মাহবুবুল আলম//

পাকিস্তানের শিষ্টাচার বহির্ভূত নানা অপতৎপরতার কারণে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে বিদ্যমান কুটনৈতিক সম্পর্ক দিন দিন শিথিল থেকে শিথিলতর হচ্ছে। পাকিস্তান দূতাবাস কর্মকর্তাদের বাংলাদেশবিরোধী বিভিন্ন কার্যক্রমে জড়িয়ে পড়া, জঙ্গিদের মদদ দেয়া, ভারতীয় জাল নোট ছাপিয়ে ও অস্ত্রশস্র দিয়ে ভাতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীর উস্কে দিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বর্তমান সুসম্পর্কে ফাটল ধরানোসহ নানা অভিযোগে অভিযুক্ত পাকিস্তান দূতাবাস। এমতাবস্থায় পাকিস্তানের সাথে কুটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্নের দাবি জোরালো হচ্ছে প্রতিনিয়ত। তবে একথা ঠিক পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক কোনদিনই মধুর ছিল না এ কথা আমরা সবাই জানি ও মানি।

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানের চরম পরাজয়ের পর কিছুতেই স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যূদ্বয়কে মেনে নিতে পারেনি পাকিস্তান। তাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের পর থেকে বাংলাদেশবিরোধী  বিভিন্ন কর্মকান্ডে জড়িয়ে পরে দেশটি। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অপতৎপরতার অংশ হিসেবে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাংলাদেশের স্বাধীনতার মহানায়ক বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে প্রথম প্রতিশোধ নেয় পাকিস্তানী গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই। তারা স্বাধীনতা ও আওয়ামীলীগ বিরোধীদের সাথে ষড়যন্ত্র করে যে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছিল তা আজ বিভিন্ন ঐতিহাসিক দলিলে প্রমাণিত। সেই থেকে আওয়ামী লীগ সরকার যখনই ক্ষমতায় থাকে তখনই আইএসআই তাদের এদেশীয় দোসরদের ছত্রছায়ায় তৎপর হয়ে ওঠে। কেননা, তারা চায়না স্বাধীতা ও মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী আওয়ামীলীগ বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষতায় আসুক বা থাকুক। তাই তারা বার বার চেষ্টা করেছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনাকে হত্যার। যার বড় প্রমাণ ২০০৪ সালে একুশে আগস্ট তৎকালীন বিরোধী দলীয় নের্তৃ শেখ হাসিনার সন্ত্রাসবিরোধী জনসভায় ভয়াভহ গ্রেনেড হামলা। সেই ভয়াভহ গ্রেনেড হামলায় ভাগ্যজোরে শেখ হাসিনা বেঁচে গেলে আওয়ামী লীগের ত্যাগী নেত্রী আইভি রহমানসহ বিভিন্নস্তরের ২৩ জন নেতাকর্মী নিহত হয়েছিল। সেই হত্যাকান্ডে যে পাকিস্তান গোয়েন্দাসংস্থা আইএসআই তৎকালীন বিএনপি সরকারের প্রচ্ছন্ন মদদে এ হামলা চালিয়েছিল তা গ্রেনেড হামলায় ব্যবহৃত পাকিস্তানী তৈরি আর্জেস গ্রেনেড সরবরাহের নানা নমুনা পরীক্ষা বাংলাদেশের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার তদন্ত প্রতিবেদনে বেরিয়ে এসেছে।

