হাইকু

আরজু মুক্তা ১৬ আগস্ট ২০২০, রবিবার, ১০:৫৩:১৬অপরাহ্ন সাহিত্য ৪০ মন্তব্য
  1. হাইকু ( একবচনে হাইকি)  এক ধরণের সংক্ষিপ্ত জাপানি কবিতা। বলা যায় হাইকু পৃথিবীর ছোট কাব্য। জাপানি বড় কবিতার ক্ষুদ্রতম রূপ। হাইকু লিখিয়ে কবিদের বলা হয় হাইজিন।

হাইকুর বৈশিষ্ট্য :

# এখানে অন্তমিল মুখ্য নয়।

# মোট তিন লাইনের হবে।

# কোনো দাড়ি,  কমা থাকবে বা থাকবে না।

# প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ঋতু বৈচিত্রের উল্লেখ থাকবে।

# দুটি ভিন্ন চিত্রকল্পনা থাকবে।

# এ কবিতায় বিষয় ভাবনায় থাকবে গভীরতা।

# গঠন হবে ৫+৭+৫ মাত্রার অক্ষরের সিলেবলে গঠিত হবে।

এককথায়, বাক্য সংযম হাইকুর প্রাণ আর ভাষা সংহতি তার দেহ। গাছ, পাখি, ফুল, ফল হলো তার মুল উপাদান।

মাৎচুঅ বাসে ( ১৬৪৪---১৬৯৪) তানকা বা ওয়াকা কবিতা থেকে সম্পুর্ণ আলাদা করে ৫-৭-৫ অক্ষরের সিলেবলে নতুন ধরণের ক্ষুদ্র কবিতার প্রচলন করেন।

পরে মাসাওয়াকা ( ১৮৬৭---১৯০২) এবং বাশোর কবিতার নতুন নামকরণ করেন। যা হাইকু নামে পরিচিত লাভ করে।

ইনেনগু সাবুরো নামে জাপানের বিখ্যাত একজন "History  of Japanese  Cultural  1959" বইটিতে লিখেন যে হাইকু লেখার নিয়ম বেশ সিম্পল।  এখানে ১৭ টি অক্ষরের সিলেবল থাকে। এবং তিন ভাগে বিভক্ত থাকে। আমরা জানি যে, সিলেবল মানে জিহবার গতি না বদলিয়ে একেবারে উচ্চারণ সক্ষম শব্দ বা শব্দাংশ ; একস্তর বিশিষ্ট শব্দ বা শব্দাংশ। ছন্দ কবিতায় একস্তর বিশিষ্ট সিলেবল দেখা যায়। জাপানের বর্তমান জেনারেশন হিরাগানা অক্ষরে ৫-৭-৫ গুণেই লিখেন। আর এই হিরাগানা শব্দকেই " অনজি " বলে। তারা বলেন শব্দের rhythm মিলিয়ে লিখলেই চলবে।

নিচে কিছু উদাহরণ দেয়া হলো :

# বুসন

ছোট গ্রীষ্ম রাত

এক রোমশ শুঁয়া পোকার

পিঠে এক শিশির

# রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

পুরানো ডোবা

দাদুরি লাফালো যে

জলেতে ধ্বনি।

# তারিক  অনিকেত

বদন কই

ফোটালেই শুধু যে

কথার খই।

হাইকুর প্রাণপুরুষ, বিখ্যাত কবি বাশোর মত অনুযায়ী প্রতি হাইকু কবিতাতেই প্রকৃতির স্পর্শ  থাকতে হবে। এমনকি যখন ব্যক্তিগত আবেগকে কেন্দ্র করে হাইকু লেখা হয়, সেখানেও ঋতুর ইঙ্গিত প্রত্যাশা করা হয় এজন্য যে যখনই আবেগটি হাইকুতে রূপান্তরিত হয় ব্যক্তিগত আবেগ আর প্রকৃতির নৈর্বক্তিক অভিব্যক্তির মধ্য সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। " তাঁর একটি বিখ্যাত হাইকু হলো :

