তিনঃ 
 
মূহুর্তের মধ্যেই সটান হয়ে দাঁড়িয়ে ঠকাশ করে স্যালুট দিল এসআই শহীদুল।
 “ স্যরি স্যার, প্রথমে আমি বুঝতে পারিনি। ” 
- না, আমার উচিত ছিল প্রথমেই পরিচয় দেওয়া। কিন্তু ঘটনার আকস্মিকতায় মাথায় আসেনি ব্যাপার না।
“ কিছু মনে করবেন না স্যার। একটা কথা বলি? ” 
- বলেন।
“ এবার সত্যটা গোপন না করে বলেন তো মেয়েটা কি কেবলই আপনার ভার্সিটির ক্লাসমেট ? ”
- না। আমার সাবেক প্রেমিকা।
এখন আর গোপন করার কিছু নাই। লোকটা স্পষ্ট বুঝতে পেরেছে তিথীর সাথে আমার সম্পর্কটা কেবল ক্লাসমেটের ছিল না।
 
“ সেটা অনুমান করতে পেরেছিলাম আগেই। আপনার পরিচয় দেওয়ার পর আরও পরিষ্কার হয়েছে। এডিএসইউয়ের একজন অফিসার এ ধরণের পরিস্থিতিতে হতবুদ্ধি হয়ে গেলে বুঝে নিতে হয় ব্যক্তিটি তার জন্য বিশেষ কিছু। ” 
লোকটার সাথে দ্বিমত করার উপায় নেই। লোকটার প্রশংসা করতে বাধ্য হচ্ছি। আমার অবস্থা বুঝতে পেরে আলাপটা একটু ঘুরিয়ে নিয়ে আমাকে সহজ করার চেষ্টা চালাচ্ছে।
পরিচয় দেয়ার পরেই আমার ভেতরের কর্তব্যবোধ আবেগটার উপর প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করেছে। এ ধরণের পরিস্থিতিতে আমাকে অতীত রোমন্থন না করে বর্তমান নিয়ে ভাবতে হবে। মেয়েটা কে কেনই বা কেউ মারতে যাবে!
 
গলাটা ঝেড়ে কথার ভারিক্কি ভাবটা ফুটিয়ে তুলতে চাইলাম ...
“ আচ্ছা ঘটনাটা ঠিক কোথায় ঘটেছিল? এবং তারপর কি হয়েছিল? ” 
- স্যার, আগে যেমনটা বলেছি, ঘটনাটা ঘটেছে মতিঝিল সরকারী কলোনীর কাঁচাবাজারের ঠিক মাঝামাঝি। আততায়ী গুলি করে দৌড় দিয়ে পাশের কলোনিতে ঢুকে পালিয়ে গেছে।
“ পাশে দুইটা কলোনী আছে। কোন কলোনিতে গেছে ? ” 
- আলহেলাল জোনে।
“ ভরদুপুরে গুলি করলো। বাজারে মানুষজন ছিল না ? ” 
- জ্বি না স্যার। ওই সময়টায় মানুষ একটু কম থাকে বাজারে। দোকানদাররাও বেশিরভাগ বিশ্রাম নেয়। আর যারাও বা ছিল কেউ প্রথমে বুঝতেই পারেনি যে গুলি করা হয়েছে।
“ কেন? ” অবাক হয়ে গেলাম।
- বললে হয়তো বিশ্বাস হবে না স্যার। গুলি করা হয়েছিল সাইলেন্সর লাগানো বন্দুক দিয়ে!
“ কি!!! ” সত্যিই বিশ্বাস হতে চাইলো না। কত গুরুত্বপূর্ণ মানুষকে হত্যা করা হলো কিন্তু সাইলেন্সরের ব্যবহার দেখিনি। অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ মানুষ যাকে খুব গোপনে হত্যা করতে হয় তাদের ক্ষেত্রে এর ব্যবহার হয়। তিথী কি তাহলে এতই গুরুত্বপূর্ণ কেউ ছিল!
 
