বিড়ম্বিত মানুষ এবং আজকের ছাত্রসমাজ

আজিম ১৭ জুলাই ২০১৪, বৃহস্পতিবার, ১১:১৭:৪৮পূর্বাহ্ন গল্প ১৭ মন্তব্য

মেইন রাস্তার সাথে সরাসরি অথবা পরোক্ষে সংযূক্ত রাস্তাগুলোর একটা দিয়ে হাঁটছিলাম । দু’পাশে দালান, অট্টালিকাগুলি দাঁড়িয়ে পাশাপাশি । রাস্তার পীচ ছাড়িয়ে মাটির অংশের ১০/১২ ফিট দূরে দাঁড়িয়ে বাড়িগুলো । মাটির অংশে অবস্থিত যে গাছগুলো, সেগুলির একটির ছায়ার নীচে বসে চা বিক্রী করছেন তিনি । একটি ইটের উপর বাজারের ব্যাগ বিছিয়ে বসে আছেন, সামনে বড় একটা ফ্লাক্স । ফ্লাক্সের গলায় বাঁধা একটা দড়ি, সেই দড়ির সাথে বাধা তিনটি পলিথিন । একটায় বড় বড় টোষ্ট বিস্কুট, একটায় পান এবং আরেকটায় সিগারেট আর কিছু শুকনা সুপারি । নীচে বালুর উপরে ছোট্ ছোট দুইটা পলিথিন পাতা, তার একটিতে কাঁচা সুপারি এবং আরেকটায় তিনটা ছোট কৌটা, একটায় চুন, একটায় জর্দা এবং আরেকটায় কি যেন । তার সামনে বামে পাঁচ লিটারের একটা বড় বোতল, পানিভরা । বোতলের মাথায় উপুড় করে রাখা একটা গ্লাস । পানি খেতে কেউ চাইলে বাম পায়ের পাতা এবং বাম হাতে বোতলটা উঁচু করে ডান হাত দিয়ে গ্লাস ধরে গ্লাসে পানি ঢালেন তিনি । ফ্লাক্সটার মাথায় একটা সিগ্রেট-লাইটার ।সিগ্রেট কেউ ধরালে পরে আবার ঐখানটাতেই রেখে দিচ্ছেন তারা লাইটারটা ।

রিক্সাওয়ালারাই দোকানের মূল খরিদ্দার, তা বলাই বাহূল্য । বহূদুর ঘুরে ক্লান্ত হয়ে এসে বসেন তারা ।না, বসার মত কোন জায়গা নেই এখানে তাঁদের । দু’পায়ের উপর ভর করে বসে কেউ টোষ্ট খান, পানি খান, লাল চা খান এবং শেষে হয়ত একটা সিগ্রেট অথবা একটা পান । আবার কেউ শুধুবা একটা লাল চা, তারও আগে এক গ্লাস পানি এবং শেষে একটা সিগ্রেট ।

নাম জিজ্ঞেস করা হয়নি তাঁর, খুব কি প্রয়োজন আছে সেটার ? পাশে দাঁড়িয়ে লাল ঐ চা খেতে খেতে দেখা হয় দৃশ্যগুলো আমার । রাজধানীজুড়ে এরকম দোকানের বিস্তৃতি অনেক । অনেকে আবার ভ্রাম্যমান দোকান করে থাকেন, তবে এতো জিনিস নিয়ে নয় । যেমন পানের আইটেমটা তারা রাখেননা । কারন পানে অনেকরকম জিনিস লাগে, ভার না হলেও গুছিয়ে যেগুলি বহন করতে কষ্ট হয় ।

শ্যামলী শিশুমেলার মোড় নামক স্থানে বিরাট এক ১৫-তলা ভবন, নাম ‘আশা ভবন’ । পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় পরিপাট্টি করে অফিসিয়াল ড্রেস পরিহিত গার্ডদের দেখে একটু দাঁড়ালাম । বাথরুমের দোহাইয়ে ভিতরে ঢুকলাম । প্রায় কিছুই না দেখে বের হবার সময় নিরাপত্তাকর্মীদের একজনের সাথে কথা বললাম । মনে স্বভাবতঃই প্রশ্ন জাগে, কি এটা ? জিজ্ঞেস করি এবং উত্তর পাই, এটা ইউনিভার্সিটি, আশা ইউনিভার্সিটি । এমন নয় যে আশা ইউনিভার্সিটির নাম শোনা হয়নি । বছর দুই আগে পত্রিকা মারফত জেনেছিলাম, ওখানে কিছু পদে নিয়োগ-সংক্রান্ত জটিলতা হয়েছিল । সে-সম্পর্কে জানতে চাই । উনি যা বলেন, সার-সংক্ষেপ  করলে তা দাঁড়ায়, ওটা হয়েছিল পদসংখ্যার তূলনায় চাকরীপ্রার্থীর বিপুল সংখ্যার কারনে । আরো শুনেছিলাম সেসময় যে, চাকরীপ্রার্থীদের কাছ থেকে অনর্থক বিপুল পরিমান টাকা জোর করে এবং কৌশলে আদায় করা হয়েছিল ।

এই বিরাট বিল্ডিংযের সবই কি আশা ইউনিভার্সিটি ?

