সবাই হরির মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে হয়তো হরি কোনো উচিত জবাব দেবে। কিন্তু  হরি কিছুই বলে না, মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। সবাই হতাশ হয়ে নেতিয়ে পড়ে। হঠাৎ হরি কথা বলে উঠে...।

হরি: স্যার হামনিককে অশিক্ষিত ছোটকা  জাতকে  আদমি। প্যাটে লাথ না মারবোকো স্যার।

হরির এই অপ্রত্যাশিত কথায় সবাই ভূত দেখার মতো চমকে উঠে। যুদ্ধক্ষেত্রে সেনাপতি স্বকণ্ঠে পরাজয়ের ঘোষণা দিলে সাধারণ সৈনিকগণ কি নাজুক আর অপমানজনক পরিস্থিতির মধ্যেই না পতিত হয়! হরির হেরে যাওয়া হেডমাস্টার বদিউজ্জামানের বিজয়।

কানাই: হরি!
হরি: তে চুপ কর কানাই। হামার জানানা লেইকা ফেইকা যব ভুখারহি তেকা উনিকে মুমে খানা উঠাকে দিয়া সখবে? না সখবে। হামনিককে ছোটকা জাত হোলি হামনিককে সাহেব হোকেকে স্বপ্না দেখেছে না চলি।
রামদাস: একের খাতির তে এতনা বড়কা অন্যাই মানলেবে।
হরি: কাথিকে অন্যাই। সাচ্চা বাত মানলিয়েছে কোনো অন্যাই নেইখে। হামনিককে ছোটকা জাত হোলি, হামনিককে লেইকা ফেইকা কোনোদিন সাহেব না হই, এইটা সাচ্চা বাত। আর তনিককে যাহা করে মাঙ্গোতারে ওঠো ঝুঠহো মরিচীকা। সাচ্চাঠো মানলিয়েছে দোষকে কাবায়।

রামদাস স্বজাতির বেঈমানীতে লজ্জিত হয়।

হরি: স্যার মালিক হইয়া চাকরের প্রতি নির্দয় হবেন না স্যার! স্যার...।

হেডমাস্টার বদিউজ্জামান চালের গুটি পেয়েছে এই ভেবে হরির কোনো কথায় কর্ণপাত না করে সোজা উল্টা ঘুরে চলে যায়। পেছনে পেছনে নেওটে বিড়াল সদৃশ্য কেদারনাথ। তখন হরির পিছন থেকে রণে ভঙ্গ দেওয়ার লজ্জা আর অপমানে রামদাসসহ ডোমপাড়ার সবাই নিঃশব্দে ফিরে যাওয়া শুরু করে। হরি দৌড়ে গিয়ে ওদের সামনে এসে দাঁড়ায়।

হরি: রামদা রামদা! হামরেকে তু মাফ কারদো! তুলুক সবকই হামরেকে মাফ করদো! রামদা!

রামদাস ধাক্কা মেরে হরিকে সরিয়ে দিয়ে হাঁটতে থাকে। হরি হাঁটু গেড়ে বসে উন্মাদের মতো চিৎকার করে কাঁদতে থাকে। ডোমপাড়ার মানুষরা হরির প্রতি আকণ্ঠ ঘৃণা আর মনোভঙ্গের তীব্র বেদনা নিয়ে রামদাসের পেছনে পেছনে পথ চলতে থাকে। তারা আর এক মুহূর্ত যেনো ডোমপাড়ার বাইরের সাহেবদের জগতে থাকতে চায় না। যে ডোমপাড়ায় তাদের পিতামহ-প্রপিতামহ বহুদূর অতীতে গত হয়েছে, ছোটজাতের গ্লানি বুকে নিয়ে আজও যাদের অতৃপ্ত আত্মা অশ্রুসজল চোখে ঘুরে বেড়ায় অশরীরি। সেখানে দ্রুত ফিরে যেতে চায় তারা, অশরীরি পিতা-পিতামহ-প্রপিতামহের কোলে। সবাই চলে গেলে হেডমাস্টার বদিউজ্জামানের পিয়ন কেদারনাথ এসে হাজির হয় হরির কাছে।