অনেক অনেক বিষয়

মনে পরে যায়

চেরির ফুটন্ত ফুলে।

"Narrow Roads in Oku"  যেখানে তার লিখা ৫০ টি হাইকু অধিকাংশই বিখ্যাত। এবং এটা জাপানি সাহিত্যে মূল্যবান সংযোজন বলে বিবেচিত।  ১৬৯৪ সালে মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তে শিষ্যদের ডেকে শেষ হাইকু শোনান। তা ছিলো :

" ভ্রমণে বেরিয়ে আসুন

মাঠে মাঠে সবকিছু বিশুদ্ধ

স্বপ্ন তবুও হেঁটে যায়। "

জাপানের পুরনো এবং আধুনিক সব কবিতার মধ্যে হাইকুই সবচেয়ে জনপ্রিয়। সপ্তদশ শতকে এর যে যাত্রা শুরু হয়েছে আজও তার যবনিকাপাত হয়নি। প্রতিটি শহরে হাইকু ক্লাব আছে। যেখানে, সদস্যরা নিয়মিত মিলিত হয়ে কবিতা পাঠ করে শোনান।

টোকিওতে হাইকু মিউজিয়াম আছে। যেখানে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রকাশিত হাইকুর উপর বই ও পত্রিকা সংরক্ষিত আছে। আর কোনো সাহিত্যিক ফর্ম নিয়ে এমন আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আন্দোলন ও চর্চা হয়নি।

হাইকুতে প্রকৃতিপ্রেম আধ্যাত্মিকতা এবং দার্শনিকতা একাকার হয়ে যায়। হাইকুর বিভিন্ন পরতে পরতে অর্থের যে বিভিন্নতা তার মধ্যে ঐক্যসুত্র থাকে। যার জন্য একটি পরতের অর্থ থেকে পরবর্তী পরতের অর্থের দিকে যাত্রা হয় সহজ ও স্বাভাবিক। এটা একটা ধ্যানের পর্যায়ে পরে। এই ধ্যান মানুষকে বিবাগি করেনা, জীবন ও জগৎ সম্পর্কে নতুন উপলব্ধির ভিত্তিতে মানসিক প্রশান্তি এনে দেয়। এই প্রশান্তিকেই বলা হয়েছে হাইকু অভিজ্ঞতা। যা হাইকু মানসিকতার সৃষ্টি।

ঠিক কবে,  হাইকু কবিতা লেখা হয়েছে তার নির্ভরশীল তথ্য নেই। এক হিসেবে ত্রয়োদশ শতকের প্রথমদিকে হাইকু লেখা শুরু হয়।

ফুজিওয়ারানো সাদাই রচিত একটি হাইকু (১২৩৫) নীচে দেয়া হলো:

চেরি ফুলের পাপড়ি

বাতাসে নড়ছে ফুর্তিতে

ধেয়ে আসে ঝড়।

এরপর, ষষ্ঠদশ শতাব্দীর দুই খ্যাতনামা হাইকু কবি ছিলেন মরিটাকে (১৪৫২---১৫৪০) এবং সোকনে (১৪৬৫--১৫৪০)

মরিটাকির হাইকু :

পড়ে যাওয়া পাপড়ি আসে উড়ে

আগের ডালে ডালে

ওহ! প্রজাপতি সব।

Qubaishi Issa ( 1762---1826)

In my old home

which I forsooks, the cherries

are in bloom.

