একটি নক্ষত্রের পতন

আজিম ৩০ জুন ২০১৪, সোমবার, ০১:৫৬:৫৬অপরাহ্ন বিবিধ ১৪ মন্তব্য

জ্ঞানসাধক, দার্শনিক, শিক্ষাবিদ জাতীয় অধ্যাপক সরদার ফজলুল করিমের মৃত্যুতে নাগরিক শোকসভা  

 

নাগরিক শোকসভাটি ছিল গত ২৮ জুন, ২০১৪ তারিখ সন্ধা, স্থান বাংলা একাডেমি। আমার যাওয়ার কোন কারন ছিলনা, কারন সরদার ফজলুল করিমের নাম আমি শুনেছিলাম, তবে কোন পরিচয়ই ছিলনা ওনার সাথে। শুনেছিলাম খুব নামকরা লোক ছিলেন উনি, ছিলেন আমাদের জাতীয় অধ্যাপক এবং কমিউনিষ্টও, প্রখ্যাত। জানতাম বিশিষ্ট নাগরিকরা আসবেন সমাজের, অনেক কিছু বলবেন তারা। অনেক কিছু জানা যাবে তাঁর সম্পর্কে।

পবর্টি সাজানো হয়েছিল প্রথমে ঢাকা ইউনিভার্সিটির সিনিয়র শিক্ষকরা বলবেন, তারপর  রাজনীতিবিদ, শেষে সরদার ফজলুল করিমের একমাত্র মেয়ে এবং সবশেষে সঙ্গীতানুষ্ঠান।

জাতীয় অধ্যাপক জনাব সালাউদ্দিন আহমদ বলছিলেন যখন হলে ঢুকি। প্রবীন লোক, জনাব সরদার ফজলুল করিমের কাছাকাছি বয়সের, ২/৩ বছরের ‍সিনিয়রই হবেন বলে বললেন। একটা থিসিসের বিষয়ে তাঁর সাথে ওনার প্রথম সাক্ষাৎ, সেও অনেক বছর আগের কথা, আজ থেকে প্রায় পঞ্চাশ বছর হবে। আরো বলেন তিনি যে, অনেক বড় মাপের শিক্ষাবিদ এবং পন্ডিত ব্যক্তি ছিলেন তিনি, তবে পান্ডিত্যের কোন অহংকার মোটেই ছিলনা তাঁর মধ্যে। এরপর এলেন প্রাক্তন অধ্যাপক জনাব জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, ইংরেজী বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম, ইতিহাসের অধ্যাপক মুনতাসির মামুন, জাহাঙ্গীরনগর ইউনিভার্সিটির সাবেক ভিসি অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন।

একে একে বলে গেলেন তাঁরা। না, তাঁদের সাথেও সরদার স্যারের খুব একটা যোগাযোগ ছিলনা। তবে একাধিকবার কথা হয়েছিল। আসলে উনি তো পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন ৮৯ বছর বয়সে, এই সেদিন ২০১৪-র ১১ই জুন। সাতচল্লিশের দেশভাগের পর কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সরদার ফজলুল করিম চলে আসেন তৎকালীন পূর্ব বাংলা এবং পরে যার নাম হয়েছিল পূর্ব পাকিস্থান। আজকের পশ্চিম বঙ্গ ও সাবেক পূর্ব পাকিস্থান মিলে বৃহৎ যে বাংলা ছিল, অবিভক্ত সেই বাংলার কমিউনিষ্ট পার্টির নেতৃস্থানীয় সদস্য ছিলেন সরদার ফজলুল করিম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশুনার পর তিনি বৃটেনে উচ্চশিক্ষার্থে এক বৃত্তি পান। কিন্তু পার্টির সিদ্ধান্ত মেনে সেই বৃত্তি তিনি প্রত্যাখ্যান করেন। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগে শিক্ষকতা করেন এবং একসময় ছেড়েও দেন কর্তৃপক্ষের সাথে বনিবনা না হওয়ায় এবং পার্টির প্রয়োজনেও। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এই মহান মানুষটিকে অধ্যাপক করতে রাজী না হওয়ায় অধ্যাপক মুনতাসির মামুন ক্ষোভ প্রকাশ করেন শোকসভায়। সম্মানিত অধ্যাপকগন তাঁর বিনয়ী স্বভাবের এবং সহজ-সরল অভিব্যক্তির ভূয়সী প্রশংসা করেন এবং দেশ এক বিরাট নক্ষত্র কে হারাল বলেও বিশেষভাবে দু:খ প্রকাশ করেন।

