ হাওয়ায় চুলগুলো যখন উড়ত, ছোট্ট আমি তখন অবাক বিস্ময়ে বাইরে তাকিয়ে থাকতাম। দেখতাম বড় বড় প্রাসাদ, পরিচ্ছন্ন রাস্তা আর পাশ দিয়ে চলে যাওয়া ব্যস্ত মানুষজন। বেবিট্যাক্সির শোঁশোঁ শব্দের মাঝেই খালু আঙুল উঁচিয়ে দেখাতো, ঐ যে বাঁ পাশের ওটা সংসদ ভবন, ওটা শিশু পার্ক, এটা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়...। আমি ঘাড় বাঁকিয়ে দেখতে না দেখতেই সেটি পেরিয়ে সামনে ছুটে চলতো ট্যাক্সি।
একবার ঈদের ক'দিন আগে খালু নিয়ে গেল মার্কেটে, ঈদের জামা কিনে দিবে বলে। অসংখ্য পোশাকের মাঝে সবচেয়ে সুন্দর জামাটি পছন্দ করে বসলাম। অনেক দাম দিয়ে গোলাপি রং এর সেই জামাটিই তিনি আমায় কিনে দিলেন।সে রাতে খুশিতে আমার ঘুম এলো না। এতটাই আনন্দে আত্মহারা হয়েছিলাম যে, শয়নে, স্বপনে, জাগরণে নিজেকে সেই নতুন জামাটি গায়ে দেয়া গোলাপি পরী মনে হতো।
প্রতিবার খালু যখন গ্রামে উনার বাবা-মা'কে দেখতে যেতেন, পথিমধ্যে আমাদের মফঃস্বল শহরের বাড়িতে কিছুটা সময় বিশ্রাম নিতেন। সেই সময়ে আমি আমার খেলার সাথীদের দূর থেকে গর্বভরে বলতাম, " ঐ যে নায়কের মত সুন্দর মানুষটিকে দেখছ, উনি আমার খালু "। বলা বাহুল্য তিনি দেখতে সম্ভবত প্রায় ছয় ফুট লম্বা সুদর্শন এবং শিক্ষিত মানুষ ছিলেন। এরপর বড় হতে হতে প্রখর ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষটির সামনে আমরা অনেকটাই বন্ধুসুলভ গল্প করি। যখনই দেশে যাই, খালার উত্তরার বাসায় আমার দুই তিন রাত থাকা চাই। সেই সময়টাতে খালুর সাথে গল্প হয়। কত কথা ! পারিবারিক, সুখের, দুঃখের, সমস্যার, উত্তরণের । যেন আমি তাঁর নিজেরই কন্যা।
আজ সারাদিন নিউইয়র্কের ব্যস্ত রাস্তায় হাজারো ব্যস্ততার মাঝে এতসব স্মৃতি আনাগোনা করছে। ভেতরটা গুমরে গুমরে কাঁদছে। চারিদিকে কেবলই খাঁখাঁ শূন্যতা। দু'চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। হঠাৎ অসুস্থ হওয়াতে হাসপাতালে নেবার পর আর বাঁচানো যায়নি, পৃথিবীকে বিদায় জানিয়ে খালু চলে গেছেন অন্যলোকে। একটু পরেই খাটিয়ায় করে নিয়ে যাওয়া হবে নিথর দেহখানা,শেষ যাত্রায়। রেখে আসা হবে ভীষণ এক নিস্তব্দতায় ... 🙁
জীবন এত ছোট ! কোন কারন ছাড়াই প্রিয় মানুষগুলো নাই হয়ে যায় ! বেঁচে থাকতে আমরা মানুষেরা মানুষের কদর বুঝি না। মৃত্যুর পর সেই তাঁদের জন্যেই অশ্রুজলে বুক ভাসাই ভীষণভাবে। কি অদ্ভুত এইসব অশ্রুজল ! এইসব ভালবাসা !
