দ্রোহের আগুনে জ্বলি বার বার। উচ্চকিত হয়ে উঠে মুষ্টিবদ্ধ দু’হাত। নিমেষেই চোখ পড়ে মাঠির ওপর। দ্রোহের আগুন যায় নিভে। শিথিল হয়ে পড়ে মুষ্টিবদ্ধ হাত দু’খানি। চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। গড়িয়ে পড়ে অশ্রু। ফিরে যেতে হবে একদিন। নিশ্চিত এবং অবধারিত সেই মাটির ঘর। সেই মাটির বিছানায়। কেন আমরা বুঝেও বুঝিনা। মানুষ তুমি কেন করো এতো দম্ভ ? মানুষ তোমার কিসের এত অহংকার ? অহংকার তো শুধু মহান রাব্বুল আলামিনের পক্ষেই সাজে। বান্দার পক্ষে নয় মোটেও। তবুও মানুষ সমাজে অন্যায় অবিচারের শিকার হচ্ছে অহরহ। মিথ্যে দম্ভ অহংকার প্রভাব প্রতিপত্তি ক্ষমতা কতিপয় মানুষকে অন্ধ করে দিয়েছে। পরিণত করেছে মানুষ নামের অমানুষে।

আকাশের কান্না প্রকাশ্য বা দৃশ্যমান। পাশাপাশি কখনো বা তা তর্জন গর্জনসহ ধরণীকে করে সিক্ত। কখনো বা করে প্লাবিত। কিন্তু মানুষের সব কান্না প্রকাশ্য বা দৃশ্যমান নয়। এমন কিছু কান্না আছে যা শুধু নিজের মধ্যে সীমিত থাকে যা অন্যের কাছে প্রকাশ করা যায় না। প্রকাশ করা সম্ভবপরও হয় না। আপনজনেরা যখন কাঁদায় তখন তো কোনমতেই প্রকাশ করা যায় না। অপমান আর লাঞ্চনায় শুধু অব্যক্ত আর অদৃশ্য কান্না পকেটের রুমাল ভিজে যায়। ভিজে যায় বালিশ। শেষ হয়ে যায় টিস্যু বক্স। তবুও যেন শেষ নেই এই বোবা কান্নার।
মানুষের নিকট থেকে শ্রদ্ধা, স্নেহ-মমতা, মায়া, ভালবাসা, সরলতা, উদারতা, সততা, মনুষ্যত্ব, মানবিকতা, মহত্ত্ব, ভ্রাতৃত্ব, সৌহার্দ্য, নৈতিকতা, ধর্মীয় মূল্যবোধ ও অনুশাসন ক্রমশ লোপ পাচ্ছে। অর্থ-বিত্ত্ব বৈভবের অনাকাঙ্ক্ষিত প্রদর্শন, পরশ্রীকাতরতার, দাম্ভিকতা হিংস্রতা, বাহুবল উগ্র থেকে উগ্রতর হচ্ছে। রাজনৈতিক বা সামাজিক বা আর্থিক বা প্রশাসনিক বা অবৈধ আয়ের উৎসের প্রভাব প্রতিপত্তি নিয়ে ভূমি দস্যুতা, সন্ত্রাস, খুন, গুম, নারী শিশু ধর্ষণ বেড়ে যাচ্ছে সমাজে। আইনের যথাযথ প্রয়োগের অভাব বা বিচার হীনতার সংস্কৃতি, আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের কিছু কিছু ক্ষেত্রে সদিচ্ছার অভাব, কতিপয় সদস্যের নীতি নৈতিকতা, মানবিকতা বিবর্জিত কর্মকাণ্ড, রাজনৈতিক ও আর্থিক প্রভাবের কাছে নতজানু হওয়া, সংঘটিত ঘটনার তদন্তকারী কর্মকর্তার উদাসীনতা বা আইন সম্পর্কে সঠিক ধারণা না থাকা ইত্যাদি কারণে সামাজিক, মানবিক, ধর্মীয় অবক্ষয় বা অস্থিরতা বিরাজমান। আমাদের অনেকের মনে একটি ভ্রান্ত ধারণা জন্মে যে এই শক্তি ক্ষমতা দম্ভ থাকবে অনন্তকাল। আমাদের অনেকেরই জীবন যেন অমরণশীল। মরণের শরবত যেন পান করতে হবেনা কোনো দিনও। একটা প্রবাদ আছে — বাঘের বল বার বছর। বয়স বাড়ার সাথে সাথে শক্তিশালী বাঘের যৌবনের শক্তি যখন ক্ষয়ে যায় তখন বাঘের বল বা শক্তি কমে যায়। তখন তার শিকারের পেছনে দৌড়ানোর সেই ক্ষিপ্রতা, গতি, কৌশল ক্রমশ হ্রাস পায়। দিনে দিনে ক্ষয়ে যায় বল বা শক্তি। দিন কাটে তার অর্ধাহারে ,আনাহারে। একদিন বনে যে ছিল শক্তি, হিংস্রতা, ক্ষিপ্রতার মূর্ত প্রতীক সে হয়ে পড়ে অবহেলিত। যার সামনে দিয়ে পশু পাখীরা যেতে ভয় পেত সেই বুড়ো বাঘকে এখন পিঁপড়াও পাত্তা দেয়না। এটাই বাঘের নিয়তি ! হয়তবা বা মানবজাতিরও।

