ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগের ভর্তি পরীক্ষায় মাত্র দু’জন ছাত্র উত্তীর্ন হয়েছে। প্রথম যেদিন কথাটা শোনা হয়, মনে হয়েছিল মাত্র দু’জন! এটা কীভাবে সম্ভব? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি পড়ার মতো এই মাত্র দু’জন ছাড়া কী সারা দেশে আর কোন ছাত্র ছিলনা! শিক্ষার মান দেশে কমে গেছে বলে একটি কথা প্রচলিত বটে, কিন্তু তার মানে কী এ-ই যে, মাত্র দু’জন? বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ দোষ দিচ্ছে প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার, আর মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীর বিভিন্ন বক্তব্য হতে যা জানা যায়, তার সার কথা হচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ প্রশ্নপত্র তৈরী করেছে অত্যন্ত শক্তভাবে, যেজন্য শিক্ষার্থীরা উত্তীর্ন হতে পারছেনা। বিষয়টা আসলে গভীর চিন্তারই দাবীদার।
আমাদের দেশে জিপিএ-প্রথা চালু হয় ২০০১ সালে। তার আগে নম্বর-প্রথা চালু ছিল। জিপিএ-প্রথা চালুর পর থেকে এবং শিক্ষার্থীর সংখ্যা ধীরে ধীরে বেড়ে যাওয়ার কারনে প্রতিযোগিতা অনেক বেড়ে গেছে। শিক্ষার্থীরা বিগত কয়েক বছর ধরে অনেক পড়াশুনা করে, কোচিং ইত্যাদিতে অনেক পরিশ্রম করে। পাবলিক পরীক্ষাগুলোতে এমসিকিউ ধরনের প্রশ্ন থাকে প্রায় অর্ধেক। কিছুটা পরিশ্রম যারা করে, তাদের পক্ষে এই ধারার প্রশ্নে নম্বর ওঠানো খুব একটা কঠিন নয়। আর সৃজনশীল টাইপের প্রশ্ন, সব মিলিয়ে ৮০% নম্বর পাওয়া একটু পরিশ্রমী শিক্ষার্থীদের পক্ষে খুব কঠিন নয়। আগেকার আমলের মতো ব্যাখ্যা-জাতীয় প্রশ্ন ইদানিং কম হয়। এজন্য জিপিএ-৫ এর ছড়াছড়ি আজকাল।
তাই বলে শিক্ষার্থীদের মান কমে যাচ্ছে বলে যে-কথা প্রচলিত, তা বোধহয় সঠিক নয়। এমসিকিউ-ধরনের প্রশ্নের উত্তর দিতে কি মেধা লাগেনা? অনেকে বলেন, ব্যাখ্যা-জাতীয় প্রশ্ন থাকলে শিক্ষার্থীদের উদ্ভাবনী-শক্তির, জ্ঞানের পরিচয় মিলতো। কথাটা একেবারে অমূলক নয়। একটা বিষয়কে সঠিকভাবে বিশ্লেষন করতে পারাটা আলাদা একটি গুন। শুধু পরীক্ষা-ই নয়, জীবনের সকল ক্ষেত্রেই এটা প্রযোজ্য।
এইচএসসি লেভেল পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের বয়স আর কতই! ওই বয়স পর্যন্ত কতই আর শিখবে ওরা! বরং ওই লেভেলের পরই ওদের আসল শিক্ষা শুরু হওয়ার কথা, জীবনের শিক্ষা। কতটুকু হয় সেগুলো? না হওয়ার কারনগুলো কী কী? বরং সেগুলোই আমরা ভেবে দেখব।
দেশের স্কুল-কলেজগুলোতে শিক্ষক নিয়োগের দিকে যদি আমরা তাকাই, দেখা যাবে অধিকাংশ নিয়োগই হয় অসৎ পন্থায়। এতে প্রচুর সমস্যার সৃষ্টি হয়। মেধাসম্পন্ন শিক্ষক প্রায়শঃই নিয়োগ পাননা। যে শিক্ষক অবৈধ পন্থায় নিয়োগ পান, তার সেরকম কোন দায়বদ্ধতা থাকেনা শিক্ষা প্রদানের ক্ষেত্রে। পাবলিক পরীক্ষার খাতা মূল্যায়নের ক্ষেত্রেও কম মেধার কারনে হোক অথবা গা-ছাড়া-দেওয়া ভাবের কারনে হোক সঠিকভাবে খাতাগুলি মুল্যায়িত হয়না। আর শিক্ষকদের বেতনও অত্যন্ত কম, জীবিকা নির্বাহের জন্য তা অতিমাত্রায়ই অপ্রতূল। এতে করে শিক্ষকদের শিক্ষাদানে উৎসাহ অনেক অবদমিত হয়ে যায়। সংসার চালানোর জন্য দু;শ্চিন্তা করবে না পড়াবে, সোজাভাবে বললে এটাই বাস্তব।
