অচ্ছুৎ

মামুন ৫ ডিসেম্বর ২০১৪, শুক্রবার, ০৭:৩১:০২অপরাহ্ন গল্প ১২ মন্তব্য

সচিবালয়ের বিপরীতে সবাই অনশনে বসেছে।

হাজারখানেক মানুষ। সবাই দেশের একটি পোশাক কারখানার শ্রমিক। এরা এই ঈদের দিনেও নিজেদের কিছু ন্যায্য পাওনা আদায়ের জন্য এখানে একত্রিত হয়েছে। এদের কয়েক মাসের বেতন-ভাতা বকেয়া রয়ে গেছে।এর আগেও তারা বেশ কয়েকবার একই দাবীতে আন্দোলন করেছে। তবে তাদের নেতারা তাদেরকে আশ্বাস দিয়ে ফিরিয়ে এনেছে বারবার। সরকার আর মালিকপক্ষের সাথে বৈঠকের পর বৈঠক হয়েছে কেবলি। কিন্তু তাতে চিড়ে ভিজেনি। নিন্দুকেরা বলে শ্রমিক নেতাদের পকেট নাকি স্ফীত হয়েছে। তবে রিনা এ কথা বিশ্বাস করেনি। যেমন করেনি তাইজুল, সোহরাব কিংবা লতা।

যে বিশ্বকাপ নিয়ে সারা দেশে এত মাতামাতি, সেই ব্রাজিলের জার্সি এই অনশনকারীরাই বানিয়েছিল। সে তো কবেকার কথা। তাদের মালিক সেগুলোর টাকাও পেয়ে গেছে। তবে তাদের পাওনা টাকাটা যে তারা কেন পাচ্ছে না এটাই বুঝে আসছে না ওদের।

ওদের মালিক অবশ্য জেলে। কিন্তু তাতে কি? তিনিতো আর সব টাকা-পয়সা সাথে করে নিয়ে যাননি। এই মালিকের গ্রুপের অন্য একটি ফ্যাক্টরি আগুনে পুড়ে যায় দায়িত্বশীলদের ইচ্ছাকৃত অবহেলার দরুন। শ'খানেক রিনা-লতারা জ্যান্ত পুড়ে কয়লা হয়েছিল তাতে। এটা নিয়েও তাদেরকে পথে নামতে হয়...মালিকপক্ষের ভাড়াটিয়া গুন্ডাদের বেধড়ক পিটুনিকে উপেক্ষা করেও কতবার যে রাস্তায় নেমেছে ওরা!

ব্যানারের নীচে স্টেজের সামনে মাটিতে বসে বসে এসবই ভাবছিল রিনা।একজন সিঙ্গেল মাদার সে। একমাত্র ছেলেকে সাথে নিয়ে কোনোমতে দিন চলে যাচ্ছে। বাসায় রয়েছে এখন ওর আদরের ধন। সবে সাত বছর বয়স। ওর বাবা অন্য আর একজনের সাথে অন্যত্র সংসার করছে। খুব পিশাচ টাইপের ছিল মানুষটি। পরনারীতে আসক্ত। আর নেশাই ছিল তার জীবনের ধ্যান-জ্ঞান। রিনা অনেক চেস্টা করেছে মানিয়ে চলার। কিন্তু... ...

দূর থেকে একটা মিছিল আসছে। ওদের চীৎকারের শব্দে রিনার চিন্তার জাল ছিন্ন হয়। এরাও তাদের অন্য ভাই-বোনেরা। ওদের সাথে একাত্মতা ঘোষণার জন্য আসছে।মিছিলটি পুলিশের সামনে এসে একটু যেন উত্তেজিত হয়ে পড়ে। কেমন অসংলগ্ন আচরণ করতে থাকে। এমন তো হবার কথা না! নেতারা বারবার বলে দিয়েছিলেন, কোনো ধরণের সহিংস আচরণ করা চলবে না। তবে এমনটা হচ্ছে কেন?

