একাত্তুরের একিলিস

আগুন রঙের শিমুল ১৪ জানুয়ারি ২০১৫, বুধবার, ০১:২০:০৯পূর্বাহ্ন মুক্তিযুদ্ধ ৩৭ মন্তব্য

১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১

বাংলাদেশ বেতার এবং বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত হয়  একটি ঘোষনা , সে ঘোষনাপাঠ করেন একজন অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী মেজর আবু তাহের মোহাম্মদ হায়দার -"আমি মেজর হায়দার বলছি -মুক্তিবাহিনীর প্রতি নির্দেশ " এই শিরোনামে।

মেজর হায়দার , ডাকনাম মুক্তো। দড়ির মত পাকানো শরীর, ঠাণ্ডা, শান্ত দৃষ্টির মধ্যেও গনগনে ভাটার আগুন আর সিংহ হৃদয় এই মানুষটা যোদ্ধা হিসেবে ছিiলেন অনন্য উচ্চতার। অল্প কিছু সৈনিক নিয়েই যিনি মুক্তিযুদ্ধের প্রথম সময়ে মুসল্লী ব্রীজ উড়িয়ে দিয়েছিলেন।  ক্রাক প্লাটুনের ট্রেনার ছিলেন তিনি, ছিলেন কোমলে কঠোরে মেশানো এক অদ্ভুত মানুষ। হায়দার পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমী কাকুলে ট্রেনিং করেন এবং কমিশন প্রাপ্তির পর গোলন্দাজ বাহিনীর অফিসার হিসাবে নিয়োজিত থাকেন। পরে তিনি চেরাটে S.S.G. (Special service group) ট্রেনিং-এ কৃতিত্বের সাথে উর্ত্তীর্ণ হন। উল্লেখ্য, চেরাটের এই ট্রেনিংটি ছিল মূলত গেরিলা ট্রেনিং। এখানে ৩৬০ জন অফিসারের মধ্যে বাঙালি ছিলেন মাত্র দুইজন।

সেইখানে সেই কঠিনতম ট্রেনিং এর সময় তিনি সাহসীকতার এক অনন্য নিদর্শন সৃষ্ঠি করেন প্যারাট্রুপারদের ট্রেনিংয়ে হাজার হাজার ফুট উপর থেকে জাম্প দিতে হয়, ফার্স্ট জাম্প সবচেয়ে বিভীষিকাময় হয়, এমন সৈনিক খুব, খুবই কম আছে দুনিয়ায় যারা ফার্স্ট জাম্পের আগে কান্নাকাটি করেনি - সেই খুব কমদের একজন তৎকালীন ক্যাপ্টেন হায়দার। তার সংগী পাকিস্তানি ট্রেইনিদের প্রতি তার হাসতে হাসতে বলা কথাগুলো ছিলো এরকম - “ দেখো, আমরা বাঙ্গালী। ভয় জিনিসটা পাইতে শিখি নাই। আমরা চোখ খুলেই লাফ দেই। '' এইরকম ছিলো তার সাহসিকতা ।

ট্রেনিং শেষ করার পর মুলতান ক্যাণ্টনমেন্টে তাঁর প্রথম পোস্টিং হয় এবং ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত তিনি সেখানেই অবস্থান করেন। তৃতীয় কমান্ডো ব্যাটালিয়নের একজন ক্যাপ্টেন হিসাবে ১৯৬৯ সালের শেষে অথবা ১৯৭০ সালের প্রথম দিকে এ. টি.এম হায়দারকে কুমিল্লা সেনানিবাসে নিয়োগ দেয়া হয়। ১৯৭১ সালের জানুয়ারি মাসে তাঁকে পুনরায় বদলি করে ঢাকায় নিয়ে আসা হয় এবং ১৫/২০ দিন পর তাঁকে আবার কুমিল্লায় নিয়োগ দেয়া হয় । হায়দার কুমিল্লা সেনানিবাস থেকে পালিয়ে ২৬ মার্চ মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন এবং শুরু থেকেই ২নং সেক্টরের কমান্ডার মেজর খালেদ মোশাররফ এর সেকেন্ড ইন কমান্ড হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। মেলাঘরে অবস্থিত প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে সকল মুক্তিযোদ্ধাকে কমান্ডো, বিস্ফোরক ও গেরিলা ট্রেনিং সহ হায়দার মুক্তিযোদ্ধাদের শপথ গ্রহণ করাতেন। মেলাঘরে হায়দার প্রথম একটা স্টুডেন্ট কোম্পানি (পরবর্তীতে ক্রাক প্লাটুন নামে খ্যাত) গঠন করেন। এই কোম্পানিকে তিনিই ট্রেনিং প্রদান করতেন। কিশোরগঞ্জ -ময়মনসিংহ মহাসড়কের উপর তারের ঘাটপুল ও মুসল্লি রেলপুল, ঢাকা-চট্রগ্রামের রাস্তায় ফেনিতে অবস্থিত বড়পুল ধবংসসহ একাধিক অপারেশনের নেতৃত্ব দেন মেজর হায়দার। অক্টোবরের ৭ তারিখে খালেদ মোশাররফ নিয়মিত ব্রিগেড কে' ফোর্সের কমান্ড গ্রহণ করলে তিনি সেক্টর অধিনায়কত্ব লাভ করেন ।

