এপ্রিলের হালকা শীতের স্নিগ্ধ সকাল। এ দেশে আমার প্রথম সকাল। ঘুম ভাঙ্গে কলিং বেলের কর্কশ শব্দে। এক চায়নিজ যুবক এলো বিশালাকার দুটি লণ্ড্রী ব্যাগ নিয়ে। আমরা যে আত্মীয়ের বাসায় উঠেছিলাম, সে বাসার অ্যান্টি এগিয়ে গেলো সদর দরজায়। ব্যাগ দুটি বুঝে নিলো। জানলাম ব্যাগ ভর্তি কাপড়। নির্দিষ্ট মাপের করে কাটা। সম্ভবত ১২ ইঞ্চি বাই ৩ ইঞ্চি করে একই মাপের নানান রকম কাপড়। আন্টির বেইজমেন্টে বেশ অনেকগুলো সেলাই মেশিন। কাপড়গুলো লম্বালম্বি দুই ভাঁজ করে সেলাই করে দেয় ক'জন বাংলাদেশি এবং ভারতীয় নারী। পরদিন আরো কিছু নারী এসে সেগুলো নিয়ে যান। বাড়িতে বসে তাঁরা সেগুলোয় ইলাস্টিক ঢুকিয়ে গিঁট দিয়ে সেলাই করে মুখ বন্ধ করে দিতেন। ব্যাস, হয়ে যেতো সুন্দর চুলের ব্যান্ড। সেইসব ফেরত দিয়ে তাঁরা পেতেন ডজন প্রতি ৩০ সেন্টস। আর যারা লম্বালম্বি সেলাই করে দিতেন, তাঁরা পেতেন ডজন প্রতি ১৫ সেন্টস। এইসব দেখে দেখে ক'দিন অলস সময় কাটে আমার। বেকার বসে থাকতে ভালো লাগছিল না। কিছু একটা করার জন্যে উদগ্রীব ছিলাম। কিন্তু এদেশের ভাষা আয়ত্তে নেই, কাজের অভিজ্ঞতা নেই। কোথায় কাজ খুঁজবো ? তখন তো আর এখনকার মতো এত বাংলাদেশি ছিল না। কাজ পাওয়াটাও সহজ ছিল না। উপায় না পেয়ে আন্টির ওখানেই কাজে লেগে গেলাম। দুই ভাঁজ করে কাপড়গুলো সেলাই করে দিতাম। কোন এক দুর্বোধ্য কারণে হাত চলতো দ্রুতবেগে। নেশার মতো সেলাই করছি তো করছি। কখন যে সময় গড়াতো, টেরই পেতাম না। সপ্তাহ শেষে হিসেব করে ডলার বুঝে পেতাম। বিদেশে সে-ই আমার প্রথম অর্থ উপার্জন। এটি একরকম আনন্দেরও। কেননা, আমি তখন হিসেব করতাম এক ডলার মানে চল্লিশ টাকা, একশো ডলার মানে চার হাজার টাকা। ভাবতাম, বাহ্‌ ভালোই তো অর্থ উপার্জন!

কিছুদিন পর আত্মীয়ের বাসা ছেড়ে ভাড়া বাসায় উঠি যখন, সে বাসার বাড়িওয়ালী আপার অনুরোধে তাঁদের তিনটি শিশু দেখাশোনার কাজ করি সকাল থেকে বিকাল অবধি মাত্র বিশ ডলারের বিনিময়ে। যদিও আমার সেখানে অলস সময় কাটানো ছাড়া করার মত কিছুই ছিল না। এখন মাঝে মাঝে সেইসব মনে পড়লে ভাবি, আমি কতোই না বোকা ছিলাম! বিদেশ বিভূঁইয়ে নতুন এলে সকলেই বোধ করি এমন বোকাই থাকে। অমায়িক ব্যবহারের হাসিখুশি সেই আপা তাঁর কর্মস্থল থেকে ফোন করে বাচ্চাদের খবরাখবর নিতেন যখন, বলতেন ফ্রিজে মিষ্টি আছে, খেয়ো কিন্তু। আমি সংকোচে খেতে চাইতাম না। একদিন জোর দিয়ে বললেন, আরে খাও খাও, আমার নিজের হাতে বানানো। আমি বিস্ময় নিয়ে কপালে কিঞ্চিত ভাঁজ ফেলে বলি, ঘরে বানানো! অথচ তার আগ অবধি আমার ধারণা ছিল, মিষ্টি কেবল নির্দিষ্ট কারিগররাই তৈরি করেন। এবার বেশ আগ্রহের সাথেই খেলাম। এ যে একেবারেই দোকানের তৈরি রসগোল্লা! ক'দিন বাদে শরতের রৌদ্রস্নাত এক দুপুরে আমার আত্মীয়ের বাসায় লাঞ্চের দাওয়াতে যাই। খাবারের পর তিনি যে মিষ্টান্ন পরিবেশন করেন, সবই তাঁর ঘরে তৈরি। আমি রাজ্যের উৎসাহ নিয়ে তাঁর কাছ থেকে শিখে নেই মিষ্টি বানানোর পদ্ধতি। পরবর্তীতে প্রতি উইকএন্ডে বাসায় বরের বন্ধুদের যে আড্ডা হতো, সেখানে ঘরে তৈরি রসগোল্লা, রসমালাই, কালো জাম থাকা চাই। আগেরদিন কাজ থেকে ফিরেই চলতো প্রস্তুতি। অতিথি আপ্যায়নে আমার আর বাইরে থেকে কখনোই কিনে আনতে হয়নি কিছু।