বক্তারা আরো বলেন, সংসার চলত তাঁর নিদারুন কষ্টে দীর্ঘসময়। তবুও নীতি-আদর্শের কাছে কখনও নতি স্বীকার করেননি তিনি। কাউকে বলতেননা তাঁর অভাবের কথা। এভাবে নিজেকে যতরকমভাবে বঞ্চিত করে রাখা যায়, রেখেছিলেন তিনি, প্রকাশও করেননি এবং কোনরকম আপোষও করেননি।

এবার রাজনীতিবিদগনের পালা। প্রথমেই এলেন রাশেদ খান মেনন, মন্ত্রী এবং সভাপতি, ওয়ার্কাস পার্টি। প্রায় ৭০ বছর বয়স তাঁরও, খুব বেশী পরিচয় ছিলনা সরদার ফজলুল করিমের সাথে তাঁরও জীবনে দু’একবার দেখা হওয়া ও সামান্য কথাবার্তা ছাড়া। আমাদের দেশের কমিউনিষ্ট আন্দোলনে তাঁর অসামান্য অবদানকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে স্বল্পকথায় তিনি তাঁর বক্তব্য শেষ করেন।

এরপর আওয়ামী লীগ নেতা জনাব নূহ-উল-আলম লেনিন তাঁর বক্তৃতায় বলেন, ‘আমার বাড়ী লৌহজং, মুন্সিগঞ্জ, আমার বাবা-মা দু’জনই কমিউনিষ্ট পার্টি করতেন। তাঁদের আমলে তাঁদের গ্রামে জমি-জমা সংক্রান্ত এক বিবাদের মীমাংসায় ঢাকা থেকে দু’জন কমিউনিষ্ট নেতা গিয়েছিলেন ওখানে, একজন মূনীর চৌধুরী এবং আরেকজন হচ্ছেন সরদার ফজলুল করিম। অভাবনীয় দক্ষতা এবং সরলতার সাথে বিষয়টির ফয়সালা করেছিলেন তাঁরা। আমি তাঁকে দেখিওনি তখন, আমার মায়ের কাছে শোনা। শৈশবে শোনা সরদার ফজলুল করিমের এসমস্ত  গল্প শুনে আমরা বড় হয়েছি।‘ আরো তিনি বলেন, আমরা রাজনীতি করি, মেঠো বর্ক্তৃতা দেই. কিন্তু এই রাজনীতিবিদ আমাদের মত রাজনীতিবিদ ছিলেননা। চিরদিন নিপীড়িত-বঞ্চিত মানুষের জন্য সংগ্রাম করবেন বলে তিনি নিজের সার্টিফিকেটটাকেও অপ্রয়োজনীয় মনে করে ছিঁড়ে ফেলেছিলেন একসময়, তাঁকে অভিবাদন।

বাংলাদেশের কমিউনিষ্ট পার্টির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম সবসময় অন্তর থেকে কথা বলেন। সরদার ফজলুল করিমের বৃটেনে বৃত্তি পেয়েও যেতে না পারার বিষয়ে তিনি বলেন, বঙ্গদেশের কমিউনিষ্ট আন্দোলন তখন নিয়ন্ত্রিত হত কলকাতা থেকে, নিয়ন্ত্রক ছিলেন, হেসে বলেন তিনি, কাকাবাবু মোজাফ্ফর হোসেন। এই কাকাবাবুকে সরদার ফজলুল করিম যখন বলেন তাঁর বৃত্তি নিয়ে চলে যাওয়ার কথাটা, কাকাবাবু বলেন, যাও, তোমরা উচ্চশিক্ষা নাওগে আর আমরা এদেশে থেকে ভেরেন্ডা বাজাই। নেতার মনোভাব বুঝে আর বিদেশ যাওয়া হলোনা তাঁর। অথচ উচ্চশিক্ষা নিয়ে ফিরে এসে তিনি তাঁর আহরিত সেই জ্ঞান ভালভাবে বিতরন করতে পারতেন এবং দেশ ও দশের জন্য সেটাই ভাল হতো। কিন্তু কমিউনিষ্ট নেতা কাকাবাবু তা আর হতে দিলেননা। শোকসভায় তরুন সমাজের অনেক প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন, হাসি এবং একইসাথে হাততালির একটা রোল ওঠে সেসময়।