এ ছাড়াও ১৯৭১ সালে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এদেশীয় কোলাবেরটর রাজাকার আল-বদর, আল-সামশ কতৃক সংগঠিত মানবতা বিরোধী অপরাধের জন্য ঠ্রাইব্যুনালে বিচারিক কর্যক্রম শুরুর পর থেকেই যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষাবলম্ভন করে পাকিস্তানের বক্তব্য বিবৃতি সর্বোপরি কুখ্যাত রাজাকার আলী আহসান মুজাহিদ ও সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ফাঁসির রায় কার্যকরের পর পাকিস্তানের জাতীয় সংসদে নিন্দাপ্রস্তাব পাশ এবং এই দুই কুখ্যাত রাজাকারকে পাকিস্তান তাদের বন্ধু বলে যে বক্তব্য বিবৃতি দেয়। যুদ্ধাপরাধে দণ্ডিত সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের ফাঁসি কার্যকর হওয়ার পর পাকিস্তান সব শিষ্টাচার ভুলে গিয়ে দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বিবৃতি দিয়ে এই বিচারের বিরোধিতা করে। পাকিস্তান যুদ্ধাপরাধের বিচারকে ‘দুর্ভাগ্যজনক’ ও ‘বিরক্তিকর’ বলে উল্লেখ করে। তারা এই বিচারকে ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্পাদিত ত্রিদেশীয় চুক্তির চেতনা পরিপন্থী বলে মন্তব্য করে। এ ঘটনায় বাংলাদেশের পক্ষ থেকে গত ২৩ নভেম্বর ঢাকায় নিযুক্ত পাকিস্তানের হাইকমিশনার সুজা আলমকে তলব করে তার কড়া প্রতিবাদ জানানো হয়।  এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, পাকিস্তানের এহেন মন্তব্য বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নির্লজ্জ হস্তক্ষেপ। পাকিস্তান ১৯৭৪ সালের ত্রিপক্ষীয় চুক্তিকে বিকৃত করেছে বলে উল্লেখ করে বাংলাদেশ বলেছে, ত্রিপক্ষীয় চুক্তি মোতাবেক, গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার করার ক্ষেত্রে কোনো বাধা নেই।

এ প্রেক্ষিতে পাকিস্তানের সাথে কুটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করার দাবি জোড়ালো হচ্ছে। পাকিস্তানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করার দাবি করেছে সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম, গণজাগরণ মঞ্চসহ বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সংগঠন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যা, নির্বিচারে ধ্বংসযজ্ঞ ও অগণিত নির্যাতনের দায় অস্বীকার করা পাকিস্তানের আরেক ঐতিহাসিক পাপ বলে মন্তব্য করেছেন সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম-মুক্তিযুদ্ধ ’৭১-এর মহাসচিব হারুন হাবিব। তিনি বলেন, বাংলাদেশে গণহত্যা ও বর্বরতার দায় অস্বীকার করে পাকিস্তান এটিই আবারও প্রমাণ করেছে যে, দেশটি ইতিহাস থেকে আজও কোনো শিক্ষা গ্রহণ করেনি। পাকিস্তান সরকারের এ ধরনের বিবৃতি ইতিহাসের চরম বিবৃতি শুধু নয়, একই সঙ্গে নির্লজ্জ মিথ্যাচারের শামিল। তিনি আরও বলেন, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে হানাদার পাকিস্তান বাহিনী ও তাদের স্থানীয় সহযোগীরা যে বর্বরতা চালিয়েছে, পাকিস্তান সরকার অস্বীকার কলেও তা সারা বিশ্বেই বিংশ শতাব্দীর নিকৃষ্টতম গণহত্যা ও নারী নির্যাতন হিসেবে স্বীকৃত ও গ্রন্থিত। এমনকি পরবর্তীতে সরকার কর্তৃক নিয়োজিত হামদুর রহমান কমিশনের রিপোর্টেও এ ভয়াবহ গণহত্যার দায় স্বীকার করা হয়েছে এবং দোষী সামরিক ব্যক্তিদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাবার সুপারিশ করা হয়েছে। কিন্তু পাকিস্তান সে বিচার করেনি। ফোরাম মহাসচিব বলেন, পাকিস্তানের বিবৃতিতে এটিই প্রমাণ করে যে, ৪৪ বছর পরও বাংলাদেশের স্বাধীন-সার্বভৌম অস্তিত্ব মেনে নিতে ব্যর্থ হয়েছে পাকিস্তান। কাজেই এমন একটি দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক রাখার কোনো যৌক্তিকতা থাকতে পারে না।