“ কেউ না কেউ তো আততায়ী কে দেখে থাকবে? ” 
- জিজ্ঞেস করা হয়েছে স্যার। কেউ ভালমত খেয়াল করেনি। তিথী ম্যাডাম হুট করে পড়ে গেলে দুইজন কাছে গিয়ে এই অবস্থা দেখে পুলিশে ফোন দেয়।
“ শুনুন, এক কাজ করেন আপনি। আপনার থানার অফিসারদের কাছে নির্দেশ পাঠান। বলেন যে, বাজারের দুই মাথার দক্ষিণ পাশে একটা এটিএম বুথ আছে। আর উত্তর মাথায় ' রাসেল স্টোর ' নামে দোকান আছে। ওদের সিসিটিভি ক্যামেরা আছে। ওটা চেক করতে বলেন। ” 
- ইয়েস স্যার।
“ আর যেহেতু আলহেলাল জোনে ঢুকেছে সুতরাং হয় ১২ নাম্বার বিল্ডিং এর সামনে দিয়ে যাবে, নয়তো ৯ নাম্বার বিল্ডিং এর সামনে দিয়ে যাবে। ওই দুই বিল্ডিং এর মানুষজন, ছোট বড় সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে বলবেন। আর ওই কলোনী থেকে বের হয়ে আরামবাগ মোড়ে বাসের কাউন্টার গুলার ফুটেজ এবং আরেকদিকে টি-অ্যান্ড টি কলোনী স্কুলের গার্ডকে জিজ্ঞেস করতে বলেন। আততায়ী কলোনি থেকে বের হতে চাইলে তাকে এই দুই জায়গার একটা দিয়েই বের হতে হবে। ” 
- ইয়েস স্যার।
কণ্ঠেই বুঝতে পারছি লোকটা ভীষণ অবাক হয়েছি। তাকে অবাক হতে দিলাম। বললাম না যে আমার জন্মের পরবর্তী ১৭টা বছর কেটেছে এই এলাকাটার মধ্যে।
 
ওয়াকিটকি বের করে প্রয়োজনীয় মেসেজ দিতে শুরু করল এসআই শহীদুল। এদিকে আমি শাহবাগ থানার ওসিকে ফোন দিয়ে বললাম তিথীর জন্য জরুরি বিভাগে যেন অতিরিক্ত দুইজন কনস্টেবল পাঠানো হয়। যদিও জরুরি বিভাগে যথেষ্ঠ ভাল নিরাপত্তা আছে তারপরেও মন বলছে খারাপ কিছু হলেও হতে পারে। বিশেষ করে সাইলেন্সরের ব্যাপারটাই মনের ভিতর অনেক বেশি খোঁচাচ্ছে।
 
এরই মধ্যে শহীদুলের কথা শেষ হয়ে গেল। আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
“ স্যার যদি কিছু মনে করেন তাহলে একটা কথা জিজ্ঞেস করতে পারি? ” 
- আমার জন্ম ওই কলোনীতেই। আর তার পরবর্তী ১৭ বছর কেটেছে ওইখানটাতেই। এমনকি ভার্সিটিতে থাকতেও তিথীকে নিয়ে প্রায়ই যেতাম ওখানে। আমার আর ওর ভীষণ পছন্দের একটা জায়গা ছিল সেটা। আর কিছু বলবেন ?
লোকটাকে আর অন্ধকারে রাখতে ইচ্ছা হল না। তাই আসল সত্যটা জানিয়েই দিলাম।
 
“ ইয়ে মানে স্যার, বেয়াদবী মাফ করবেন। এই কেসটা কিন্তু স্যার আপনি হ্যান্ডেল করতে পারবেন না। ” 
এই ভয়টাই করছিলাম। এত এত নির্দেশ দিয়ে যে পাঠিয়েছি আসলে তারা কতটুকু আন্তরিকতার সাথে যে কাজটা করবে নিশ্চয়তা নেই, কারণ আমি তাদের কমান্ডার নই। সিনিয়র অফিসার হওয়াতে হয়তো সৌজন্যতা দেখাতে কিছু কাজ করবে কিন্তু সেটারও তো একটা লিমিটেশন আছে। পাশাপাশি আমার ডিপার্টমেন্টও আমাকে এই কাজ করতে দিবে না। এখন উপায় !
 
