খেজুরের রস ও দু’টি পাখি

আবু জাকারিয়া ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৫, বুধবার, ০৪:০৫:৩৪অপরাহ্ন গল্প, সাহিত্য ১২ মন্তব্য

খেজুরের রস ও দুটি পাখি
___________________________________________
এক বনে একটা শালিক থাকত , নাম টিনি। টিনি থাকত একেবারে বনের ভিতরে, গভীরে। বন তার খুব প্রিয় যায়গা। আরেকটা প্রিয় যায়গা একটা বড় খেজুর গাছ, শীত কালে। খেজুর গাছটার নাম ও নিজেই রেখেছে, রসাটপটপ। রসাটপটপ শীতকালে মিষ্টি রস দেয়, টিনি বন থেকে উড়ে যায় রসাটপটপের কাছে, রস খেতে। খেজুরের রস খেতে খুব ভাল, আহা সারা বছর যদি এমন রস পাওয়া যেত! কিন্তু সারা বছর রসাটপটপ রস দিতে পারেনা। হয়ত রসাটপটপকে যে বানিয়েছে সে নিষেধ করে দিয়েছে সারা বছর ধরে রস দিতে। সারা বছর ধরে রস দিলে হয়ত রসের মজাই থাকত না।
বৃদ্ধ লোকটার জন্য মায়া হয় টিনির। অনেক বয়স হয়ে গিয়েছে, তারপরেও বেয়ে বেয়ে খেজুর গাছের মাথায় উঠে যায়, রস বের করবে বলে।
বৃদ্ধ লোকটার পা দুটি টিনির খুব পরিচিত, খেজুর গাছ বেয়ে ওঠার সময় থর থর করে কাপে। আর হাড়িগুলোও খুব পরিচিত। কারন রস খেতে হলে রসের হাড়ির উপর বসে নিতে হয়। তারপর চুমুক দিতে হয় রসের কাঠির উপর। রসের কাঠি বেয়েই রস হাড়িতে গিয়ে জমা হয়। কিন্তু হাড়িতে জমে থাকা রস খেতে পারেনা টিনি, কারন হাড়ির রস থাকে হাড়ির একদম নিচে, ঠোটের নাগালের বাইরে। তাই বলে টিনির একটুও আফসোস হয়না, কারন কাঠির উপর থেকে যে পরিমান রস পাওয়া যায়, তাতেই পেট ভরে যায় টিনির। রস খাওয়া শেষ হলে টিনি রসাটপটপের একটা ডালের উপর চুপ করে বসে থাকে, রোদ পোহাতে থাকে। বৃদ্ধ লোকটা আসে। গাছে উঠে একটা খালি হাড়ি রেখে গিয়ে রসে ভরা হাড়িটা নিয়ে চলে যায়। টিনি তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে থাকে বৃদ্ধ লোকটাকে। অথচ বৃদ্ধ লোকটা টিনিকে খেয়ালও করেনা। খেয়াল করার দরকার কি, রস নামাতে এসেছে, রস নামিয়ে চলে গেছে, এটাইতো তার কাজ।

টিনির একটা বন্ধু আছে, নাম টুনু। টুনু আবার রসাটপটপের কাছে আসেনা। ও যায় আরেকটা খেজুর গাছের কাছে, নাম দিয়েছে মিঠাই মিয়া। মিঠাই মিয়ার রস নাকি রসাটপটপের রসের থেকেও মিষ্টি। সে যাই হোক, টিনির কাছে রসাটপটপই ভাল।

"এই টুনু কোথায় যাচ্ছিস?" দেখেই জিজ্ঞেস করল টিনি।
টুনু বলে, এইতো মিঠাইমিয়ার কাছে যাচ্ছি, যাবি তুই?
টিনি বলে, না, আমি যাবনা। তুই যা।
টুনু বলে, আচ্ছা তুই রসাটপটপের কাছে থাকিস, আমি একটু পরেই চলে আসব।
টিনি বলে, আচ্ছা।

টুনু ফুরুত ফুরুত করে উড়ে চলে যায় মিঠাই মিয়ার উদ্দেশ্যে। টিনি তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে আর দুই ঠোট রস খেয়ে নেয়। টিনি মনে মনে বলে, আমার কাছে রসাটপটপই ভাল।