তথাপি করোনাভাইরাস অদৃশ্য, ছোঁয়াচে একটি রোগ।  এখন বাংলাদেশসহ সারা বিশ্ব দ্বিতীয় ঢেউ অতিক্রম করছে। কেউ জানে না কে কখন কিভাবে আক্রান্ত হবে। প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস যেন সবার ঘাড়ের ওপর নিঃশ্বাস ফেলছে এই বুঝি সংক্রমণ করে বসলো। তাই সবাই আতঙ্ক শঙ্কা উদ্বেগ উৎকণ্ঠা নিয়ে জীবন যাপন করছে প্রতিনিয়ত। মুসলমানেরা মহান আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামিনের দরবারে ক্ষমা চাইছেন, গুনাহ মাফ চাইছেন, নিরাপদ থাকার জন্য ইবাদত বন্দেগীতে ব্যস্ত রয়েছেন। পাশাপাশি অন্যান্য ধর্ম্যালম্বীরা নিজ নিজ ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান এবং প্রার্থনায় নিয়োজিত রয়েছেন। অনেক ব্যক্তি, পরিবার, সামাজিক প্রতিষ্ঠান, জন-প্রতিনিধি, ধনাঢ্য ব্যবসায়ী, গ্রুপ ও শিল্প প্রতিষ্ঠান, সমাজসেবী মানুষ, পুলিশসহ বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গরীব অসহায় দুঃখী দিনমজুর খেঁটে খাওয়া মানুষের মুখে দুই বেলা খাবার তুলে দেয়ার জন্য আপ্রাণ, প্রাণান্তকর চেষ্টা আর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।  প্রমাণ হচ্ছে, মানুষ মানুষের জন্য যা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের হারানো স্মৃতিকে মনে করিয়ে দিচ্ছে বার বার। কথায় বলে -- কয়লা ধুলে ময়লা যায়না। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, বৈশ্বিক এই মহা দুর্যোগের সময়, মহামারীর সময়, মানুষের বাঁচার জন্য আকুলতা ব্যাকুলতা প্রকাশে দেশের এই ক্রান্তিকালে দরিদ্র মানুষের চাল আত্মসাতের মতো অমানবিক , দুঃখজনক , মর্মান্তিক, মর্মন্তুদ ,নিষ্ঠুর, পাশবিক, দানবীয় উৎসব চলতে দেখেছি দেশের বিভিন্ন স্থানে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ত্রাণ বরাদ্দের সময় গরীব অসহায় দুঃখী মানুষের ত্রাণ নিয়ে ছিনিমিনি না খেলার জন্য কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছিলেন। আমরা বুঝিনা যেখানে আমাদের কারো জীবনের কোনো নিশ্চয়তা নেই।  না জানি কে কখন আক্রান্ত হয়ে পড়ি সেখানে এসব লোকগুলো কি উপাদান দিয়ে তৈরি? মনে প্রশ্ন জাগে এরা কি মানুষ ? তাঁদের মনুষ্যত্ববোধ, মানবতা, নৈতিকতা, ধর্মীয় বিশ্বাস ও অনুভূতি, মানুষের প্রতি সহানুভূতি,মমত্ববোধ,  দয়া, মায়া কর্পূরের মতো কোথায় উবে গেল ? যে বা যারা গরীবের ত্রাণ আত্মসাৎ বা চুরি করে যা অর্জন করবে তা ভোগ করার জন্য তাঁদের উত্তরাধিকারীদের কেউ কি আদৌ বেঁচে থাকবে কিনা সে গ্যারান্টি কোথায় ? যেখানে নিজের নিঃশ্বাসের বিশ্বাস নেই। ত্রাণ আত্মসাৎকারী এসব নরপিশাচ, পাষান্ড বর্বর বন্য জানোয়াররা কখনোই মানুষ হতে পারে না। এসব অমানুষদের এ পৃথিবীতে বেঁচে থাকার কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ আছে বলে মনে হয় না। তবুও এসব অমানুষদের সঙ্গেই আমাদের বসবাস। পাশাপাশি মানুষের ভেতরে আমি নামক এক পশুর বসবাস। সেই আমি আমাদেরকে আদিমতার দিকে, অসভ্যতার দিকে, হিংসা বিদ্ধেষ ও ঈর্ষার অশুভ দিকে, অমানবিকতার দিকে, প্রচণ্ড ও নীতি নৈতিকতাহীন অর্থ লোলুপতার দিকে, পশুত্বের দিকে, ধর্মের বিপক্ষে টেনে নিয়ে যায়। তবে সবার ভেতর যে এই পশুবৃত্তি কাজ করে তা নয়। বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে নফসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হয়, কেউ বিজয়ী হয় কেউবা পরাজিত হয়। যতক্ষণ না আমাদের ভেতরকার আমিকে নিয়ন্ত্রণ বা কব্জা করতে না পারবো ততক্ষণ পর্যন্ত মনুষ্যত্ব বিপর্যস্ত হয়ে থাকবে যা একটি সুন্দর সমাজ বিনির্মাণের স্বপ্ন আজীবন স্বপ্ন হয়েই থাকবে। আসুন না আমরা নিজেরা নিজেদের ঢোল বাজানো বন্ধ করি। আমাদের ভেতরকার পশুত্বকে কুরবানী করি এবং নফসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নিজেদেরকে বিজয়ী করি একটা সুখী সুন্দর নিরাপদ নারী শিশু ধর্ষণ ও নির্যাতন মুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে। মনুষ্যত্বের জয় হোক মানুষের ভেতরের আমিত্ব আর পশুত্বের পরাজয় হোক।

0 Shares

১৪টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