এসমস্ত বাস্তবতা সত্ত্বেও ছেলেমেয়েরা সকল প্রকার বাধা-বিপত্তি উপেক্ষা করেও এগিয়ে যাচ্ছে শিক্ষকদের অবদানের সাথে সাথে নিজেদের কষ্টকর পড়াশোনার মাধ্যমে। তদুপরি যদি তাদের মান নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়, তবে তারা হতাশ হয়, অপমানিত বোধ করে। অথচ সুযোগ পেলে আমাদের শিক্ষার্থীরা বিশ্বে যে অনেক প্রতিভার স্বাক্ষর রাখতে পারে, সেটাও তো প্রচুর উদাহরনের মধ্য দিয়ে প্রমানিত সত্য। তারা যদি প্রশ্ন করে, আমাদেরকে প্রতিভার স্বাক্ষর রাখার মতো করে গড়ে তোলা সেরকমভাবে হচ্ছেনা, কী বলবেন তখন মাননীয় শিক্ষকরা? ইন্টারমিডিয়েট পাশের পর এই যে ভর্তির জন্য সারাদেশ ছুটাছুটি করা, আজ এখানেতো কাল ওখানে, আজ ঢাকা কাল রংপুর, পরশু বরিশাল আবার ঢাকার জগন্নাথে তার পরেরদিন। প্রযূক্তির এই যুগে অভিভাবকসহ শিক্ষার্থীদের কেন এই প্রানান্তকর কষ্ট? সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য সমন্বিত ভর্তি-পরীক্ষা নেয়া হচ্ছেনা কেন? ভর্তির ফর্মফিলাপ বাবদ যে অর্থ নেয়া হয়, তার বিরাট অংশ কোথায় যায়, সেই অংশের হিসাব যদি শিক্ষার্থীরা চায়, তখন! অথচ প্রযূক্তির এই যুগে সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য সমন্বিতভাবে ভর্তি-পরীক্ষা নেয়া সম্ভব বলে প্রযূক্তি ও শিক্ষা সংক্রান্ত অনেক বিশেষজ্ঞ দৃঢ়ভাবে মত প্রকাশ করেছেন।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে খন্ডকালীন পড়াতে পারবেন, এটা কোথায় বলা আছে? অনেকে বলবেন, কোথায় বলা আছে পারবেননা? এটাও কোথাও হয়তো বলা নাই, তবে নিজের ক্লাশ বাদ দিয়ে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাশ নিয়ে থাকেন, এগুলি নৈতিকতা-বিবর্জিত কাজ নয় কী? পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে লালদল, নীলদল নামে সরকারপক্ষ ও বিরোধীপক্ষের রাজনৈতিক-চর্চা হয়না কি? সাধারন শিক্ষার্থীরা যদি মনে করে যে, দেশে ভর্তিবাজীর জন্য, ছাত্রনেতা কর্তৃক শিক্ষক-প্রহারের জন্য শিক্ষকদের এসমস্ত বিষয় অনূঘটক হিসাবে কাজ করে, তখন কারো কিছু কী বলার আছে, না থাকতে পারে?
পরিশেষে বলি নিজের দোষ দেখতে না পাওয়ার কারনে অথবা নিজের দোষ ঢাকার জন্য অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে লাভ নাই। সবারই কিছু-না-কিছু দোষ আছে। সেই দোষের দায়ভার শিক্ষার্থীদের উপর চাপিয়ে তাদের হতাশ করা থেকে আমরা বিরত থাকি। নিজেরা দোষমূক্ত হওয়ার চেষ্টা করি, টাকা-পয়সার লোভ না করি। সকল সমস্যার সমাধান আসলে এখানেই নিহিত।
১৪টি মন্তব্য
মিসু
দায়টা আসলে সবার। ভালো লিখেছেন।
আজিম
তবুও শুধুমাত্র শিক্ষার্থীদের উপর এই দায় চাপানো হয়।
ধন্যবাদ আপনাকে মন্তব্য করার জন্য।
মরুভূমির জলদস্যু
মাত্র দুজন (9)
আজিম
জ্বী, মাত্র দু’জন।
মনির হোসেন মমি(মা মাটি দেশ)
নিজেরা দোষমূক্ত হওয়ার চেষ্টা করি
এটাই মূল কথা ভাইয়া।
আজিম
আসলেই।
এটার উপর কোন কথা নাই ভাইয়া।
জিসান শা ইকরাম
ইংরেজী বিভাগে দুজন যোগ্য ছাত্র পাওয়া গেলো, এটি একটি উপহাস
দায় তো অবশ্যই শিক্ষার সাথে যারা জড়িয়ে আছেন তাঁদের সবার।
আজিম
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবার ভর্তি-উপযোগী ছাত্র ছেঁকে নেওয়ার জন্য যে ছাঁকনী তৈরী করেছিল, তাতে কোন ছিদ্র ছিলনা। এই ছাঁকনী গলে বেরিয়ে আসতে পারেনি ইংরেজি বিভাগের মাত্র দু’জন ছাড়া। আপনার রম্য-লেখায় আপনি যেভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মেধা যাচাই করেছেন, অনেকটা সেভাবে।
ছাইরাছ হেলাল
সব থেকে মজার ব্যাপার হল কেউ দায় নিচ্ছে না। এই বালখিল্য কবে শেষ হবে কেউ জানি না।
শিখা যেখানে আমাদের অধিকার।
আজিম
আপনাকে ধন্যবাদ।
ব্লগার সজীব
শিক্ষা ব্যবস্থার একটি অধ্যায় নিয়ে গুরুত্বপুর্ন লেখার জন্য ধন্যবাদ। কিভাবে যে এ থেকে মুক্ত হবো আমরা জানিনা।
আজিম
দেশের শিক্ষাবিদগনের সমন্বিত চিন্তার প্রতিফলন যখন ঘটবে, তখনই আমরা এ থেকে মুক্ত হতে পারব সম্ভবতঃ।
আপনাকেও ধন্যবাদ পড়ার জন্য।
লীলাবতী
দায় সাধারন পাবলিকের ।
আজিম
এক অর্থে তো তা-ই।