অশ্রু

ফ্রাঙ্কেনেস্টাইন ২২ নভেম্বর ২০১৫, রবিবার, ০৮:৩৯:০২অপরাহ্ন গল্প ১৫ মন্তব্য

১।
নীলা একটা প্রাইভেট ফার্মে চাকুরী করে । মাত্র ১ বছর হলো সে ভার্সিটি থেকে পাশ করে বের হয়েছে । চাকুরী পাওয়ার পরে এইটাই তার প্রথম ঈদ । বাবা অবসরপ্রাপ্ত । মা গৃহিণী । পরিবারে আরো রয়েছে তার ছোট এক ভাই আর বোন । আগে তাদের পরিবারটি কেবল নীলার বাবার মধ্যম আয়ের উপরে নির্ভর করে চলতো । গতবছর উনি অবসর নেওয়ার পরে কয়েকমাস ওনার জমানো টাকা দিয়ে চলতে হয় । এরপরেই নীলার চাকরিটা তাদের পরিবারের জন্য আশীর্বাদ হয়ে উঠে । মোটামোটি ভালো বেতনের চাকরি । সারাজীবন মধ্যম ভাবে জীবন কাটানো নীলার পরিবারের জন্য তাই খুব একটা সমস্যা হয়ে উঠেনি ।

প্রতি মাস শেষে বেতনটা পেয়ে মার হাতে তুলে দেয় নীলা । বাকি কাজটা তার মা-ই করেন । নীলার বাবা-মা তার বিয়ের জন্য চাপাচাপি করেছেন কিন্তু নীলা রাজি হয়নি । তার ছোট ভাইটা বুয়েটে পড়ছে । পড়া শেষ হতে আরো বছর তিনেক লাগবে । নীলা সাফ জানিয়ে দিয়েছে এই তিন বছরের আগে সে বিয়ের পিঁড়িতে বসবে না । অনিচ্ছাসত্ত্বেও তার বাবা-মা কে এই সিদ্ধান্ত মেনে নিতে হয়েছে ।

অফিসে নীলার পরিচিতি বেশ । হাসি-খুশি, আন্তরিক, নিয়মানুবর্তী সব মিলিয়ে যাকে আমরা স্মার্ট বলি নীলা সেইরকমই । অফিসে এমন কেউ নেই যে নীলাকে পছন্দ করে না । ঈদের আর মাত্র ৩ দিন বাকি । নীলার অফিসের সবার ঈদ বোনাস দিয়ে দেওয়া হয়েছে । আজকে নীলাও ঈদ বোনাসটা পেয়ে গেছে । ২৫ হাজার টাকা । এই বোনাস দিয়ে কি করবে সেই চিন্তায় তার সময় কাটে না । মনে মনে হিসাব করতে বসে বাবার জন্য ২ টা পাঞ্জাবি কিনবে । সেই কবে থেকে ১টা পুরান পাঞ্জাবি দিয়ে উনি দিন কাটাচ্ছেন !! ভাইয়ের জন্য কয়েকটা ভালো টি-শার্ট আর একটা পাঞ্জাবি । ছেলেটা ভার্সিটিতে যায় প্রতিদিন একটা শার্ট পড়ে !! মায়ের জন্য একটা সুন্দর শাড়ি, ছোট বোনের জন্য একটা জামা আর নিজের জন্য ?? থাক নিজেরটা নিয়ে ভাবতে চায় না নীলা । আজকে একটা জরুরী মিটিং থাকায় সে আটকে গেছে । প্রতিদিন বাসায় গিয়ে ইফতার করতে পারলেও আজকে সে রাতের আগে যেতে পারছে না ।