মুক্তিযোদ্ধা যাদুঘরের ট্রাষ্টি সারওয়ার আলী একটি গ্রামে দীর্ঘদিন থেকে কৃষকদের সাথে তাঁর বাস করার কথা স্মরণ করে বলেন, তিনি সেখানে গিয়ে কৃষকদেরকে আপনি আপনি করে কথা বলেছেন। তারা বলেছে, আপনি এত বড় মানুষ, আমাদেরকে আপনি করে কথা বলছেন! তাছাড়াও তিনি লুঙ্গি-গেঞ্জি গায়ে দিয়ে জমির আইলের উপর মাটিতে বসে পড়ে হেসে হেসে তাদের সাথে কথা বলতেন। অত্যন্ত সরল ভঙ্গিতে চলাফেরা করতেন তিনি, সহজ-সরলভাবে কথা বলতেন সবার সাথে হেসে হেসে। এরকম মানুষ বিরল আসলে।

নাগরিক শোকসভায় আরো বক্তব্য রাখেন শিক্ষাবিদ জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, ন্যাপের পংকজ ভট্টাচার্য প্রমূখ।

এর আগে শুভেচ্ছা বক্তব্যে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান এবং অন্যান্য বিশিষ্ট শিক্ষাবিদগন বলেন, প্লেটো, অ্যারিষ্টটল, এঙ্গেলস (এন্টি দুরীন বইটি)-এর মতো দার্শনিক ব্যক্তিত্বগনের বিভিন্ন সংকলন বাংলায় অনূবাদ করে সরদার ফজলুল করিম আমাদের বাঙ্গালী সংস্কৃতি এবং জ্ঞানভান্ডরকে সমৃদ্ধ করে গেছেন।

সভাপতির বক্তব্যে এমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেন, কিছুটা কাছে থেকে সরদার ফজলুল করিমকে দেখার সুযোগ আমার হয়েছে। তাঁর নি:স্বার্থ কমর্কান্ডের কারনে মানুষ তাঁকে বড় বেশী ভালবাসতেন।

এই মনীষীর একমাত্র কন্যা ডা. আফসানা করিম তাঁর বক্তব্যে বলেন, বাবা আমাকে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলগুলি ঘুরে ঘুরে দেখিয়েছেন। বিভিন্ন সমস্যায় থেকে কীভাবে বাঁচতে হয়, বাবার কাছেই শিখেছি আমরা। দর্শনের ছাত্র হয়েও তিনি আমাকে ডাক্তারী পড়িয়েছেন শুধুমাত্র যাতে আমি মানুষের সেবা করার সুযোগ পাই।

এরপর সঙ্গীতানুষ্ঠান। দু’টি গানের পরিবেশনা ছিল মাত্র। ঋষিজ শিল্পীগোষ্টী পরিবেশিত শেষ গানটি রবীন্দ্রনাথের আগুনের পরশমনি ছোঁয়াও প্রানে --- ।

গানটি শেষে কেন পরিবেশিত হলো, ভাবতে ভাবতে বেরিয়ে আসি। আসলেই শ্রদ্ধেয় সরদার ফজলুর করিম আগুনের পরশমনি, যে পরশমনি আমাদের প্রানে ছোঁয়ানোর আহ্বান-ই বলব আমি এটাকে।

যারা এই পরশমনি নিজ প্রানে ছোঁয়াবেন,  তারাই হবেন আসল মানুষ, সাচ্চা এবং সুন্দর মানুষ।

 

[পাদটিকাঃ সরদার ফজলুল করিমকে কমিউনিষ্ট পার্টি-নের্তৃত্ব বৃত্তি নিয়ে বিদেশ যেতে দেননি বলে অনেক স্বনামধন্য অধ্যাপক এবং এমনকি কমিউনিষ্ট পার্টির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমও তৎকালীন পার্টি-নেতৃত্বের সমালোচনা করেছেন প্রকারান্তরে। হয়ত সমালোচনারই মত কাজ হয়েছে এটা। কিন্তু এটার একটা পজিটিভ দিক কী নাই? যেমন সরদার ফজলুল করিম না গিয়ে দেশে যে কাজগুলি করেছেন ঐসময়টায়, সেটা হয়ত বিদেশে গিয়ে শিক্ষার্জনের থেকে বেশী হয়েছে। আর শিক্ষা কী শুধু বিদেশেই অর্জিত হয়? কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি মানুষের মাঝে কাজ করলে কি শিক্ষা হয়না? আর প্রত্যাখ্যান করার মধ্যেও একধরনের উদাহরন সৃষ্টি করার ব্যাপার রয়েছে। যদি বলি এ-কারনেই শোকসভায় এ-কথাটি আলোচকগন বেশী বেশী করে বলেছেন।] 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

0 Shares

১৪টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