হঠাৎ প্রচন্ড শব্দ করে বেশ কয়েকটি পটকা ফুটে। সেগুলোর লক্ষ্য ছিল রাস্তার বিপরীত পাশে সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশের কয়েকটি লরি। মুহুর্তে হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। লরির ভিতর থেকে ঢিল খাওয়া মৌমাছির মতো করে দাঙ্গা পুলিশেরা লাঠি হাতে বের হয়ে আসে। অনশনরত জমায়েত হওয়া সাধারণ শ্রমিকদের দিকে ব্লাড হাউন্ডের হিংস্রতা নিয়ে আগাতে থাকে। রিনার আশেপাশের সকলে কিভাবে যেন সরে যায়। রিনা বুঝে উঠতে পারে না কি হচ্ছে... তাকে কি করতে হবে। কয়েকটি টিয়ার শেল এসে পড়ে অভুক্ত এই শ্রমিকদের দিকে। তীব্র হুইশেল... চীৎকার... চোখ জ্বালা করা অনুভূতি এসবকিছুকে ছাপিয়ে প্রচন্ড একটা ব্যাথার অনুভূতির সাথে অন্ধকারে তলিয়ে যেতে থাকে রিনা। ওর জগতটা ম্লান হবার আগে ঝাপসা দৃষ্টিতে দেখতে পায় সেই বিচ্ছিন্ন উত্তেজিত শ্রমিকদেরকে পুলিশের পাশ দিয়ে নির্ভয়ে বেড়িয়ে যেতে। আর ওদেরই সহকর্মীদের লাঠিচার্জে রক্তাক্ত অবস্থায় নিথর দেহে পড়ে থাকতে... সারা এলাকাটা ঝাঝালো গ্যাসে বিষাক্ত নিঃশ্বাস উপহার দিচ্ছে... এখানে ওখানে স্যান্ডেল পড়ে আছে... পুলিশের সদস্যরা যাদের পারছে ধরে ট্রাকে তুলছে। মহিলাদেরকেও পুলিশ সদস্যরা চ্যাংদোলা করে নির্মম ভাবে ট্রাকে নিয়ে ফেলছে। ওকেও সেভাবে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে টের পেলো।

শুন্যে ঝুলন্ত অবস্থায় চেতন-অচেতনের মাঝামাঝি থেকে রিনার চিন্তায় ওর আদরের খোকনের মুখটি ভেসে উঠে। এবারের ঈদে নতুন জামা দেয়া হয়নি... পোলাউয়ের সাথে গরুর গোশত ওর খুব প্রিয়... সারাদিন রিক্সায় মায়ের সাথে ঘুরে বেড়ানোর জন্য কত দিন ধরে অপেক্ষা করছে!

ওকে যখন পুলিশের গাড়ির ধাতব মেঝেতে ফেলে দেয়া হল তখনো জ্ঞান একেবারে লোপ পায়নি। মাথাটা শক্ত কিছুর সাথে গিয়ে লাগাতে যে পরিমান ব্যথা পাবার কথা, রিনা তা পায় না। শরীরের কয়েক যায়গায় রাবার বুলেটের আঘাত ওকে আগেই ব্যথার ১০০% দিয়ে দিয়েছে। তরল কিছু মাথার পাশ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে টের পায়। কিন্তু নিজের রক্তের বয়ে যাওয়াটাও বুঝে না সে। ওকে বহনকারী গাড়িটি চলছে এটা অনুভব করে। কিছুক্ষন পরে হুইশেল বাজিয়ে অনেকগুলো গাড়ি ওদের পাশ দিয়ে অতিক্রম করে। লরির ভিতরের পুলিশদের টুকরো কথা-বার্তায় জানতে পারে মহামান্য প্রেসিডেন্ট হাইকোর্টের মাজার সংলগ্ন জাতীয় ঈদগাহে ঈদের জামাতে অংশ নিতে যাচ্ছেন।

ওহহো! আজ তো ঈদের দিন!! প্রধানমন্ত্রীর ঈদের শুভেচ্ছা সম্বলিত ম্যাসেজ পাচ্ছে সেই গতকাল থেকেই, নাকি আজকে- সে ঠিক ঠাহর করে ঊঠতে পারেনা। সবার ঘরে ঘরে আনন্দ... ওদের পরিচিত অন্য এক মালিকের ছেলেরা আমেরিকায় গেছে ঈদের কেনাকাটা করতে... তারা যে গাড়িতে চলাফেরা করে, তেমন গাড়ির দিকে তাকিয়ে থাকতেও রিনার কেন জানি ডর করে...যদি ওর তাকানোতে কিছু হয়ে যায়! সবার জন্যই আজ ঈদ... আনন্দ... কিন্তু এই আনন্দের পিছনে যে মানুষগুলো দিনরাত পরিশ্রম করে উন্নতির চাকাকে সামনের দিকে নিয়ে যাচ্ছে... আজ তারাই এভাবে রাবার বুলেট আর লাঠি চার্জে নিথর হয়ে ধাতব মেঝেতে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে! রিনার মাথাটা কিছুটা পরিষ্কার হয়ে আসে। সে বুঝতে পারে বিচ্ছিন্ন সেই শ্রমিক দলটিতে আসলে কোনো শ্রমিকই ছিল না। ওরা ছিল মালিকদের ভাড়াটিয়া গুন্ডা- যারা ওদের অহিংস আন্দোলনকে সহিংসতার রুপ দিতে এসেছিল। কারণ আজ ঈদের দিন... এই দিনটিকে ঘিরে সরকারের বিভিন্ন অর্জনের গায়ে কালিমা লেগে যাচ্ছিল ঘর্মাক্ত শরীরের এই সমাজের নীচু তলার কিছু অচ্ছুৎদের অহিংস আন্দোলনের দ্বারা। তাইতো পরোক্ষভাবে শক্তিশালী মহলের এই কূটচাল!