রাত সাড়ে ৯টা । সাধারণ সময়ের ঢাকা আর এই সময়ের ঢাকার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে । ঈদের আগে প্রায় ফাকা হয়ে গেছে । চেনা শহরটাকে এখন অনেক অচেনা মনে হয় । অফিসের গেট থেকে গার্ড রিকশা করে দিলো । কিছুদূর যেতেই পিছু নিলো একটা সিএনজি । নীলার এইসবের কোন ভাবনাই নেই । সে তার বোনাসের টাকা দিয়ে কি করবে সেই চিন্তায় বিভোর হয়ে আছে । বারবার হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখছে টাকাটা আছে তো !! ঈদের কেনাকাটা করে বাড়তি যা থাকবে তা দিয়ে কি করা যায় মনে মনে এখন সে তাই ভাবছে । আর ভাবছে কালকে সকালেই মার্কেটে যেতে হবে । নাইলে পরে যদি পছন্দমত জিনিস পাওয়া না যায় ! প্রায় ১০ মিনিট ধরে পিছু নেওয়া সিএনজি এইবার হটাত করেই সামনে এসে রিকশার গতিরোধ করলো । এতক্ষণে রিকশা মূল-সড়কে থাকলেও এখন একটা গলির ভিতরে চলে এসেছিল । সিএনজির দুই পাশ থেকে দুই ব্যক্তি নেমে একজন এসে নীলার ব্যাগে হাত দিলো । বিস্মিত নীলা প্রাণপণে চেষ্টা করতে লাগলো ব্যাগটা নিজের কাছে রাখতে । হটাত করেই ওই আগন্তুক ছুরি বের করে সোজা নীলার পেটের উপর আঘাত করলো । তীব্র যন্ত্রণায় জ্ঞান হারালো সে ।

চোখ মেললো নীলা । অস্পষ্ট ভাবে মনে পরলো ছিনতাইয়ের কথা । উঠে বসতেই টের পেলো হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছে সে । পাশে চোখ পড়লো মায়ের উপর । এরপরেই দেখলো বাব , ভাই-বোন সবাই রয়েছে তার পাশে । মা নীলাকে উঠতে দেখেই আল্লাহের কাছে শুকরিয়া জানিয়ে নীলাকে জড়িয়ে ধরলেন । মায়ের স্পর্শ পেতেই চোখ অশ্রুসজল হয়ে উঠলো নীলার । মা সাত্ত্বনা দিয়ে বলেন, “ এখন আমি এসে গেছি, তোর কোন ভয় নেই । ” কিন্তু নীলার চোখে তো ভয়ের অশ্রু নেই, নেই কয়টা টাকা হারানোর শোকের অশ্রু । তার চোখের অশ্রু তার স্বপ্ন ভঙ্গের যন্ত্রণার, তার প্রিয়জনদের মুখে একটু হাসি ফোটাতে না পারার আক্ষেপের ।

২।
ঢাকার এক জোনের এডিসি রাসেল । মাত্র ৩ বছর আগে বিসিএস দিয়ে পুলিশে জয়েন করে সে । এত তাড়াতাড়ি ঢাকায় পোস্টিং পাওয়ার কথা ছিলো না তার । কিন্তু তার চাচা স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলে পেয়ে গেছে । তবে চাচার জন্য পোস্টিং পেলেও তার নিজের যোগ্যতার অভাব নেই । স্বচ্ছল পরিবারের ছেলে বলে অবৈধ পন্থায় তার আয়ের কোন দরকার নেই । আর শরীরে মুক্তিযোদ্ধার রক্ত বলে অন্যায়ের সাথে তার কোন আপোষ নেই । তার কারণে মাত্র ছয় মাসে তার জোনের পরিস্থিতি পাল্টে গেছে । সেই দিন সকালে নিজ অফিসে বসে চা খাচ্ছিলো আর আগের রিপোর্ট গুলা দেখছে । এমন সময় তার অধীনস্ত এক থানার ওসি ফোন দিলেন ।

গত রাতে ঘটে গেছে এক ভয়ঙ্কর ছিনতাইয়ের ঘটনা । এক তরুণীকে ছুরি মেরে ২৫ হাজার টাকা ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে । গত ২ দিনে ঐ এলাকা ও তার আশেপাশে মোট ১০ লক্ষ টাকা ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটলো । এমন পরিস্থিতিতে কখনো পড়েনি রাসেল । অপরাধীরা ঈদের মৌসুম দেখে অনেকটা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে । তাই ওসির খবর শুনে জানতে চাইলো ভিক্টিমের অবস্থা । ওসি তাকে হাসপাতালের ঠিকানা দিলে রাসেল নিজেই যাওয়ার মনস্থির করে ।

