
বাড়িতে রাগারাগি করে একটু আগেই বেরিয়ে এসেছে অপু, আর কখনো ঘরে ফিরবেনা কিংবা এ মুখ কাউকে না দেখানোর একটা শপথ সে মনে মনে স্থীর করে ফেলেছে। করাটাই তো স্বাভাবিক।
স্নাতক শেষ করেছে তিন বছর হল, পরিচিত সবাইকে বিরক্ত করে ফেলেছে সে একটা চাকরীর জন্য, সবাই যেন তাকে আস্বাস ই দিয়ে গেছে, চাকরী কেউ দিতে পারেনি। নতুন কারো সাথে পরিচিত হলেই কিছুক্ষনের মধ্যে লাজ লজ্জা কিংবা শরম ভুলে গিয়ে চাকরী খুজে বসে ছেলেটা। মোটামোটি সব জায়গায় তার সিভি ড্রপ করা অাছে। অপুরা ভাই বোন চার জন। এক ভাই তিন বোন। বড় বোন বিবাহিত অার তার ছোট দুবোন। বাবা অবসরে অাসছে ৪ বছর আগে। এর ভেতর তিন বার স্ট্রোক করে ফেলছে। তার মা টাও যায় যায় অবস্থা। বোন দুটার বিয়ের বয়স হয়ে গেছে। সব মিলিয়ে চিন্তার শেষ নেই কারো।
এক সময়ে হাসি খুশি থাকা এ পরিবারটি এখন অনিশ্চিৎ ভবিষ্যতের প্রহর গুনছে বসে বসে। বাড়িতে কে কবে শেষ বার হেসেছিল কারোই মনে নেই।অপু তার বন্ধুদের সাথে বসে পাঁচ নাম্বার জয়েন্ট টা জ্বালিয়ে দিল। এটা একদম ই “র”। মিক্স বলতে কিছুই নেই। চুপচাপ বসে টানছে আর টানছে। মাঝে মাঝে বাবার অসুস্থতার কথা বলে হু হা করে কেঁদে ফেলে, অাবার টানে, চুপ থাকে কিছুক্ষন, অাবার পরিবারের কথা বলতে বলতে কেঁদে দেয়। আবার টানে, চুপ থাকে কিছুক্ষন, ছোট দুটা বোনের কথা বলতে বলতে কেঁদে দেয় অাবার, মুহুর্তেই কান্না থামিয়ে পরের টান…
অসুখে মরছে তার মা’টাও। ডাক্তার তো দেখাবেইনা, ঔষধও খাবেন না তিনি বলতে বলতেই ইয়া অাল্লাহ বলে চিৎকারে গলা ফাঠায়। এবার অার থামাতেই পারেনা কান্না। বন্ধুরাও কেঁদে ফেলে তার সাথে।অপুর শরীর ঝিমিয়ে আসছে, গান্জা তাকে চিবিয়ে খাচ্ছে প্রতিটা অঙ্গে প্রত্যঙ্গে কিংবা শিরা উপশিরাই। চোখ গুলো ছোট হয়ে আসছে, মাথার ওজন নিতে পারছেনা সে। দেহটা লুটিয়ে পরছে মাটিতে।
হঠাৎ বাড়ি থেকে ফোন, ছোট বোনের কাঁদো কাঁদো গলা। বাবার অবস্থা খুবি খারাপ। হাসপাতালে নিয়ে অাসছে। অপু যেন হাসপাতালে চলে যায়।
হাসপাতালটা বাড়ির কাছেই। গ্রামের হাসপাতাল..
চোখ মেলতে পারছেনা অপু, পারছেনা মাথাটা তুলতে। খুব কষ্ট করে উঠে বসে, তারপর দাড়িয়ে হেলে ধুলে হাসপাতালের দিকে রওনা হয়।ইতোমধ্যে তার বাবাকে হাসপাতালে নিয়ে আসে তার মা অার ছোট দুবোন। ডাক্তার নিয়ে দৌড়াদৌড়ি শুরু করে দেয় সবাই। নাকে অক্সিজেনের পাইপ লাগিয়ে দেয় ডাক্তার। কিছু ঔষধ লিখে দেয়, তার বন্ধুরা দৌড়ে গিয়ে নিয়ে অাসে সব ঔষধ। সিটের পাশেই দেয়ালে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে থাকে অপু। সবাই কাঁদছে, আল্লাহ আল্লাহ ধ্বনিতে মুখরিত পুরো হাসপাতাল। অপুকে ঠিক কি করতে হবে এ সময় তা তার জানা নেই। ঝিমিয়ে পরে একটা মুহুর্তের জন্য। কান্নার আওয়াজে অাবারো জেগে উঠে সে। চোখ খুলে তাকাতে পারছেনা। ভারী হয়ে আসছে মাথা। আবারো ঝিমিয়ে যায় অপু…
বাবা ছটপট করতে থাকে, এপাশ থেকে ওপাশ কিংবা সে পাশ…