পাকিস্তানে নিযুক্ত বাংলাদেশের কাউন্সিলর মৌসুমী রহমানকে ডেকে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশে গণহত্যায় পাকিস্তানের দায় অস্বীকার করার তীব্র সমালোচনা করেছে গণজাগরণ মঞ্চ। সংগঠনটির এক বিবৃতিতে সরকারের কাছে দাবি জানিয়ে বলা হয়, ‘একাত্তরে গণহত্যার দায় স্বীকার করে ক্ষমা প্রার্থনা এবং ক্ষতিপূরণ প্রদানের পূর্ব পর্যন্ত পাকিস্তানের সঙ্গে সব ধরনের কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থগিত করে দেয়া হোক’। পাকিস্তানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্নের দাবি জানিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক। পাশাপাশি সার্ক ও জাতিসংঘ থেকে পাকিস্তানের সদস্যপদ বাতিলে সম্মিলিত উদ্যোগ গ্রহণেরও আহ্বান জানান তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে পাকিস্তানের কোনো সম্পর্ক থাকবে না বলেও ঘোষণা দেন ভিসি।  একটি রাষ্ট্র যখন আরেকটি রাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক মূল্যায়নের কথা বলে কূটনীতির ভাষায় তার কী অর্থ এ প্রসঙ্গে বিবিসি বাংলার সাথে কূটনৈতিক বিশ্লেষক ড.আব্দুর রব খান  বলেন, বাংলাদেশ মনে করে যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে পাকিস্তান বেশি রিএ্যাক্ট করেছে। যেটা অনেকটা কূটনীতিক শিষ্টাচারের বাইরে চলে গেছে। সাম্প্রতিক সময়ে সরকারের উপরে যথেষ্ট চাপও ছিল, চাপ এখনও রয়েছে পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করার ব্যাপারে। অনেকে মনে করে পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক রাখার কী মানে আছে যখন পাকিস্তান এমন অবন্ধুসুলভ আচরণ করছে। আমি নিশ্চিত না কতখানি এটা কথার পরিপ্রেক্ষিতে এসেছে আর কতখানি মিন করেছে। যখন পররাষ্ট্রমন্ত্রী বা মন্ত্রিসভার ঊর্দ্ধতন সদস্যরা বলেন আমরা সম্পর্কের পুনমূল্যায়ন করছি সেটা দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি হয়েছে সেটার ইঙ্গিত দেয়। বিশেষ করে সাম্প্রতিক ঘটনাগুলির প্রেক্ষাপটে বলা যায় দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি হয়েছে বা হচ্ছে।

ইদানিং লক্ষ করা যাচ্ছে যে, ঢাকা থেকে পাকিস্তানের কোন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ করলে, পাকিস্তানও ইসলামাবাদে বাংলাদেশ হাইকমিশনের কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ভিত্তিহীন অভিযোগ তুলছে। আবার ঢাকার পাকিস্তানের কোন কর্মকর্তাকে বাংলাদেশ বহিষ্কার করলে, পাকিস্তানও ইসলামাবাদের বাংলাদেশ হাইকমিশনের সম পদের কর্মকর্তাকে বহিষ্কার করছে। এছাড়া ঢাকার পাকিস্তানের হাইকমিশনারকে তলব করলে পাল্টা ব্যবস্থাস্বরূপ ইসলামাবাদে বাংলাদেশের হাইকমিশনারকে তলব করা হচ্ছে। সর্বশেষ সোমবার ঢাকার পাকিস্তান হাইকমিশনের প্রেস বিভাগের এক কর্মকর্তাকে আটকের পর ইসলামাবাদের বাংলাদেশ হাইকমিশনের প্রেস বিভাগের এক কর্মকর্তা সাত ঘণ্টা নিখোঁজ হন।

