আমার ভিতর এক অদ্ভূত আমি।

রিতু জাহান ১১ জুলাই ২০১৬, সোমবার, ১১:৪১:১৪পূর্বাহ্ন একান্ত অনুভূতি ৩৪ মন্তব্য

অনেকদিন পর বাসায় আমি একা। একেবারেই একা। কম্পিউটারে প্রিয় গানগুলো ছেড়ে জ্যোতিপ্রকাশ দত্তের একটা বই হাতে নিয়ে বসেছি। গান বাজছে কিশোর কুমারের #জীবনের অংকটা মেলাতে গিয়ে# কুমার শানুর # নিথর জলের বুকে#

আমি কখনোই নিজেকে কারো সাথে মিলাতে যাইনা। আমি কখনোই কারো কথায় খুব একটা বিচলিত হইনা। আমি বাবার একটা কথা সব সময়ই লালন করি, তা হলঃ পৃথিবীতে এক একটা মানুষ এক একেক রকম। তাদের চিন্তাও আলাদা। তোমার সাথে নাও মিলতে পারে। সেই স্কুল জীবনে পড়ার এক ফাঁকে আব্বা এসে কবিতা আবৃত্তি করতঃ এই খানে তোর দাদীর কবর, আমি দেখতাম আব্বার গলা ধরে আসত। আমি পাশে গিয়ে দাঁড়াতাম। কতো যে মধুর ছিল আমার সেইদিনগুলি। অনেক পরিবারে একজনের অনুপস্থিতিতে অনেক সমালোচনা করতে দেখেছি। আমরা যেহেতু থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স কোয়ার্টারে বড় হয়েছি, অনেক সময় আন্টিরা একজন আর একজনের দোষ নিয়ে গল্পে মেতে উঠত। মা সেই সব আন্টিদের সাথে মিশত না।

আমাদের বাসায় ছোটবেলায় দেখতাম অবজারভার পত্রিকাটা আসত, এরপর আমাদের জন্য আসা শুরু হল ইত্তেফাক। বই পড়ার অভ্যাস আব্বার কাছ থেকেই পাওয়া। সুন্দরবন উপকূল এলাকা বলে পানির সমস্যা ছিল প্রচুর হাসপাতালের রোগিদের। কিন্তু আমাদের ছিল অনেক বড় ট্যাংকি। রোগীরা সব আমাদের বাসায় আসত পানি নিতে। মাঝে মাঝে আমি বিরক্ত হয়ে যেতাম, দেখা যাচ্ছে ঘুমাইছি তখন এসে ডাকছে। মা আস্তে করে উঠে পানি দিত। কখনো যদি দেখত কারো সাথে খারাপ আচরন করেছি, বলত " মনটাকে বড় করো দেখ কতো প্রশান্তি"। আব্বার সহকারিকে নিজের মামার মতোই মনে হতো। আমি যে কতো ঘাড়ে উঠেছি বাবুল মামার ! লাস্টবার দেখতে গেছিলাম মামাকে, দেখি হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছে। আমার হাত ধরে কেঁদে উঠল।

আমি কি লিখব গেলাম কোথায় । মা আমার দাদিকে খুব ভালোবাসত অথবা আমার দাদীই মাকে খুব ভালবাসত। আব্বা অনেকবার মাকে শহরে নিতে চেয়েছে, সে কখনো যেতে চায়নি। দাদীর ছিল যানবাহনে প্রচন্ড ভীতি। তাই তাকে আর শহরে আনা হয়নি। আব্বা কখনোই গ্রামের পরিবেশটা পছন্দ করত না। কারণ সে দেখেছে গ্রামে থেকে পড়াশুনার কি কষ্ট। আব্বাতো বাবাকে খুব ছোটবেলায় হারায়। তাদের ছিল প্রচুর জমি। কোথায় কতটুকু আছে তাও বলতে পার না। অথচ সে মানুষের জমির ধান কেটে, সেই মুজুরি দিয়ে ১৬০ টাকা দিয়ে মেট্রিক পরীক্ষার ফর্ম ফিলাপ করে। অনেক কষ্ট করে লজিং থেকে আজ সে মেডিকেলে পড়ে এসেছে। কষ্টের কথা তার মধুর স্মৃতির কথা তার মুখে ও বাড়ির মানুষের কাছ থেকে শুনেছি।

জীবনে প্রতিটা পদে যার কাছ থেকে শিক্ষা পেয়েছি, আজ কখনো কখনো মনে হয় কিছুটা স্বার্থপরতা কেন শিখালো না, কেন কিছু নেগেটিভ মানসিকতা মনে ঢুকালো না। আব্বা বলত কুয়ার ব্যাঙের কুয়া ও ডোবা পর্যন্ত সীমাবদ্ধ। জগৎটা বাড়াও, লেখ পড়, মন ভাল না থাকলে ঘর থেকে বের হয়ে ঐ মাঠে চলে যাও, বুক ভরে নিঃশ্বাস নেও। কলেজে যখন উঠলাম, প্রেমের ব্যাপারে আব্বা আলাপ করত। আমরা একটা বড় পরিবারে বেড়ে উঠেছি, অনেক ভাইবোন, মামি, চাচিরাও আমাদের বান্ধবী। আমি গির্জায় গেছি, মন্দিরের ভিতর না গেলেও প্রসাদ খেয়েছি। মা অনেক যত্ন করে কোরআন পড়ানো শিখিয়েছেন। ধর্ম নিয়ে তাই কোনো নাক সিটকানো শিখিনি। কিন্তু জীবন সব সময় এক রকম চলে না। জীবনের মোড় ঘোরে। অন্য একটা পরিবেশে মেয়েদের খাপ খাওয়াতে হয়, মা তাও শিখিয়েছিল।

আমি কেন জানি অযথা অকারণে কারো সাথে খুনসুটিতে মেতে উঠতে পারিনা। মহিলাদের দেখি সিরিয়াল দেখছে গতানুগতিক একটা জীবন যাপনের। এক মূহুর্তে ঝগড়া করছে আর এক মুহূর্তে গল্পে মেতে উঠছে। সারাক্ষণ সমালোচনায় মুখর তারা। শাশুড়িকে এক গ্লাস পানিও দেখেছি ঢেলে খাওয়াতে রাজি নয়। সেদিন এমনি একটা কথা কানে আসতে অবাক হলাম। কথাটা তীরের মতো বিঁধে গেল "যখন একটু সময় পায় বই পড়ে, কি যে করে ! জামা কেনার টাকায় বই কেনে"? এটা কোনো ভবিষ্যতে কাজে লাগবে না। বাড়ির অন্য বৌরা অনেক সাদাসিদে। আচ্ছা সাদাসিধেরা কি গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো পারেনা ?

ছোটবেলা থেকে ধর্মীয় গোঁড়ামি দেখিনি। উল্টো স্রোতে হেঁটেও আসতে পারিনা। এ যেন অদ্ভুদ আমি।

আজ একটু এলোমলো আমি। অবাক করা কথাগুলো গিলে ফেলতেই হয়। তাছাড়া যে সমাজ বলবে বড়ই বেয়াড়া।

0 Shares

৩৪টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