“ জানি আমি। ” আশংকাটুকু আড়াল করে জবাব দিলাম। “ তারপরেও সিনিয়র অফিসার হিসেবে আপনাদের থেকে কিছুটা সহযোগিতা তো আমার প্রাপ্য, তাই না ? ” 
- জ্বি স্যার অবশ্যই। ভাববেন না আমরা ঢিলাঢোলা ভাবে নিচ্ছি ব্যাপারটা।
“ সেটা না করলেই খুশি হব। এবার কাজের কথা আসেন। তিথীর পরিবার বের করব কিভাবে? ” 
- সেটা তো স্যার আমার চেয়ে আপনার ভাল জানার কথা। আপনার সাথে যোগাযোগ না থাকলেও নিশ্চয়ই অন্য ফ্রেন্ডদের সাথে ছিল। একই ভার্সিটিতে ছিলেন যেহেতু নিশ্চয়ই অনেক কমন ফ্রেন্ড থাকবে আপনাদের মাঝে!
 
আসলেই তো ! দেরি না করে আমাদের ভার্সিটির ফ্রেন্ডদের ফোন দেওয়া শুরু করলাম। তিথীর সাথে ব্রেকআপের পর বলতে গেলে কারো সাথেই যোগাযোগ হয়নি। এমনকি ট্রেনিং করতে যখন গিয়েছি তখনো জানানো হয়নি কাউকে। সোশ্যাল মিডিয়া থেকে নিজেকে পুরোপুরি গুটিয়ে নিয়েছিলাম।
 
ভার্সিটির অফিস থেকে সবার নাম্বার কালেক্ট করে করে ফোন দেয়া শুরু করলাম। প্রায় তিন ঘণ্টা পার হয়ে গেল। প্রায় সব ব্যাচমেটের সাথেই যোগাযোগ করতে পারলাম। এমনকি যারা বিদেশে গিয়েছে তাদের সাথেও কথা বললাম। আশ্চর্যজনকভাবে কেউই আমাকে কোন নির্ভরযোগ্য তথ্য দিতে পারলো না। সবার একটাই কথা, আমি আর তিথী তাদের জীবন থেকে নাকি একই সাথে গায়েব হয়ে গিয়েছি। কেউ কেউ শুনেছে তার বিয়ে হয়েছে, তবে কেউই নিশ্চয়তা দিতে পারলো না।
 
আবারো হতভম্ব হয়ে গেলাম। এভাবে একজন মানুষ কি করে হারিয়ে যেতে পারে ! শহীদুলকে তিথীর মোবাইল টা আমাদের ইউনিটের টেকনিক্যাল ল্যাবে পাঠাতে বললাম। তাহলে ৬-৮ ঘণ্টার মধ্যে রিপোর্ট পাওয়ার আশা করা যায়।
 
হাসপাতালে এসেছি প্রায় সাড়ে ৪ ঘণ্টা হয়ে গেল। এখনো আমি কোন আগাতে তো পারিনি উল্টা বারবার পিছিয়ে যাচ্ছি!
অথচ এই কেসটা আমার আয়ত্বেও আসবে না। তখন কি হবে? আদৌ কি তিথীর খুনিকে বের করা যাবে? আদৌ কি তিথীর এই অন্তর্ধানের রহস্য সমাধান হবে?
আর মোস্ট ইম্পর্টেন্ট হচ্ছে যেটা এখনো ডাক্তাররা কিছু জানাতে পারেন নি ... " আদৌ কি তিথী আবার বেঁচে ফিরতে পারবে? "
রাত বাড়ছে। একগাদা প্রশ্ন আমার মনের ভেতর। কিন্তু কোন জবাব নেই। যতই ভাবছি ততই আরো বেশি করে জট পাকিয়ে যাচ্ছে সবকিছু।
চারঃ 
হঠাৎ করেই ঘুম ভেঙ্গে গেল। ঢামেকের জরুরী বিভাগের ওয়েটিং রুমের বেঞ্চে বসে থাকতে থাকতে কখন যে চোখটা লেগে গিয়েছিল সেটা বুঝতে পারিনি। অবশ্য মনের মধ্যে খুব খারাপ একটা অনুভূতি হচ্ছে। মনে হচ্ছে যে কেউ বুঝি তিথীর ক্ষতি করতে আসছে। যদিও আশংকা অমূলক। ওর কেবিনের বাইরে দুইজন সশস্ত্র কনস্টেবল, যাদের একজন মহিলা, পাহারা দিচ্ছে। আমার পাশেই হালকা নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে এসআই শহীদুল। লোকটা আপাতত এই ঘটনার তদন্তের ইনচার্জ। রাতে ডাক্তার যখন জানিয়েছিলেন যে তিথীর অবস্থা আপাতত স্থিতিশীল তখন লোকটাকে বলেছিলাম চলে যেতে। সে রাজি হয়নি। রাতেই আমার ইউনিটে ফোন দিয়ে আমার দেহরক্ষী কনস্টেবল আর ড্রাইভারকে আসতে বলেছি। জরুরি প্রয়োজনে গাড়িটার প্রয়োজন হতে পারে। তারা বাইরে অপেক্ষমান। বাইকটা বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছি আরেক কনস্টেবলকে দিয়ে।
 