কেদারনাথ: হরি, এই হরি। হেডস্যার তোকে ডাকছে।
হরি: হ্যাঁ সত্যই হেডস্যার ডাকছে আমারে কেদারবাবু? আমার চাকরিটা তাইলে বহাল থাকবো বাবু?
কেদারনাথ: আরে আয় আমার সাথে। হেডস্যার খুব দয়ালু মানুষ। তোর মতো একটা ছোটজাতের মানুষের পেটে লাত্থি মাইরা তার কি লাভ বল? হেডস্যার কি তগো মতো মাছি মাইরা হাত কালা করবো? আয়, আয়...।

হেডস্যারের রুমের সামনে হরিকে দাঁড় করিয়ে কেদারনাথ ভেতরে ঢুকে তড়িৎ গতিতে বের হয়ে এসে হরিকে ডাকে।

কেদারনাথ: আয় আয় ভেতরে আয়।
হরি: স্যার আসমু? গোড় লাগতি।
হেডস্যার: আয় আয়। তোরা বাবা আমাকে যতোটা নিষ্ঠুর ভাবিস অতটা নিষ্ঠুর আমি না বুঝলি। তোরা অযথাই আমাকে ভুল বুঝিস।
হরি: আমার চাকরিটা ফেরত পামু তো স্যার?
কেদারনাথ: আরে ধ্যুত পাগল! স্যার রাগের মাথায় কি না কি বলছেন সেটাই তোর কাছে বড় হয়ে গেলো, স্যারের ভেতরটা দেখলি না?
হরি: স্যার আমারে মাফ কইরা দেন স্যার। আমার ভুল হইয়া গেছে।
হেডস্যার: তোকে আমি তখনই মাফ করে দিয়েছি। তর চাকরিও ফেরৎ পাবি।
কেদারনাথ: কিন্তু স্যারের একটা কাজ কইরা দিতে হইবো। পারবি?
হরি: স্যারের জন্য আমি সবকিছু করতে পারুম।
হেডস্যার: তাহলে এক কাজ কর। আমার কপালের ঠিক এইখানে ঐ লাঠিটা দিয়ে একটা বাড়ি দে। তোর চাকরি ফেরৎ পাবি। পারবি না?
হরি: এইডা কি কন স্যার! এইডা ক্যামনে সম্ভব? সার কি আমার লগে মশকরা করতাছেন?
কেদারনাথ: বেদ্দপের মতো কথা বলিসনা হরি। স্যার করবো তর লগে মশকরা? বেদ্দপ। কপালে বাড়ি দিয়া চাকরি ফেরৎ বাপের জন্মে দেখছোস? স্যার যা বলছেন তাই কর।

হরি হেডস্যারের রুমে রাখা গজারী লাঠিটা হাতে তুলে নেয়। সে ঠিক বুঝতে পারছেনা কি হচ্ছে এসব। হরি মানসিক প্রস্তুতি নেয়। কপালে বাড়ি দিতে যাবে এমন সময় হেডস্যার তাকে থামিয়ে দেয়।

হেডস্যার: এই থাম থাম কেদারনাথ। আমার কপালের এইখানে একটা চিহ্ন এঁকে দে।
কেদারনাথ: চিহ্ন আবার কেন স্যার?
হেডস্যার: হরি এই চিহ্ন বরাবর বারি দিবি। অন্য জায়গায় বারি পড়লে তো মারা যেতে পারি তাই না। চিহ্ন আঁক।

কেদারনাথ দ্রুত চক দিয়ে বদিউজ্জামানের কপালে একটা চিহ্ন এঁকে দেয়।

কেদারনাথ: স্যার আপনার মাথায় এতো বুদ্ধি। আসলে বিদ্বান লোকের মাথাই আলাদা। হেঃ হেঃ হেঃ।
হেডস্যার: ঠিকমতো চিহ্ন এঁকেছিস তো?
কেদারনাথ: সে আর বলতে স্যার।
হেডস্যার: দে হরি এইবার এই চিহ্ন বরাবর বারি দে। রেডি ওয়ান টু থ্রি।