উত্তর আসে, দু’টি ফ্লোর বাদে সবই আশার । ১২/১৩ হাজার ছাত্র-ছাত্রীর বিশাল পদচারনা এই আশা ইউনিভার্সিটির ফ্লোরগুলোতে ।

আমাদের দেশে তরুন প্রজন্মের সংখ্যার বর্ধিত হারের সাথে সাথে তাদের শিক্ষার সুযোগগুলি বাড়ার পথ যখন পাচ্ছিলনা, যখন সংকূচিত হয়ে পড়ছিল তাদের উচ্চশিক্ষার সুযোগগুলো, বেসরকারী ইউনিভার্সিটিগুলির যাত্রা শুরু তখন থেকেই । এগুলি না হলে দেশে উচ্চশিক্ষা মুখ থুবড়ে পড়তো, তা বলাই বাহূল্য । দু’একজন শিক্ষার্থী ছাড়া সকলেই তারা মধ্যবিত্ত অপেক্ষা অবস্থাপন্ন ঘরের সন্তান । এদের মধ্যে মাদক গ্রহনের প্রবনতা বিদ্যমান, যা তাদের তারুন্য, সজীবতা নষ্ট করে দিবে । বলা হয়ে থাকে, মানের বিচারে কিছুটা নিম্নমানের শিক্ষাই পেয়ে থাকে তারা । সবচেয়ে বড় যে অভিযোগটি রয়েছে তাদের সম্পর্কে, তা হোল দরিদ্র, অভাগা ঐ চায়ের দোকানদার, রিকশাওয়ালা, এসমস্ত মানুষ তাদের নিকট কোন সহানুভূতি পায়না, তাচ্ছিল্লের একটা ভাব পরিলক্ষিত হয় এঁদের প্রতি ওদের ব্যবহারে ।

নৈতিকতার চর্চা-ই পারে শুধু তাদেরকে এসমস্ত পরিত্যাগ করে ন্যায়ের পথে আনতে । আমাদের সাথে কোন না কোনভাবে সম্পর্কিত তারা । ছোট্ট এই ভূখন্ডে তারা আমাদের আত্মীয়তার সূত্রেই বাধা কোন একভাবে । অনেকের এদের পরিবারে নৈতিকতার চর্চা হয়, আবার অনেক পরিবারে হয়ইনা । অনেকে সঙ্গদোষে পরিবর্তিত হয় । অনেকে আবার পরিবারে নৈতিকতার চর্চা না হওয়ার কারনে নষ্ট হয়ে যায় । বিরাট-বিশাল এই শিক্ষার্থী এই তরুন সমাজকে আমরা কাছে টেনে নিতে চাই, তাদের আমরা মানবিক নাগরিকে পরিনত করতে চাই ।

বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের সন্মানিত শিক্ষক-শিক্ষিকাদেব্রকে এই বিশাল দায়িত্ব নিতে হবে । তাঁরা না নিলে আর কে নিবে এ-দায়িত্ব ? দেশ-সমাজের পাঠ এই ছাত্রদের যে দিতে হবে তাঁদেরই । সহনশীলতা, মানবিকতা, উদার মনোভাবের শিক্ষা, মানুষ কেন দরিদ্র হয় এবং অসহায়, হতাশ মানুষগনকে কোন দৃষ্টিতে, কোন ভাবাদর্শে দেখতে হয়, সে-পাঠদানের ভারতো তাঁদেরই উপর ন্যস্ত । আশেপাশের দরিদ্র চা-বিক্রেতা, রিক্সাওয়ালা, মুটে-মজুর শ্রেণির মানুষজনদের মুখের দিকে তাকিয়ে সেখান থেকে ওদের শ্রমের, ঘামের কষ্টগুলো ছাত্র-ছাত্রীদের অনূধাবন করতে হবে। নিজের হাতখরচ থেকে কিছু বাঁচিয়ে বিড়ম্বিত এসমস্ত মানুষের দিকে সাহায্যের হাতটা কিছুটা বাড়িয়ে দেওয়া এদের কর্তব্য বলে মনে করি। খুবই কষ্ট এই মানুষগুলির, বাঁচতে হবেনা এঁদের?

আগের আমলের স্কুল ও কলেজের কিছু মহান শিক্ষকের কথা আমরা শুনেছি । তাঁরা বাড়ীতে বাড়ীতে খালি পায়ে হেঁটে গিয়ে পাঠ দিয়ে আসতেন, অনেকেই বিনে-পয়সায় । শুধু তা-ই নয়, আদর্শ ও নৈতিকতার শিক্ষাও তাঁরা অকাতরে বিলিয়ে যেতেন । অনেক শিক্ষার্থীর নৈতিকতার শিক্ষা লাগতোইনা, ঐসমস্ত শিক্ষকদের দেখে অনুকরনের চেষ্টা করত তারা । তার সুফল আমরা পেয়েছি; বিগত শতকের ছাত্রনেতাদের কর্মকান্ডের দিকে যদি আমরা দৃষ্টি দেই, তবেই বুঝব তা পেয়েছি আমরা । তাঁরা এবং তাঁদের উত্তরসূরীরাই তো এখন শিক্ষক। নিজেদের অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান তাঁরা তাঁদের শিক্ষার্থীদেরকে মাঝে সঞ্চার করবেন, এই আশা আমরা করে যেতে চাই । নষ্টের দ্বারপ্রান্ত এ যুগে এই ছাত্রসমাজই যে এদেশের ভরসা।

আমরা বেসরকারী স্কুল-কলেজের মাননীয় শিক্ষক-শিক্ষিকাগনকে এরকম আহ্বান জানিয়ে যেতে চাই । এসমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রীদেরকেও আহ্বান জানাই মানবিকতার এসকল পাঠ গ্রহন করতে অতি নিবিষ্ট মনে । উদারতা, মহানূভবতা, সহনশীলতা এসমস্ত গুনের পাইওনিয়ার হয়ে থাকুক তারা।

 

0 Shares

১৭টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