বাংলাদেশী কূটনীতিক মৌসুমী রহমানকে পাকিস্তান থেকে বহিষ্কারের পর ইসলামাবাদ ও করাচীর বাংলাদেশ মিশনের কূটনীতিকদের বিরুদ্ধে দেশটি ষড়যন্ত্র শুরু করে। বাংলাদেশী কূটনীতিকদের বিরুদ্ধে অপরাধ খোঁজার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে পাকিস্তান। সে কারণে বাংলাদেশের ওই দুই মিশনের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে গোয়েন্দা কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়া হয়। বাংলাদেশের কূটনীতিকরা যেখানেই যান সেখানেই তাদের পিছে পিছে গোয়েন্দাদের গাড়ি যাচ্ছে। আবার বাংলাদেশী কূটনীতিকদের বাড়ির আশপাশেও গোয়েন্দা নজরদারি বাড়িয়েছে পাকিস্তান। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে ইতোমধ্যেই পাকিস্তানের কাছে কড়া প্রতিবাদ জানানো হয়েছে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, পাকিস্তান ভিয়েনা কনভেনশন লঙ্ঘন করছে। ইসলামাবাদ ও করাচীর মিশনে গোয়েন্দাদের মাধ্যমে বাংলাদেশের কূটনীতিকদের হয়রানি করা হচ্ছে। কোনভাবেই যেন বাংলাদেশের কূটনীতিকদের হয়রানি না করা হয়, সে বিষয়ে পাকিস্তানকে সতর্ক করে দেয়া হয়। তবে পাকিস্তান এ বিষয়ে কোন ইতিবাচক পদক্ষেপ নেয়নি। সব মিলিয়ে দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক এখন চরম বিরূপ অবস্থানে।

মুক্তিযুদ্ধ ইস্যুতে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কে টানাপোড়েন এটাই প্রথম নয়। ইতিপূর্বে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় যাওয়ার পর মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করায় পাকিস্তানের তৎকালীন ডেপুটি হাইকমিশনার ইরফান রাজাকে বাংলাদেশ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। কাদের মোল্লার ফাঁসির পর পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়ার পরিপ্রেক্ষিতে দেশটির সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার দাবি উঠেছিল। উচ্চতর রাজনৈতিক পর্যায় থেকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওপর চাপও সৃষ্টি করা হয় সম্পর্ক ছিন্ন করার। তখন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ইতিপূর্বে পাকিস্তানে যেসব কূটনীতিক দায়িত্ব পালন করেছেন তাদের নিয়ে  বৈঠকে বসে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ওই বৈঠকে উপস্থিত প্রায় সবাই পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক বহাল রাখার পক্ষে মত দিয়েছিলেন। এ মতামত উচ্চতর রাজনৈতিক পর্যায়ে জানানোর পর ওই সময়ে সম্পর্ক ছিন্ন করা থেকে বিরত থাকে বাংলাদেশ।

এবার পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়ার পর পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেছিলেন, ‘পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার জন্য তরুণ প্রজন্ম যে দাবি তুলছে সেই অনুভূতি বুঝতে পারি। কিন্তু কোনো একটি ইস্যুতে কোনো দেশের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করা ঠিক নয়।’ তিনি বলেন, যখন দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধ চলে, তখনও সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক বহাল থাকে। আর পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী মঙ্গলবার জানিয়েছেন, পাকিস্তান বরাবরই হতাশ করছে। তবে পাকিস্তানের সঙ্গে কূটনৈতিক টানাপোড়েন চললেও এখনই বাংলাদেশ সম্পর্ক ছিন্ন করছে না। এদিকে ইসলামাবাদে বাংলাদেশ হাইকমিশনের কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর হোসেন প্রায় সাত ঘণ্টা নিখোঁজ থাকার ঘটনায় ঢাকায় পাকিস্তানের হাইকমিশনার সুজা আলমকে তলব করেছে সরকার।