ওয়েটিং রুমে এভাবে বসে শান্তি পাচ্ছিলাম না। করিডরে বের হয়ে আসলাম। তিথীর রুমের বাইরে যারা পাহারা দিচ্ছে তাদের একজন পুরাই ঘুমিয়ে গেছে। মহিলা সদস্যের চোখ ঘুমে ঢুলু ঢুলু। মেজাজ খারাপ হয়ে গেল আমার। শাহবাগ থানার ওসি সম্ভবত সবচেয়ে বয়স্ক দুইজন কে পাঠিয়েছে। এদের কি দোষ দিব!
 
রাগ হলেও কিছু করার নেই। আমার কথায় সে যে দুইজন পাঠিয়েছে সেটাই আসলে অনেক বেশি। রাগ দমনের জন্য আবার ওয়েটিং রুমে গেলাম। যাওয়ার সময়েই মনে হলো করিডরের শেষ মাথা থেকে একটা ছায়া চট করে সরে গেল। চোখের ভ্রমও হতে পারে। কিন্তু মন বলছে খারাপ কিছু হতে চলেছে। বারবার মনের কথা একজন অফিসার উপেক্ষা করতে পারে না। আমাদের ট্রেনিং এও এই ব্যাপারটার উপরে জোর দেওয়া হয়। অগত্যা ওয়েটিং রুমের দরজায় দাঁড়িয়ে রইলাম। একপাশে তিথীর কেবিনের দরজা অন্যদিকে করিডরের অন্ধকার মাথাটার দিকে নজর রাখলাম।
 
পিছনে খসখস শব্দ হতেই ঘুরে তাকিয়ে দেখি এসআই শহীদুল উঠে এসেছে।
“ কোন সমস্যা, স্যার? ” 
- নাহ। কেমন জানি মনে হচ্ছে খারাপ কিছু হতে পারে।
ছায়ার ব্যাপারটা চেপে গেলাম।
“ তাহলে তো খুব খারাপ কথা, স্যার। আমাদের পুলিশের মন বড়ই খারাপ জিনিস। কেন জানি পরিস্থিতি অনেক সময় আগে থেকেই টের পায়। ”  
- হুম। আচ্ছা এক কাজ করেন। একটা চেয়ার নিয়ে এসে কেবিনের দরজার পাশে বসেন। আমি ভিতরে যাই। এখানে বসে শান্তি পাব না।
“ কিন্তু স্যার, ভিতরে যাওয়া তো নিষেধ! ” 
- রোগীর জানই যদি না থাকে তাইলে আর নিষেধের মূল্য কি! আমি যাচ্ছি। আপনি বসেন। আর ওই দুইজনকেও উঠিয়ে দিতে বলেন। রাত বাজে আড়াইটা। এই সময়টা খুব খারাপ। আমার লাইফে গোপনে যত অপরাধ হতে দেখেছি বেশিরভাগই এই সময়ে হয়।
“ ইয়েস স্যার। ”
 
