কয়েস আমার পাড়ার ছেলে। একই পাড়ায় বেড়ে উঠলেও কোনোদিনই কথা হয়নি তাঁর সাথে। আসা-যাওয়ার পথে আমাদের দোতলায় ঝিম ধরা দুপুরে কিংবা সন্ধ্যার বেলকনিতে তাকাতো সে। চোখে চোখ পড়লে মাথা নুয়ে হেঁটে যেত বিশাল আকাশের নিচ দিয়ে। এইচ এইচ সি’র পর আমরা অনেকেই চাঁদপুর শহর ছেড়ে যাই। বিভিন্ন কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই। কয়েস কোথায় ভর্তি হয়েছে জানা হয়নি। ছাত্রাবস্থায় আমেরিকা পাড়ি জমিয়েছি যদিও, কিন্তু আব্বার কাছ থেকে পাড়া-প্রতিবেশিদের খবর পেতাম ফোনে। একদিন জেনেছি কয়েস আমেরিকায় থাকে। কোন শহরে থাকে সে খবর নেয়া হয়নি। দূরবর্তী হাওয়ার মতো ছিল হয়ত কোথাও।
রমজান কিংবা ঈদ এলে আব্বা বলতেন, ‘ কয়েস মসজিদের জন্যে টাকা পাঠাইসে, তুই পাঠাইবি কিছু ?’ মসজিদটি আমার ধর্মীয় শিক্ষার পবিত্রস্থান। তাছাড়া মসজিদের জন্যে টাকা পাঠানো মানে, সংস্কার কাজ করানো, গ্রীষ্মের তপ্ত দিনে মুসল্লিদের নামাজের সুবিধার্থে ফ্যান লাগানো কিংবা বর্ধিতকরনের কাজ করানো। এমন মহৎ উদ্যোগের সঙ্গে থাকার চেষ্টা করতাম আব্বার উৎসাহে।
একদিন জানতে পারি বৈধ কাগজপত্রের কূলকিনারা করতে না পেরে কয়েস দেশে পরিবারের কাছে ফিরে গেছে। যেন বিকেল নামার আগেই ঘরের ছেলে ঘরে ফিরেছে। আব্বার মৃত্যুর পর পাড়া-প্রতিবেশির আর কোনো খবর পাই না। গত ৩০শে ডিসেম্বর হৃদক্রিয়া বন্ধ হয়ে কয়েসের মৃত্যু হয়। বন্ধুদের ফেসবুক পোস্টের ছবিতে দেখি, সাদা কাফনে ঢাকা কয়েসের শরীর। মুখের একাংশ খোলা। অনন্ত ঘুমে ঘুমিয়ে আছে সে। পাশে কবরের ছবি, যেখানে অন্তিম শয়নে শায়িত করা হয়েছে তাঁকে। যেন সমস্ত পৃথিবীর দিকে চোখ তুলে চেয়ে আছে বিষণ্ণ আঁধার, সদ্য মাটিচাপা দেয়া এক কবর। এই প্রথম আমি ধূসর কুয়াশার মাঝে শৈশব, কৈশোর খোঁজার মতো করে কয়েসের ফেসবুক আইডি খোঁজার চেষ্টা করি।
চেনা কেউ মরে গেলে, চিরতরে আড়াল হয়ে গেলে মনে হয় কেনো খোঁজ নেয়া হলনা! জীবনানন্দ দাশের কবিতার পঙক্তির মতো, ‘ যে জীবন ফড়িঙের দোয়েলের, মানুষের সাথে দেখা হয় নাকো তার…’। এই যে ফড়িং নামের অদ্ভুত সুন্দর সৃষ্টিকে প্রায়শই উড়ে বেড়াতে দেখি, অথচ তাদের জানা হয়না কোনদিনই। না জানার মাঝেই জীবন সমাপ্তিরেখা টেনে দেয়। তবুও জানা আর না জানার দোলাচল পেছনে ঠেলে আমরা তুমুলভাবে ভালোবাসি জীবন।
ডিসেম্বর এলে আমৃত্যু রুমিকে মনে পড়বে। কয়েসকে মনে পড়বে। ক্রমাগত আরও কাউকে। কিংবা কেউ আমাকে। তারপর একে একে সব বাতি নিভে গেলে পরে, আঁধারের দিকে পাশ ফিরে কাটিয়ে দিব অনন্তকাল।
রিমি রুম্মান
নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র
৬টি মন্তব্য
মোঃ মজিবর রহমান
জীবন বোধ! কে বা কাকে খবর রাখে? চোখের দূর হলে মনের আড়াল হয়, আর মৃত্যু জগত থেকে চিরোতরে মুছে দেয়।
এক আবেগীয় ও উপলদ্ধির বিষয় আপু।
তৌহিদ
কিছু চলে যাওয়াকে মেনে নেয়া কষ্টকর। আপনজন ওপারে হারিয়ে গেলে বুকটা হাহাকার করে ওঠে।
ভালো থাকুন সবসময় এটাই প্রার্থণা আপু।
সুপর্ণা ফাল্গুনী
এমন মৃত্যু মেনে নেয়া কঠিন আপু। অতি পরিচিত, অতি আপনজন বাস্তবতার চাপে আড়ালে চলে যায় তবুও মনে হয় আছে কোথাও না কোথাও কিন্তু যে পৃথিবী ছেড়ে চলে যায় তাকে আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। অনন্তকালেই হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে !! নিরন্তর শুভেচ্ছা ও শুভকামনা রইলো
সঞ্জয় মালাকার
প্রিয় জন চলে যাওয়াকে মেনে নেয়া কষ্টকর, তবু-
আপনজন ওপারে হারিয়ে গেলে বুকটা হাহাকার করে ওঠে।
শুভ কামনা রইলো দিদি।
আরজু মুক্তা
এভাবে অনেক স্বজন চলে যায়। কে বা কার খবর রাখে?
সাখাওয়াত হোসেন
মানুষকে একদিন না একদিন চলে যেতে হয়। এটাই স্বাভাবিক নিয়ম। প্রিয়জন চলে গেলে আমাদের কষ্টের শেষ থাকে না। তবু্ও মেনে নিতে হয় প্রকৃতির নিয়ম।