এটা বাংলায় লিখলে :

যে/ ঘ/ র/ ছে / ড়ে

এ / সে / ছি / সে / থা/ আ / জ

চে / রি / ফু / টে / ছে।

তিন লাইনের ১৭ মাত্রার কবিতা। মাত্রা ভাগ ৫-৭-৫।

বাংলা হাইকু রচনায় উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিরা হলেন দুলাল বিশ্বাস,  রহিমা আক্তার কল্পনা (৩০০ হাইকু) ,  বুদ্ধদেব চ্যাটার্জি, আসাদ চৌধুরী, হাসনাত আবদুল হাই, জগলুল হায়দার, আবিদ আনোয়ার, রইম মনরম, প্রমুখ। ২০ হাজার হাইকু লিখেছেন মহিউদ্দিন মোহাম্মদ।

কবি রইস মনরম তাঁর " একমুঠো হাইকু " কাব্যগ্রন্থে ৪০ টি হাইকু তে মাত্রা ছয় ঋতু বা প্রকৃতির ছবি উপমা রূপক চিত্রকল্পের সাহায্যে ফুটিয়ে তোলার ক্ষেত্রে প্রাজ্ঞতার পরিচয় দিয়েছেন। এমন মুন্সিয়ানা ভাবনা পাঠককে করবে আলোড়িত।  কী সুন্দর ভাবে অসীমকে সসীমের মাঝে তুলে ধরেছেন! যেমন :

এক ফোটা শিশির

সকালের সূর্যটাকে

বুকে নিয়ে স্থির।

এই হাইকুটা স্বরবৃত্ত ছন্দে রচিত।

বাশোর উক্তি এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করার মতো। " এক জীবনে যিনি ৩ থেকে ৫ টি প্রকৃত হাইকু লিখতে পাবেন তিনিই হাইকু কবি। আর ১০ টি লিখতে পারলেই হাইকু মাস্টার। "

কবি রইস মনরম যে সফল হাইকু মাস্টার তাতে সন্দেহ নেই। তাঁর একটি হাইকু :

ঝিনুক বুক---৫

নিভৃতে বাড়ে মুক্তো---৭

বাড়ে অসুখ----৫

মোট ১৭! এটি মাত্রাবৃত্ত ছন্দে। এটিতে আছে গভীরতার ছাপ।

আমরা জানি, ঝিনুক থেকে মুক্তো আসে। এবং সেটি ঝিনুকের বুকেই সবার অলক্ষে আড়ালে আবডালে জন্মায়। আমরা ঝিনুক থেকে পাওয়া মুক্তো দেখে উল্লসিত হই। অথচ একবারও ভাবিনা যে ঝিনুকের বুকে মুক্তো হওয়া মানেই তার বুকের ভিতর সর্বদাই অনুভুত হচ্ছে তীব্র যন্ত্রণা। এখানে বৃহৎ একটি ভাবনাকে কবি ক্ষুদ্রতর কথামালার দ্বারা প্রকাশ করেছেন। আর সেই ভাবনাটিই হলো হাইকু।

আর একটি :

শীতার্ত ঘুম

ভেঙ্গে ভেঙ্গে উঠুক

সূর্য কুসুম।

এটা অক্ষর বৃত্ত। এক কথায় তাঁর হাইকু সমস্ত নিয়ম মেনে চলেছে। তাঁর " এক মুঠো হাইকু" অপূর্ব সৃষ্টি।

হাইকু মানসিকতার হতে হলে, একজন কবি বা ব্যক্তিকে অভিজ্ঞতার জন্যই একটি অভিজ্ঞতা অর্জনের উদ্দেশ্যে প্রস্তুত থাকতে হয়। বিষয়ের সঙ্গে ব্যক্তিসত্তা মিশে অভিন্ন হয়ে গেলেই ব্যক্তিগত আবেগ বা অনুভূতি গঠন হয়ে যায় এবং প্রকৃতি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাকে আত্মস্থ করে বিশ্বজনীনতায় পৌঁছে দিতে পারে। হাইকুর সৌন্দর্য এবং আকর্ষণ ব্যক্তিক থেকে নৈর্ব্যক্তিককে রূপান্তরের এই ক্ষমতার জন্যই অনেকটা কেবল লেখা শেষে নয়, লেখার শুরু থেকে আত্মার শান্তির আর মনের প্রশান্তি অর্জনের এক নির্মল মাধ্যম হাইকু পড়া আর লেখা।

 

0 Shares

৪০টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