হাত পা ছেড়ে টান টান করে রাখে। মাথাটা নাড়াতে থাকে খুব জোরে। কিছু বলতে চেয়েও যেন থেমে যায় বারবার। হয়ত খুব কাছ থেকে দেখছে মৃত্যুকে। ভাবছে হয়ত অনেক কিছুই। দুই মেয়ের বিয়ে, ছেলের একটা চাকরী, বউয়ের জন্য ঔষধ কিংবা পরিবারের শান্তি। সবকিছুই যেন মিছে, মৃত্যুটাই যেন সব। কেড়ে নিতে চাচ্ছে সবকিছু, বেচে থাকার অাকুল অাবেন সৃষ্টিকর্তার কাছে। হার মানতে চাইছেনা কিছুতেই। একটু বেচে থাকার মিথ্যে প্রচেষ্টা।অপু হেলান দিয়ে বসে পড়েছে মাটিতে। হাত দুটো দিয়ে চেপে ধরেছে মাথা। বমি করবে করবে ভাব। লাল চোখ, অপরিচিত কিছু মুখ, অজানা কিছু শব্দ, চোখ খুলে তাকানোর মিছে চেষ্টা অাবারো। মাথা ঘুরছে, ভেঙ্গে পড়ছে অাকাশটা, মাটির নিচটা ঘুরতে ঘুরতে তাকে ঢুকিয়ে ফেলার চেষ্টা করছে। হঠাৎ নড়েচড়ে বসে সে। হাত দিয়ে চেপে ধরে খাটের একটা কোনা। হঠাৎ মনে পরে তার বাবার কথা। মাথা তুলে তাকানোর চেষ্টা করে। ছোট বোন দুটা চিৎকার করে কাঁদছে তার বাবাকে ধরে। অপু ভাবতে থাকে, খুজতে থাকে তার ছোট বোনদের কান্নার কারন। অাবার মনে পড়ে তার বাবা অসুস্থ। হাসপাতালে ভর্তি। অপু উঠে দাড়ায়। তার বাবার পাশে গিয়ে বসে। মাথায় হাত বুলিয়ে বাবাকে ডাকে। বাবা কথা বলেনা। অাবারো ডাকে, বাবা চুপ।
মায়ের দিকে তাকাতেই দেখে মাটিতে লুটে পরেছে। ডাক্তার তার ভাষায় সরি বলে চলে গেছে কিছুক্ষন অাগে। ছোট বোন দুটো একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কাঁদে। অপু যেন কিছুই বুঝতে পারেনা। তার মায়ের কান্নার অাওয়াজে কাঁপছে পুরো হাসপাতাল। বন্ধুরা তার বাবাকে একটা সাদা চাদর দিয়ে ঢেকে দেয় পা থেকে মাথা পর্যন্ত। অপুর নেশা চলে যায় মুহুর্তেই..
ছোট বোনটা অপুকে জড়িয়ে ধরে ভাইয়া**** বলে চিৎকার দিয়ে বলে, বাবা নেই। লুটে পরে মাটিতে। মুহুর্তেই বেহুশ হয়ে যায় সে…
অপু তাকিয়ে থাকে। দাতে দাত রেখে চিবুতে থাকে থুতনি। ঠোট গুলো কাপছে খুব জোরে জোরে। ছোট বোন দুটাই বেহুশ। মা’য়েরও কোন সাড়া শব্দ নেই। অপু মাথা তুলে তাকায় তার বন্ধুদের দিকে। বন্ধুরা একে অপরকে ধরে কাঁদছে। অপু লাফিয়ে উঠে। হাসপাতাল থেকে দৌড়ে বের হয়ে অাসে ডাক্তারের রুমে। ডাক্তার মাথা নিচু করে বসে থাকে। অপু অাবার দৌড়ে সিটের কাছে অাসে। হাত দুটো উপরে তুলে লাফাতে থাকে অপু। বন্ধুরা জড়িয়ে ধরে রাখার বৃথা চেষ্টা করে অপুকে। অাজব এক শক্তির কাছে টিকছেনা কেউই…
অাবার দৌড়ে বাহিরে চলে যায়। যাকে দেখে তাকেই হাত ধরে বলে, আমার বাবা তো নেই। আমার বাবা নেই। আবার দৌড়ে রুমে ঢুকে যায়। একটানে চাদরটা ফেলে দেয় বাবার শরীর থেকে। বুকের উপর মাথা রেখে চুপ করে থাকে। অাবার বাবার মাথাটা ধরে নাড়াতে থাকে, এই বাবা, বাবা, এই বাবা, বাবারে, ও বাবা…
অপু পাগল হয়ে যায়। অাবার লাফাতে থাকে। ছোট বোনের জ্ঞান ফিরে অাসে। অপুকে ধরে রাখার চেষ্টা করে। অপু তার ছোট বোনের পায়ে পরে যায়, জড়িয়ে ধরে কোমল গলায় বলতে থাকে, আপুরে, ও আপু, তুই তো আমার ছোট বোন, আব্বুরে বল আমি চাকরী করবো, কিছু একটা অামি করবই। আমাদের কোন অভাব থাকবেনা। আম্মুরে ঔষধ কিনে দিব। তোদের বিয়ে দিব..