টুনু ফিরে আসে টিনির কাছে। টিনি বলে, আমার গাছের রস এক ঠোঁট খেয়ে দেখ টুনু, দারুন মজা পাবি।
টুনু বলে, তোর রসাটপটপের রস আমি খাব কেন? আমি আমার মিঠাইমিয়ার রস খেয়ে এসেছি। দেখছিসনা আমার পেট ভরা?
পালোকগুলো ফুলিয়ে দেখাল টুনু।

টিনি কিছুটা অভিমানের সুরে বলে, তাই বলে কি একটু খেয়েও দেখবি না?
টুনু বলে, কেন খাব, তুইকি আমার মিঠাইমিয়ার রস খেতে যাস?

টিনি আর টুনু দুজনে খেজুর গাছের ডালে বসেকিচির মিচির করে ঝগড়া করতে থাকে। কিছুক্ষন পর বৃদ্ধ লোকটা আসলে ওদের ঝগড়া থেমে যায়।
টিনি বলে, আয় অন্য গাছের ডালে গিয়ে বসি। গেছ ভাই এসেছে, তাকে ডিস্টার্ব করা যাবেনা।
টুনু বলে, চল ওই নারেকেল গাছটার মাথায় গিয়ে বসি।
টিনি আর টুনু নারেকেল গাছের মাথায় বসে রোদ পোহাতে থাকে আর গল্প করতে থাকে।
টিনি বলে, আচ্ছা তোর মিঠাইমিয়ার কাছে কি অন্য কোন গেছ ভাই যায়, নাকি এই গেছ ভাই?
টুনু বলে, নাতো, এই গেছো ভাই ই যায়।