হাসপাতালে নীলাকে দেখে অবাক হয় রাসেল । দীর্ঘ সাত বছর পরে তাদের দেখা । রাসেলের কৈশরের প্রেম ছিল নীলা । রাসেল যখন এইচএসসি দেয় তখন তাদের সম্পর্কচ্ছেদ ঘটে । তার আগে তিন বছর চুটিয়ে ছেলেমানুষী প্রেম করেছে তারা । নীলা তার চেয়ে তিন ক্লাস জুনিয়র ছিলো । হাসপাতালে নীলাকে দেখে একটুর জন্য অতীতে চলে গেলো রাসেল । পুরানো দিনের কথা মনে করে এক টুকরো চিলতে হাসি তার কঠোর চেহারাতে ফুটে উঠলো । রাসেলকে দেখে চেনা চেনা মনে হলেও ঠিক চিনতে পারছিলো না নীলা । হটাত নেম-প্লেটের নাম দেখে বুঝে গেলো কার দেখা পেয়েছে সে ।

প্রথমে হাসপাতালের ডাক্তার এরপরে নীলার বাবার সাথে কথা বলে নীলার সাথে কথা বলার জন্য তার বিছানার পাশে এসে বসলো রাসেল । কোন ধরণের অন্য কথায় না গিয়ে সোজা কাজের কথায় চলে এলো । জিজ্ঞেস করে জেনে নিলো যারা ছিনতাই করেছে তাদের চেহারা মনে আছে কিনা । নীলা সম্মতি দিলে ফোন দিয়ে স্কেচ আর্টিস্টকে ডেকে এনে স্কেচ আঁকিয়ে নিলো । স্কেচ দেখে ওসি জানালেন এর আগের ছিনতাই গুলার ক্ষেত্রেও ভিক্টিমরা এই একই স্কেচ দিয়েছে । ইনফর্মারদের কাজে লাগাতে নির্দেশ দিয়ে দিলো সে । সে নিজে গেলো পরিচিত এক সিএনজি চালকের কাছে । এই চালক তার ইনফর্মার হিসেবে কাজ করে । জানতে পারলো এই ছিনতাইগুলার ক্ষেত্রে ওই এলাকার কোন সিএনজি ব্যবহৃত হয়নি ।

নিজেদের সিএনজি নিয়ে ছিনতাই !! সব শুনে রাসেল বুঝলো এক চক্র খুব ঠান্ডা মাথায় এই কাজ করছে । সব শুনে সে সিদ্ধান্ত নিলো ফাঁদ পেতে ধরতে হবে এই চক্রকে । কিন্তু কিভাবে ফাঁদ পাতা যায় !! ঈদের মাত্র দুই দিন বাকি । অনেক চিন্তা-ভাবনা করে কাজ করেও কোন ফল পাওয়া যাচ্ছে না ।