রিমি রুম্মান
নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র
১৯টি মন্তব্য
নাসির সারওয়ার
শুনেছি জন্মের একটা ঋণ থাকে যা মৃত্যু দিয়ে শোধ হয়। তবে সময়টা একটু বাড়ানো হলে ক্ষতি কি ছিলো! একটা কচ্ছপের তিনশো বছর বাঁচতে হবে কেনো! কি উপভোগ করে এতো সময়!!
আপনার খালু ভালো থাকুন যেখানেই থাকুন।
রিমি রুম্মান
জীবন কতো ছোট মনে হয় ! একজন মানুষকে আমি যুবক থাকা থেকে মধ্য বয়স, অতঃপর বৃদ্ধ হওয়া , এবং শেষে জীবনের পরিসমাপ্তি হতে দেখেছি। জীবন এতো ছোট !
জিসান শা ইকরাম
আপনার খালুর আত্মা শান্তি পাক, আল্লাহ খালুকে বেহেস্ত নসীব করুক- আমীন।
ঠিকই বলেছেন আপনি বেঁচে থাকার সময় আমরা মানুষের কদর বুঝিনা।
ভাল থাকুন প্রবাসে,
শুভ কামনা।
রিমি রুম্মান
আপনিও ভাল থাকুন। নিরাপদ থাকুন।
ছাইরাছ হেলাল
হ্যা, খুবই ছোট্ট এ জীবন, হারানোটুকু বুকে বিঁধে থাকে, থেকেই যায়।
তিনি থাকুন শান্তিতে,
আমিন,
রিমি রুম্মান
আমিন…
ইঞ্জা
রাব্বির হাম হুমা কামা রাব্বায়ানি ছাগিরা
আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিনের কাছে খালুর আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি আল্লাহ্ যেন উনাকে জান্নাতুল ফেরদৌস দান করেন, আমীন।
রিমি রুম্মান
আমীন…
নীলাঞ্জনা নীলা
খালুর আত্মা শান্তিলাভ করুন।
রিমি আপু অনুভব করছি তোমার এই কষ্ট। প্রিয় মানুষ যখন হারিয়ে যায় কতোটা যন্ত্রণা হয়।
ঈশ্বর তোমার মনে স্বস্তি এনে দিক। -{@
রিমি রুম্মান
প্রিয় মানুষগুলো একে একে সব চলে যাচ্ছে চিরতরে না ফেরার দেশে। আমাদের আর কোনদিনই দেখা হবে না এই পৃথিবীতে ! 🙁
নীলাঞ্জনা নীলা
রিমি আপু প্রিয়’র বদলে আরোও প্রিয়ও তো এসেছে জীবনে। আমরা মা হয়েছি।
ব্লগার সজীব
আপনার খালুর আত্মা শান্তি পাক। কত মায়া থাকে আমাদের একটি জীবনে।
রিমি রুম্মান
মায়া আর ভালোবাসা খুব কাঁদায় মানুষকে… 🙁
মৌনতা রিতু
এ জীবনে কিছু মানুষের প্রভাব আসলে আজীবন থেকে রয়ে যায়। তারা হয় জীবনের সব হাসি কান্নার আশ্রয় স্থল। তাদের কাছে জমা থাকে সুখ দুঃখগুলো।
উনি ভাল থাকুক, এই কামনা। একদিন তো যেতেই হবে সবাইকে।
রিমি রুম্মান
আমাদের দেখা হবে একদিন অন্যখানে…
সেই ছোটো আমি আর আমার খালু…
রুম্পা রুমানা
এমনই। থাকতে আমরা বুঝি না ।হারালেই কষ্ট পাই। মানব জীবনটাই এমন কষ্টে ঘেরা।
রিমি রুম্মান
ভাল থাকুন প্রিয় মানুষগুলোকে নিয়ে।
শুভকামনা…
আবু খায়ের আনিছ
মানুষের জীবন এত ক্ষণস্থায়ী দেখেই হয়ত আমরা এত বেশি মায়ায় পড়ে যাই। আপনার খালুর আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি।।
রিমি রুম্মান
আমিন…