দুইপাখি বৃদ্ধ লোকটাকে পর্যবেক্ষন করল কিছুক্ষন। বৃদ্ধ লোকটা বেয়ে বেয়ে গাছে উঠছে। তার পা দুইটা থর থর করে কাঁপছে। শীতের কারনে কাপছে নাকি বৃদ্ধ হয়ে যাওয়ার কারনে কাপছে বোঝা যাচ্ছেনা। গাছে উঠে রসের হাড়িটা দরিতে ঝুলিয়ে নিচে নামাল। তারপর একটা ধারাল দাও বের করল নিজের পিঠে ঝোলানো টোনার ভিতর থেকে। খুট খুট শব্দে কাটতে লাগল যেখান থেকে খেজুরের রস বের হয়। তারপর খালি হাড়িটা খেজুর গাছে
ঝুলিয়ে রেখে নিচে নেমে গেল। টুপটুপ করে নতুন, তবে আগের চেয়ে দ্রুত, খেজুরের রস পড়তে শুরু করল হাড়ির মধ্যে।
টিনি বলে, দেখেছিস গেছো ভাই কত বৃদ্ধ হয়ে গেছে গাছে উঠতে কত কষ্ট হয় তার?
টুনু বলে, কিন্তু আমাদেরতো একটুও কষ্ট হয়না, আমাদের পাখা আছে, ফুরুত করে উড়ে গাছের মাথায় চলে আসি।
টুনু বলে, আচ্ছা গেছো ভাইয়ের পাখা নেই কেন? পাখা থাকলেতো গাছে উঠতে এত কষ্ট হত না।
টিনি বলে ঠিক বলেছিস, পাখা থাকলে কি তার এত কষ্ট করে গাছে উঠতে হত। উড়তে উড়তে এসে গাছে উঠত, কোন কষ্টই হত না তার।
টুনু বলে, দেখেছিস আমাদের ভাগ্য কত ভাল যে আমাদের পাখা আছে, তাই উড়তে পারছি।
টিনি বলে, হ্যা। আর পাখা না থাকলে আমরা উড়তে পারতাম না। সেই সুযোগে গুই সাপ আর সাপেরা আমাদের ধরে ধরে খেয়ে ফেলত।
টুনু সূর্যের দিকে তাকাল। সূর্য তেতে উঠেছে ভীষন রকম।
টুনু বলে, চল বাড়ি চলে যাই।
টিনি বলে, একটু সময় দাড়া, আমি আরেকটু রস খেয়ে আসি।
টিনি হাড়িতে পা রেখে ঠোট বাড়িয়ে রস খেতে থাকে। টুনু অপেক্ষা করতে থাকে। রস খাওয়া শেষ হলে টিনি বলে, এবার চল বাড়ি যাই।
টুনু বলে, আমারও খুব রস খেতে ইচ্ছা করছে।
টিনি বলে, যা খেয়ে আয়, আমি অপেক্ষা করছি।
টুনু বলে, না আমি তোর রসটপটপ গাছের রস খাবনা, আমার মুখ তেতো হয়ে যাবে।
টিনি বলে, ঠিক আছে তাহলে তোর মিঠাইমিয়ার কাছে গিয়ে খেয়ে আয়, আমি অপেক্ষা করছি।
টুনু বলে, কিন্তু আমি একা যেতে পারবনা। তোরও সাথে যেতে হবে।
টিনি বলে, আচ্ছা চল যাই।
দুপাখি ফুরুত ফুরুত করে উড়ে চলে আসে মিঠাইমিয়ার কাছে। টিনি মিঠাইমিয়ার ডালে বসে অপেক্ষা করতে থাকে। আর টুনু মিঠাইমিয়ার রস খেতে থাকে।
টুনু বলে, একটু রস খেয়ে দেখবি নাকি টিনি?
টিনি বলে, না। তুই আমার রসটপটপের রস খেতে চাস না, আমি কেন তোর মিঠাইমিয়ার রস খাব?
টুনু বলে, আমার মিঠাইমিয়ার রস যে খুব মিষ্টি!
টিনি বলে, তবুও খাবনা। তুই যেদিন আমার রসটপটপের রস খাবি, সেদিন আমিও তোর মিঠাইমিয়ার রস খাব।
টুনু বলে, কিন্তু আমি তোর রসটপটপের রস খাবইনা। কারন রসটপটপের রস একটুও মিষ্টি লাগেনা। আমার মিঠাইমিয়ার রস দারুন মিষ্টি।
টিনি বলে, আমার রসটপটপের রস ও মিষ্টি, তুই খেয়ে দেখিসনি, তাই জানিস না।
টুনু বলে, আমি খাবনা।
টিনি বলে, আচ্ছা তোর খেতে হবে না, এবার বাড়ি চল।

দুইপাখি ফুরুত ফুরুত করে উড়তে থাকে জংগলের উদ্দেশ্যে।

পরের দিন দুপুরে বৃদ্ধ লোকটাকে দেখে চোঁখ আটকে যায় পাখি দুটির। খুরিয়ে খুরিয়ে লাঠি ভর করে হাটছে লোকটা। পাখি দুটি বুঝতে চেষ্টা করল, বৃদ্ধ লোকটার কি হয়েছে। হঠাৎ লাঠি ভর দিয়ে হাটছে কেন, তাহলে কি পায়ে ব্যাথা পেয়েছে? পায়ে ব্যাথা পাবে কিভাবে, গাছ থেকে পরে যায়নিতো! সাত পাঁচ ভেবে কিছু বুঝে উঠতে পারল না পাখি দুটি। ওদের লোকটাকে গিয়ে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা হচ্ছে, যে আপনার কি হয়েছে, খুড়িয়ে খুড়িয়ে লাঠি ভর দিয়ে হাটছেন কেন? আর এমন অবস্থায় আপনিতো গাছেও উঠতে পারবেন না।
কিন্তু মানুষতো পাখির ভাষা বোঝেনা!

এমনিতেই বৃদ্ধ মানুষ, গাছে উঠতে গেলে পা কাপে, তারপরে আবার পায়ে চোট লাগল। কিভাবে চোট লাগল?

পাখি দুটি উড়তে উড়তে চলে গেল খেজুর গাছের রস খেতে। টিনি আসল রসটপটপের কাছে আর টুনু আসল মিঠাইমিয়ার কাছে। দুটো গাছই রস শুন্য আর শুকনো।

(সমাপ্ত)

’’’*’''' ★''''

0 Shares

১২টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