অস্থির হয়ে উঠছে রাসেল । এইভাবে কয়েকটা ছিনতাইকারীর কাছে পরাজিত হতে হবে । নীলার সাথে এখন তার প্রতিদিনই কথা হয় । আগের স্বৃতির আলোচনা আর নিজেদের পরবর্তী জীবনের কথাগুলা আদান-প্রদানের মাধ্যমে নীলার প্রতি সেই পুরানো দুর্বলতা মাথা চাড়া দিয়ে উঠে রাসেলের । এই কেস তার কাছে এখন অধিক গুরুত্বপুর্ণ হয়ে উঠেছে নীলার জন্য । ঈদের বাকি আর একদিন । এমন সময় সেই ওসি ফোনে জানালো এক চা দোকানদার জানিয়েছে আজ রাতে ঐ চক্র তাদের শেষ অপারেশন চালাবে । টার্গেট নীলাদের অফিসের পাশের ব্যাংকটা । ব্যাংক ছুটি হয়ে গেছে । গার্ড মাত্র ৩ জন । চা খেতে খেতে আলাপ করার সময় তথ্যগুলো চা দোকানের নয় বছর বয়সী ছেলেটার কানে গেলে মালিককে জানাতে দ্বিধা করেনি সে । একটু অবাক হয় রাসেল কারণ এই এলাকা অন্য থানার অধীনে পড়ে । কিন্তু পুলিশকে ফাঁকি দিতেই নাকি তারা এমনভাবে কাজ করেছে । তাদের প্রধান উদ্দেশ্যই নাকি ছিলো ঐ ব্যাংক লুট করা । সব শুনে পরিকল্পনা ঠিক করে রাসেল ।

সেই রাত মানে ঈদের রাত !! চারপাশে একটা উৎসব উৎসব ভাব । এমন সময় একটা সিএনজি এসে থামলো নীলাদের অফিসের সামনে । অফিস থেকে বেরিয়ে এলো সেই গার্ড যে নীলাকে রিকশা করে দিয়েছিলো । গার্ডকে দেখে সিএনজি থেকে নামলো ৪ জন লোক । অন্ধকারে ঠিক বুঝা যায় না তাদের চেহারা । ওইখান থেকে বিশ গজ দূরে ঘাপটি মেরে থাকা রাসেল তার রেডিও তে সতর্ক করে দেয় সহকর্মীদেরকে । ছিনতাইকারীরা সন্তর্পণে এগিয়ে যায় ব্যাঙ্কের দিকে । নিরাপত্তাকর্মীরা কিছু বুঝার আগেই ধরাশয়ী হয়ে যায় । ব্যাংক লুট করে বের হবে এমন সময়েই হামলা করে রাসেল ও তার দল । পুলিশ দেখে ৩জন আত্বসমর্পন করলেও বাকি ২ পিস্তলধারী পুলিশকে লক্ষ করে গুলি করে পালিয়ে যেতে চায় । এক চিলতে কঠিন হাসি ফুটে উঠে রাসেলের ঠোটে । সরাসরি গুলি করে নীলার অফিসের গার্ডকে । কারণ সে দেখেই অনুমান করেছে নীলার এই অবস্থার পিছনে দায়ী ওই ব্যক্তিটি । সঙ্গীকে ধরাশয়ী হতে দেখে আত্বসমর্পণ করে অপরজন ।

ঈদের পরেরদিন নীলার সাথে বাইরে এক রেস্টুরেন্টে দেখা করে রাসেল । খুব আগ্রহ নিয়ে নীলা তাদের অভিযানের কথা জানতে চায় । বিস্তারিত শুনে একটু অবাক হয় সে । ধন্যবাদ জানায় রাসেলকে । আর রাসেল জানায় তার ভালোবাসার কথা । শুনে এক ধরণের ইঙ্গিতপূর্ণ হাসি দে নীলা । রাসেলকে সেও পছন্দ করতো । কেবল নিজেদের লেখাপড়ার কথা ভেবেই আলাদা হয়েছিলো তারা । তবে এইটাও জানিয়ে দেয় তিন বছরের আগে বিয়ে করতে পারবে না । রাসেল তাতে রাজি । সে আর কোন কিছুর মূল্যে তার ভালোবাসা হারাতে চায় না । নীলা আর রাসেল হাত ধরে হাঁটছে পার্কে । এক জায়গায় বসলো তারা । পরম নির্ভরতায় রাসেলের কাধে মাথা রাখলো নীলা । চোখে তার অশ্রু । এই অশ্রু আনন্দের, এই অশ্রু হারানো ভালোবাসা ফিরে পাওয়ার ।

(এটা আমার লেখালেখি শুরুর একদম প্রথম দিককার একটা লেখা, যদিও এই ব্লগে পোস্ট করা হয়নি।)

0 Shares

১৫টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