বাকি রাতে আর কোন সমস্যা হলো না। সকালে একজন নার্স আসায় ঘুম ভেঙ্গে গেল। বের হয়ে যাওয়ার আগ মূহুর্তে তিথীর চেহারাটা দেখে নিলাম আরেকবার। কাল রাতেও দেখেছি। সুন্দর, ফর্সা, গোলগাল চেহারাটা আর নেই, বরং কিছুটা রোদে পোড়া, তৈলাক্ত আর চাপা ভাঙ্গা চেহারাটা দেখলে অবাক হয়ে যেতে হয় কি করে মাত্র দেড় বছরে একজন এরকম পরিবর্তন হয়ে যায়! চেহারাটাই প্রকাশ করে দেয় কিছু ভয়ানক ঘটনা তার জীবনে ঘটে গেছে। হসপিটাল থেকে বের হয়ে সোজা চলে গেলাম অফিসে। হাতের কিছু কাজ আছে কিন্তু তিথীর কেসটা মাথায় নিয়ে কোন কাজ করতে পারছি না। করা সম্ভব ও না অবশ্য! অগত্যা ইউনিটের প্রধান ডিআইজি ওয়াহিদুর রহমানের কেবিনে গেলাম। ওনাকে পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে ২৪ ঘণ্টার ছুটি চাইলাম। আমার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে উনি ছুটি মঞ্জুর করলেন। পাশাপাশি মতিঝিল ও শাহবাগ জোনের উপকমিশনার স্যারদের ফোন করে এই কেস সমাধানে সর্বোচ্চ চেষ্টার অনুরোধ করলেন।
 
ছুটি পেতেই চলে আসলাম নিজের কেবিনে। চেয়ারে বসে ভাবতে লাগলাম কেসটার কথা। হাতড়ে বেরাতে থাকলাম পুরনো দিনের স্মৃতিগুলো। খুঁজে দেখি তিথীর এমন কোন কথা ছিল নাকি যা এখন সাহায্য করতে পারবে!
 
তিথীর বর্তমান ও স্থায়ী ঠিকানা দুইটাই ঢাকাতে ছিল। ঢাকার আজিমপুরে। আমার কথামত গতরাতেই সেখানে লোক পাঠানো হয়েছিল। মজার ব্যাপার হচ্ছে দেড় বছর আগেই নাকি তার বাড়ি বিক্রি করে চলে গেছে। আশেপাশের প্রতিবশীরাও জানে না তাদের কথা। হুট করে নাকি গায়েব হয়ে গেছে তারা। নতুন জায়গার মালিক বাড়িটাকে ডেভলপার কোম্পানির কাছে তুলে দিয়েছে। লোকটা বেশ প্রভাবশালী। নামঃ আমিনুর রহমান। সে দেশের বাইরে অবস্থান করায় তার সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হয় নি আজিমপুর থানা পুলিশের পক্ষে।
 
যাই হোক, এখন তিথীর একটা ব্যাপার খুব অদ্ভুত লাগছে আমার কাছে যেটা আগে কখনো মনে হয়নি। তিথী কখনো ওর চাচা- মামা, খালা ইত্যাদি পরিবারের কথা বলেনি আমাকে। ওর সাথে তিন বছরের সম্পর্ক থাকার পরেও আমি ওর ফ্যামিলির ব্যাপারে খুব বেশি কিছু জানি না। অবশ্য এ নিয়ে মাথা ব্যাথা ছিল না আমার। তিথীর বাবা ডাক্তার ছিলেন। বাড়ির নিচেই ওনার চেম্বার ছিল। এরবেশি কিছু জানি না তার বাবার ব্যাপারে। মা গৃহিণী আর তিথী তাদের একমাত্র সন্তান। সম্ভবত পরিবার না থাকায় সে ফ্রেন্ডদের কেই তার পরিবার বানিয়ে নিয়েছিল!
 