সম্প্রতি ঢাকায় পাকিস্তান হাইকমিশনের এক কর্মকর্তার সন্দেহজনক গতিবিধির কারণে পুলিশের হাতে আটক হওয়ার পরপরই ইসলামাবাদে জাহাঙ্গীরের নিখোঁজ হওয়ার খবর পাওয়া যায়। পাকিস্তান দূতাবাসের প্রেস সেকশনের এ্যাসিসটেন্ট প্রাইভেট সেক্রেটারি আবরার আহমেদ খানকে সোমবার দুপুরে গোয়েন্দা পুলিশ ধরে নেয়ার পর সন্ধ্যায় হাইকমিশনের কর্মকর্তাদের জিম্মায় ছেড়ে দেয়। তার কাছে অবৈধভাবে রাখা ভারতীয় রুপী পাওয়া গিয়েছিল বলে পুলিশ দাবি করলেও তা প্রত্যাখ্যান করে পাকিস্তান হাইকমিশন এই ঘটনার নিন্দা জানায়।

সোমবার রাতে ঢাকার পাকিস্তান হাইকমিশন থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয়, এই ঘটনাকে হয়রানি হিসেবেই দেখছে পাকিস্তান হাইকমিশন। অপবাদ ও মিডিয়া ট্রায়ালের পরিপ্রেক্ষিতে পাকিস্তান হাইকমিশনের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের এভাবে হেনস্থা করার এই ধরনটি দেখা যাচ্ছে। ২০১১ সাল থেকে আবরার আহমেদ ঢাকায় পাকিস্তান দূতাবাসের প্রেস সেকশনে কর্মরত রয়েছেন বলে জানায় পাকিস্তান হাইকমিশন।

এর আগেও ৩০ নবেম্বর ইসলামাবাদে নিযুক্ত বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনার মৌসুমী রহমানকে তলব করে পাকিস্তান সরকার। তাকে তলবের পর ১৯৭১ সালের হত্যাকান্ড সম্পৃক্ততার অভিযোগ অস্বীকার করে পাকিস্তান। তলব ও পাল্টা তলব নিয়ে দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কে নতুন করে টানাপোড়েন শুরু হয়। এরই মধ্যে গত ২৩ ডিসেম্বর ঢাকা থেকে পাকিস্তানের কূটনীতিক ফারিনা আরশাদকে বহিষ্কার করে বাংলাদেশ। ফারিনা আরশাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্টভাবে জঙ্গী তৎপরতার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ দেয় বাংলাদেশ। তাকে বাংলাদেশ থেকে বহিষ্কার করা হয়। তারই পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে ইসলামাবাদ থেকে বাংলাদেশের কূটনীতিক মৌসুমী রহমানকে বহিষ্কার করে পাকিস্তান। দুই দেশের পাল্টাপাল্টি বক্তব্য, তলব পাল্টা তলব, বহিষ্কার পাল্টা বহিষ্কারের পর সোমবার ঢাকা ও ইসলামাবাদে দূতাবাস কর্মকর্তাদের নিয়ে সর্বশেষ ওই ঘটনা ঘটে।
এই তিক্ত সম্পর্কের কারণেই হয়তো ৩০-৩১ জানুয়ারি ঢাকায় দক্ষিণ এশীয় স্পীকার সম্মেলনে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর জাতীয় সংসদের সকল স্পীকার যোগ দিলেও পাকিস্তানের উচ্চকক্ষ সিনেটের সভাপতি মিয়া রাজা রাব্বানী এই সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেননি। এছাড়া গত ১৩-১৪ জানুয়ারি ঢাকায় দক্ষিণ এশীয় পয়ঃনিষ্কাষণ সম্মেলনে সকল দক্ষিণ এশিয়ার সকল দেশকে অংশগ্রহণের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। তবে ওই সম্মেলনে দক্ষিণ এশিয়ার সকল দেশ আসলেও পাকিস্তান অংশগ্রহণ করেননি। সে সময় পাকিস্তান জানিয়েছিল, তারা ৬০ সদস্যের প্রতিনিধি দল নিয়ে ঢাকায় আসবে। তবে শেষ পর্যন্ত পাকিস্তান ওই সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেননি। পাকিস্তানের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছিল, বাংলাদেশ তাদের প্রতিনিধি দলকে ভিসা দেয়নি। অবশ্য বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সে অভিযোগ অস্বীকার করা হয়। ফলে দুই দেশের মধ্যে টানাপোড়েনের বিষয়টি খুব স্পষ্ট হয়ে উঠে।