এ.টি.এম. হায়দারের ছোট বোন ক্যাপ্টেন সিতারা বেগম (বীর প্রতীক) ও একমাত্র ছোট ভাই এ.টি.এম সফদার (জিতু) ও মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। এ.টি.এম সফদার ভারতের মেলাঘরে অবস্থিত ট্রেনিং ক্যাম্প থেকে প্রশিক্ষণ নেন এবং শালদানদী এলাকায় বিভিন্নযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তিনি ভারতের আগরতলাস্থ ৯২ বি. এস. এফ. ক্যাম্পের সঙ্গে বিভিন্ন যুদ্ধ বিষয়ক যোগাযোগ ও খবরাখবর (অফিসিয়াল) আদান-প্রদান করতেন। ক্যাপ্টেন সেতারা বেগম বিশ্রামগঞ্জে বাংলাদেশ হাসপাতালে কাজ করতেন।

১৬ ই ডিসেম্বর পাকবাহিনীর আত্মসমর্পন অনুষ্ঠানে তিনি উপস্থিত ছিলেন । পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অধিনায়ক নিয়াজীকে যখন ইন্ডিয়ান অফিসারদের সবাই আত্মসমর্পণ মঞ্চে নিয়ে যাবার ব্যাপারে দোটানায় ভুগছে তখন এগিয়ে এলেন সিংহ হৃদয় এই লোক, নিয়াজীকে হাতে ধরে আত্মসর্পন মঞ্চে নিয়ে যান হায়দার। নিয়াজী তাকিয়ে দেখে এক বাচ্চা চেহারার বাঙালি মেজর তাকে নিয়ে যাচ্ছে তার সৈনিক জীবনের সবচেয়ে লজ্জাকর অনুষ্ঠানে।

স্বাধীন বাংলাদেশে মেজর হায়দার কুমিল্লা সেনানিবাসে ১৩ ইস্টবেঙ্গল প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৭৪ সালে তিনি লেফটেন্যান্ট কর্ণেল পদে উন্নীত হন ও চট্রগ্রাম সেনানিবাসে ৮ম বেঙ্গলের কমান্ডিং অফিসার হিসেবে নিয়োগ প্রাপ্ত হন। ১৯৭৫ সালের নভেম্বরে পিতার জরুরী টেলিগ্রাম পেয়ে ঢাকায় আসেন এবং যুদ্ধকালীন সহযোদ্ধা আরেক কিংবদন্তী বীরসেনা জেনারেল খালেদ মোশারফের সাথে সাক্ষাৎ করতে যান। এবং তাহেরের বালখিল্যতার তথাকথিত সীপাহী জনতার বিদ্রোহের শিকার হয়ে শাহাদাৎ বরন করেন এই অমিততেজ সাহসী যোদ্ধা, কোনদিন প্রানের মায়া করেন নাই, ৭ই নভেম্বর জিয়াউর রহমানের নির্দেশে যখন মেজর জলিল আর আসাদ তাকে ব্রাশফায়ার করতেছে, তখনো চোখে ছিল তার সেই পুরান দীপ্তি,সেই অমিত তেজ। সেক্টর টুয়ের হাজার হাজারো গেরিলাকে নিজের হাতে তৈরি করেছেন, অমিত বীর যে সোলজারদের কাছে একিলিস - তার মরদেহ পরে থাকে রাস্তায় , অযত্নে সহযোদ্ধা খালেদের পাশে।

 

ল্যাফটেনেন্ট কর্নেল হায়দার (বীর উত্তম) তেমন বীর, জীবন মৃত্যু আক্ষরিক অর্থেই যাদের পায়ের ভৃত্য। মৃত্যু যাদের মহিমা বিন্দুমাত্র ম্লান করতে পারেনা - গতকাল ১২ই জানুয়ারী ছিলো সেই মৃতুঞ্জয়ী বীরের জন্মদিন। শুভ জন্মদিন মাই কর্নেল। আমাকে একটা দেশ দেবার জন্য সশ্রদ্ধ চিত্তে স্মরন করছি তোমাকে

0 Shares

৩৭টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