ভাবনায় ছেদ পড়ে কারণ আমার সহকারী এসআই মইনুল দুইটা ফাইল নিয়ে এসেছে।
“ স্যার, আপনি কালকে যে মোবাইলটা ল্যাবে পাঠিয়েছিলেন সেটার রিপোর্ট। আর মতিঝিল থানা পুলিশ আপনার নির্দেশমত সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করে পাঠিয়েছে। ” 
ফাইল দুটো নিয়ে উল্টে চললাম। মোবাইলের ব্যাপারে আহামরি কিছু জানা গেলো না। মোবাইলে এই সিমটা ঢুকানো হয় ঘটনার মাত্র একদিন আগে আর ওই নাম্বার থেকে অন্য কোথাও কল করা হয়নি। এমনকি মোবাইল অপারেটর ছাড়া ওই নাম্বারে অন্য কোন কল বা মেসেজও আসেনি। গত দেড় বছর ধরে নাম্বারটা অফ ছিল। এর মাঝে এই মোবাইলে অন্য সিম ব্যবহার করা হয়েছে কিনা সেটা বের করার জন্য কাজ চলছে। সেটা একটু সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। সাধারণত ৪৮ ঘণ্টার আগে রিপোর্ট পাওয়া যায় না।
 
দ্বিতীয় ফাইলে সিসিটিভি ফুটেজগুলো। সাথে প্রত্যক্ষদর্শী ও কলোনির মানুষদের জবানবন্দীর উপর বিশ্লেষণ করে রিপোর্ট দেওয়া হয়েছে। সেখানে সন্দেহভাজন ৪ জন ব্যক্তিকে চিহ্নিত করা হয়েছে। আশ্চর্যজনকভাবে দেখলাম একজন লোক আগে থেকেই পুলিশের ওয়ান্টেড লিস্টে। নামঃ বুলবুল। থমকে গেলাম আমি! এই সেই বুলবুল যাকে এডিএসইউয়ের সদস্যরা গত দুই বছর ধরে খুঁজে চলেছে। ড্রাগ মাফিয়া যার আসল নাম কেউ জানে না, গোপন সূত্রে জানা গেছে তার কোড নেম জেনারেল, তার ডান হাত হচ্ছে এই বুলবুল। পুরা ঢাকার ড্রাগের ব্যবসা তার নিয়ন্ত্রণে। লোকটা যেন ছায়ার মত ভেসে বেড়ায়। আরো একটা ব্যাপার লোকটা সকল কাজ নিজে করে। যে কারণে তার দলের কাউকে আটক বা গ্রেফতার করে কখনো তার হদিস পাওয়া যায় না। আচ্ছা বুলবুলই কি তবে তিথীর উপর গুলি করেছিল! অসম্ভব! এরকম অপরাধী কেন তিথীর মত একজন সাধারণ মেয়েকে খুন করতে যাবে!
 
চিন্তা বাদ দিয়ে সেই ৪ ব্যক্তির ভিডিও বারবার দেখতে থাকলাম। বিশেষ করে বুলবুলের ভিডিওটা। প্রথম দুইবার কিছুই চোখে পড়েনি। কিন্তু তৃতীয়বারের সময় আরামবাগ বাস কাউন্টারের সামনের ক্যামেরা থেকে ফুটেজে পকেটের ভিতর থেকে একটা ধাতব বস্তু উকিঁ দিচ্ছে। মনে হচ্ছে পিস্তল। তাও নিশ্চিত হওয়ার জন্য ল্যাবে পাঠানোর নির্দেশ দিলাম।
 
ভয়ংকর এক লোক এই বুলবুল। এর সাথে পাংগা নিতে যাওয়াটা খুবই ভয়াবহ হবে। কিন্তু এই মুহুর্তে আমি আশা করছি যেন তিথীকে হত্যার চেষ্টা এই লোকই করে। তাহলেই কেসটা চলে আসবে আমার আয়ত্বে। একবার যদি আমার আয়ত্বে আসে তাহলে প্রয়োজনে সকল ক্ষমতা প্রয়োগ করব আমি।
দরকার হলে জীবন যাবে কিন্তু তাও আমাকে বের করতে হবে কেন এই সাধারণ মেয়েটাকে হত্যা করতে চেয়েছিল এক ভয়ংকর পেশাদার খুনি ও ড্রাগ ডিলার!
 
(চলবে)
0 Shares

১৩টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