এমতাবস্থায় দুই দেশের মধ্যে কুটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করার বিষয়ে যে দাবি ওঠেছে। দেশের ছাত্র, শিক্ষক পেশাজীবী ও বুদ্ধিজীবীদের মত হচ্ছে পাকিস্তান বাংলাদেশের সাথে বারবার যে শিষ্টাচার বহির্ভূত কাজ করে আসছে এর প্রেক্ষিতে অচিরেই পাকিস্তানের সাথে কুটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করা হোক। কিন্তু দেশের সাবেক কুটনীতিকদের মত হচ্ছে এখনই পাকিস্তানের সাথে কুটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করা ঠিক হবে না। কেননা, তাদের সাথে কুটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করা হলে বিশ্বের দরবারে পাকিস্তানের মুখোশ উন্মোচন করা কঠিন হয়ে পড়বে। তাদের মতে পাকিস্তানের সাথে পুরোপুরি কুনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন না করে সম্পর্ক সীমিত করা যেতে পারে। এসব মতামত যৌক্তিক মনে হলেও এর শেষ পরিনতি কোথায় গিয়ে ঠেকবে তা নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারছেন না। পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের কুটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্নের পক্ষে বিপক্ষে যা ই বলা হোক না কেন, দুই দেশের সম্পর্ক দিন দিন যেভাবে অবনতির দিকে যাচ্ছে তা অব্যাহত থাকলে জোর করে আর কতদিন সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা যাবে তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ রয়েছে।

 

 

0 Shares

৩টি মন্তব্য

  • জিসান শা ইকরাম

    পাকিস্তানের সঙ্গে সব ধরনের কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিন্ন করে দেয়া উচিৎ।
    বিশ্ব রাজনীতি এবং অর্থনীতিতে পাকিস্থান এমন কোন ফ্যাক্টর নয় যে তার সাথে সম্পর্ক রাখতেই হবে
    অর্থনীতি সহ বেশ কিছু বিষয়ে আমাদের দেশ পাকিস্থানের তুলনায় অনেক অগ্রগামী
    পাকিস্থানকে চির শত্রু দেশ হিসেবে ঘোষনা করা উচিৎ।

  • পারভীন সুলতানা

    না , আমি বলব যতদুর পারা জায় সম্পর্কতা বাংলাদেশের পক্ষ থেকে টিকিয়ে রাখাই ভাল। বিশ্ব অঙ্গনে বাংলাদেশের ভদ্র সহনশীল ইমেজের অনেক মুল্য রয়েছে। তাছাড়া পাকিস্তানের কাছে আমাদের অনেক পাওনা। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পর যদি রাজাকারদের বিচার হতে পারে তবে কেন কোনদিন বিশ্ব সভায় আমাদের দেনাপাওনা নিয়ে বিচার হবে না ? হতেই পারে। দানব পাকিস্তান ধ্বংসের খেলায় সিদ্ধ, না হয় তাই হউক তাদের আন্তর্জাতিক পরিচয়। কিছু করলে ওরাই করুক , আমরা প্রমাণ ধরে রাখছি।

  • শুভ মালাকার

    * পাপীকে তার পাপের দন্ড পেতেই হবে, সে যেখানেই আর যেভাবেই থাকুক না কেন!

    ** কোনো-কোনো সময় অসহনশীলতাকেও স্বীকৃতি দিতে হয়, ঘাতককে পুর্নমাত্রায় চিহ্ন করার জন্য। আমাদেরও তাই করা প্রয়োজন মনে করি।

    *** কোনো পশুকে যখন-ই শিকাড় করতে হয়, তখন-ই ঐ পশুকে তার মত করে আওতার মধ্যে আনতে হয় যাতে করে তাকে শিকার করতে সহজ হয়।

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