হরি কোনোকিছু না ভেবে বোধশূন্যের মতো চিহ্ন বরাবর কষে গজারী লাঠি দিয়ে বারি মারে।  হেডস্যার বদিউজ্জামান চিৎকার করে উঠে, ‘ও মাগো-বাবাগো আমায় মেরে ফেললো গো।’ হেডস্যারের কপাল ফেটে রক্ত ঝরে। কেদারনাথ তাড়াতাড়ি গিয়ে কক্ষের দরজায় খিল এঁটে বন্ধ করে দেয়। হরি বোকা বনে যায়।

হরি: দরজা বন্ধ করতাছেন ক্যান বাবু?
কেদারনাথ: এইবার হবে খেল্।
হেডস্যার: উহ্, আহ্...। হরি তুই আমার সাথে থানায় যাবি? থানায় গিয়ে বলবি রামদাস আমার মাথায় বারি দিছে। আর তোর সাথে যারা যারা ছিলো তাদের নাম বলবি। বলবি যে ওরা সবাই আমার উপড় চড়াও হইছিলো।
হরি: এইডা কি কইলেন স্যার! নিজের জাতের সাথে বেঈমানী। এইডা আমি পারুম না স্যার।
হেডস্যার: বলতে যে তোকে হবেই হরি। না হলে আমি থানায় গিয়া বলবো তুই আমার মাথায় বাড়ি দিছোস। কেদারনাথ সাক্ষী। এটেম্পট টু মার্ডারের কেসে যাবৎজ্জীবন কারাদণ্ড হয়ে যাবে। সারাজীবন জেলে পঁচে মরবি। ভেবে দেখ হরি।
কেদারনাথ: এতো কি চিন্তা করতেছিস হরি? হরি জীবনে বড় কিছু পাইতে হইলে কোথাও না কোথাও বেঈমানী করতে হয়, কাউকে না কাউকে ঠকাতে হয়। সবাই তাই করে, স্বীকার করে না, এটাই পৃথিবীর নিয়ম।
হরি: তাই বইল্যা নিজের জাতের সঙ্গে?
কেদারনাথ: আরে রাখ তোর জাত। জাত কি তোর পেটে দিবে ভাত?
হেডস্যার: ওকে আর তেলানোর দরকার নাই। চল কেদারনাথ আমরা থানায় যাই। শালা ছোটলোক, জাত নিয়েই থাকুক।

হরি বুকে পাথর চাপা যন্ত্রণা চেপে অবশেষে মুখ খুলে।

হরি: ঠিক আছে স্যার। আমি রাজি। তবে কামটা বেঈমানী হইলো। অন্যায় হইলো।
কেদারনাথ: পৃথিবীতে ন্যায়-অন্যায় বলতে কিছু নাই। একজনের কাছে যা ন্যায় অন্যজনের কাছে তা অন্যায়। মানুষের মধ্যে যারা ক্ষমতাশালী তারাই নিজের সুবিধামতো ন্যায়-অন্যায়ের সংজ্ঞা বানায়। ন্যায়-অন্যায়ের বিচার তোর আমার মতো ছোট মানুষের কাজ না।
হেডমাস্টার: আরে এই কেদারনাথ, ওরে এতো নীতিকথা শুনিয়ে লাভ কি? চল তাড়তাড়ি থানায় চল।
কেদারনাথ: জ্বী স্যার চলেন। চল হরি।

(........................................চলবে)

আগের পর্বগুলোর লিংক:

১. http://www.sonelablog.com/archives/12440

২. http://www.sonelablog.com/archives/12475

৩. http://www.sonelablog.com/archives/12531

৪. http://www.sonelablog.com/archives/12788

৫. http://www.sonelablog.com/archives/12859

৬. http://www.sonelablog.com/archives/12944

৭. http://www.sonelablog.com/archives/13003

৮. http://www.sonelablog.com/archives/13126

0 Shares

৮টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