আব্বুরে উঠতে বলনা আপু…
এই আপু*****
এই কুত্তার বাচ্ছা, এই শুয়োরের বাচ্ছা…
আমার বাবারে উঠতে বল, কথা বলতে বল…
পা ছেড়ে উঠে দাড়ায় অপু, বাবাকে জড়িয়ে ধরে আবারো। এই বাবা উঠনা, উঠনা বাবা…
বাবা উঠনামোঃ মিজানুর রহমান সুমন
১৭টি মন্তব্য
অনন্য অর্ণব
জীবনের চিরাচরিত চিত্র ফুটে উঠেছে এই গল্পে। আমরা এমন একটি ভয়ানক খারাপ সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি, যেটা সমাজের এলিট শ্রেণী কখনোই অনুধাবন করতে পারে না। অনেক ভালো লাগলো গল্পটা। সত্যিই অসাধারণ লিখেছেন ভাই।
মোঃ মিজানুর রহমান সুমন
ধন্যবাদ দাদা, আপনার অনুপ্রেরণাই আমার ব্লগ পর্যন্ত আসা, দোয়া করবেন আমার জন্য
তৌহিদ
সোনেলায় স্বাগতম। সুন্দর একটি গল্প নিয়ে এলেন প্রথমেই।
ব্লগের নীতিমালা পড়ে নেবেন। আর হ্যা অন্যান্য লেখকের লেখায় নিজের মতামত দিন।
লেখার পারে লাল বর্ডারটি বেমানান লাগছে আমার কাছে। কোন নির্দিষ্ট অংশ কোট করতে এই বর্ডারটি কাজে লাগে, পুরো লেখা নয়।
লিখুন, নিজের মত করে।
মোঃ মিজানুর রহমান সুমন
দাদা, আমি এর আগে কখনো কোন ব্লগে লেখিনাই। যার কারনে ব্লগ সম্পর্কে আমার কোন আইডিয়া নাই। লাল বর্ডারটা কোত্তেকে আসছে বা কেন আসছে সেটাও জানিনা। তবে শিখে নিব আস্তে আস্তে সব ইনশা আল্লাহ।
অর্নব ভাই আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে ব্লগে লেখার জন্য। উনিই সবকিছু শিখিয়ে দিয়েছেন আমাকে।
তৌহিদ
বাপরে বলেন কি! অনেক সিনিয়র ব্লগাররাও জানেননা ওয়ার্ডপ্রেসে কিভাবে বর্ডার লাইন দিতে হয়!! আপনি তাহলে নবীন!!
গল্প ভালো লেগেছে ভাই। লিখুন।
মোঃ মিজানুর রহমান সুমন
নবীন বলতে একেবারেই নবীন…
দোয়া করবের ভাই, ধন্যবাদ
সুপর্ণা ফাল্গুনী
চমৎকার একটি গল্প পড়লাম। ধন্যবাদ ভাইয়া। সোনেলায় স্বাগতম। শুভ কামনা রইলো
মোঃ মিজানুর রহমান সুমন
ধন্যবাদ আপু, দোয়া করবেন আমার জন্য, যেন আপনাদের ভালো কিছু উপহার দিতে পারি সবসময়
সুপর্ণা ফাল্গুনী
অবশ্যই দোয়া রইল। ভালো থাকবেন
ফয়জুল মহী
চমৎকার । ধন্যবাদ আপনাকে। ভালো থাকুন l
মোঃ মিজানুর রহমান সুমন
ধন্যবাদ ভাইয়া
রেহানা বীথি
ভালো লিখলেন বেকার জীবনের হাহাকার।
মোঃ মিজানুর রহমান সুমন
ধন্যবাদ আপু…
আপনাদের অনুপ্রেরণা
সাবিনা ইয়াসমিন
গল্পটি কাল্পনিক হলেও আমাদের দেশের মধ্য বিত্ত/ নিন্মবিত্তে পরিবার গুলোর চিরাচরিত প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছে। এখানে একজন শিক্ষিত বেকার সন্তানের মানসিক অবস্থা,তার বিপথে চলার কারন সহ, তার আবেগ,আক্ষেপের সাথে তাকে প্রতিনিয়ত যে সংঘর্ষ করে যেতে হয় তা-ই সুন্দর ভাবে তুলে ধরেছেন। ভালো লাগলো গল্পটি।
সোনেলা ব্লগ পরিবারে আপনাকে সুস্বাগতম।
লিখুন নিজের খেয়াল খুশি মতন। আমাদের মাঝে আমাদের একজন হয়ে থাকুন।
শুভ কামনা 🌹🌹
মোঃ মিজানুর রহমান সুমন
আপনাকে ধন্যবাদ জানানোর মত ভাষা আমার জানা নেই…
দোয়া করবেন আপু আমার জন্য
যেন আপনাদের ই একজন হয়ে থাকি
সঞ্জয় মালাকার
অসাধারণ একটি গল্প পড়লাম,
শুভ কামনা দাদা ভালো থাকুন সব সময়।
মোঃ মিজানুর রহমান সুমন
ধন্যবাদ দোয়া