নিজের চোখের উপরের ঘাম আর রক্ত মুছে দৃষ্টিকে পরিষ্কার করার চেষ্টা করে রিনা। কিন্তু হাত দুটো অবশ... তবে পা দুটোতে এখনো জোর আছে টের পেল। ওর পায়ের কাছে দুজন পুলিশ সদস্য লোলুপ দৃষ্টিতে ওকে চাটছে দেখতে পায়। অবসন্ন শরীরে একজন সিঙ্গেল মাদার তার প্রতীক্ষায় ঈদের দিনে তার একমাত্র সন্তানের কথা মনে করে... একজন নারী শ্রমিক তার ন্যায্য পাওনা না পেয়ে উলটো রাষ্ট্রযন্ত্রের হাতে নিগৃহীত হয়ে নিথর দেহে কোনো এক ধাতব মেঝেতে পড়ে পড়ে তড়পায়... পাশ দিয়ে চলে যাওয়া রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদে আসীন ব্যক্তির নির্বিকার নীরবতায় একজন রিনার মনের গভীরে আগুন জ্বলে উঠে... মধ্যবিত্ত নামের এক 'সকল কাজের কাজী' সমাজ, যারা বদলে দেবার প্রত্যয় নিয়ে নিজেদের আখের গুছিয়ে নিয়ে সিদ্ধহস্ত... এদের সব কিছু নিয়ন্ত্রনের অদ্ভুত সক্ষমতায় সমাজের অচ্ছুৎ শ্রেণীর এক নারী ভিতরে ভিতরে ক্ষেপে উঠে... যাদের নির্মম লাঠি চার্জে ওর দুই হাত বিবশপ্রায়... যাদের এলোপাথাড়ি রাবার বুলেটে নিজের শরীরের মাংস বিক্ষত হয়েছে... সেই সদস্যদের এহেন পৈশাচিক লোলুপতায় রিনা নামের এই গার্মেন্ট শ্রমিকের চেতনায় এই দেশের সরকার প্রধান... গার্মেন্ট মালিকদের সংগঠন... ইন্ডিভিজুয়াল মালিক...শ্রমিক সংগঠনের অর্থলিপ্সু নেতা... নিয়ন্ত্রক মধ্যবিত্ত সমাজ...লাঠিয়াল পুলিশবাহিনী-এদের সবাই ঘুরে ফিরে বারবার আসতে চায়। কিন্তু এদের সকলের ভূমিকায় হতাশ এই দেশের অর্থনীতির প্রধান চালিকা শক্তির একেবারে ক্ষুদ্রতর ইউনিট এক নারী শ্রমিক, তার সকল বঞ্চনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার জন্য তার সামনে দুইজন পিশাচ সদস্যকে দেখতে পায়। ওদের একজনের উরুসন্ধিতে নিজের শরীরের বাকী শক্তিটুকুকে এক করে প্রচন্ড এক লাথি মারে... আর মুখ দিয়ে সর্ব শক্তি দিয়ে উচ্চারণ করে, ' দুনিয়ার মজদুর... এক হও'

রিনা নামের এই মেয়েটির সেই লাথিটা যে আমাদের দেশের নির্লিপ্ত প্রশাসনযন্ত্রের উরুসন্ধিতে গিয়ে লেগেছে- আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্র কিংবা সংশ্লিষ্ট অন্যান্য মহলগুলো কি তা আদৌ অনুভব করে?

আজ ঈদ! বাংলার ঘরে ঘরে আনন্দ! কার কি দায় পড়েছে ভাবার, কোথাকার কোন রিনার ছেলে না খেয়ে বসে আছে কিংবা নতুন জামা পাবার আশায় অপেক্ষা করছে...গরুর গোশত দিয়ে পোলাউ খাবার এক ভীষণ ইচ্ছে বুকে পোষণ করা এক সাত বছরের অচ্ছুৎ নারীর সন্তানের জন্য আমাদের বয়েই গেছে! আমার নিজের সন্তান খেলেই হল... আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে।।

0 Shares

১২টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