এদেশে পরিচয় হওয়া আরেকজন আপা শেখালেন মুড়ি বানানোর কৌশল। ছোটবেলায় বার্ষিক পরীক্ষা শেষে নানুবাড়ি যেতাম যখন, বালু দিয়ে মুড়ি বানানো দেখেছি সেইসব দিনে। কিন্তু এখানে শিখেছি অন্যভাবে। সামান্য পানি আর লবন দিয়ে চাল মাখিয়ে ফ্রাইপ্যানে টালতে হয় অল্প আঁচে। ঝরঝরে হয়ে এলে অন্য একটি কড়াইতে তেল গরম করতে হয় ভালোভাবে। অতঃপর একটি বড় ছাঁকনিতে অল্প চাল নিয়ে গরম তেলে তা ডুবিয়ে নিলে হুড়মুড় করে সব চাল ফুলে মুড়িতে রূপান্তরিত হয়। চালের এই মুড়িতে রূপান্তর আমায় যারপরনাই আনন্দিত ও বিস্মিত করে। যেন রাজ্য জয়ের আনন্দ! অতঃপর টেবিলে পরিত্যক্ত পেপার বিছিয়ে সেখানে ঢেলে দেই। আবার অল্প চাল ছাঁকনিতে রাখি, ডুবো তেলে ছাঁকনিটি ডুবাই, মুহূর্তেই ছাঁকনি ভর্তি মুড়ি হয়ে এলে পেপারে ঢেলে রাখি। যেন অসাধারণ এক কাজ করে ফেলেছি। জগতে এরচেয়ে সুন্দর এবং আনন্দের আর কিছু নেই। বানাতে থাকি, আরো, আরো। ছুটির দিনগুলোয় দিনভর, রাতভর বন্ধুদের আড্ডা চলতো, বিধায় আমি বিপুল উৎসাহ আর উদ্দীপনায় ছোলাবুট, পিয়াজু তৈরি করতাম। কেননা এইসব অনুষঙ্গ ছাড়া তো খালি মুড়ি পরিবেশন করা যায় না! কায়দা করে পরোটা, ডালপুরি তৈরি করে কীভাবে সংরক্ষণ করা যায়, তাও শিখে নেই।

একবার বেড়াতে গিয়েছিলাম এক বন্ধুর এপার্টমেন্ট বিল্ডিং এ। আমরা সন্ধ্যাকালীন চা, নাস্তার সময়ে গল্পে মশগুল। কলিং বেলের আওয়াজে দরজা খুললে দেখা গেলো একজন নারী কিছু প্যাকেট দিয়ে বিদায় হলেন। পরে জানতে পারলাম এপার্টমেন্টটিতে ৯০ ভাগ বাঙালি বসবাস করেন। অনেকেরই ছোটছোট সন্তান। বাইরে গিয়ে কাজ করার সুযোগ নেই তাঁদের। বিধায় তাঁরা ঘরে বসেই তৈরি করছেন নানান রকম সুস্বাদু খাবার। পরোটা ডালপুরি, সিঙ্গারা, সমুসা তৈরি করেন, এবং তা গ্রোসারি দোকানের চেয়ে কম মুল্যে প্রতিবেশী কর্মজীবী পরিবারগুলোর কাছে বিক্রি করেন। নিয়ম করে প্রতি সপ্তাহে প্রতিবেশিদের ঘরে ঘরে প্যাকেটগুলো দিয়ে আসেন। কেননা কর্মজীবী নারীদের এইসব খাবার নিজ হাতে ঘরে বানানোর সময় এবং সুযোগ হয়ে উঠে না। আরেকবার এক আপা এলেন দেশ থেকে স্বল্প সময়ের জন্যে। তিনি তাঁর চেনা স্বজনদের সাথে দেখা করছিলেন একে একে। এ কাজে আমি তাঁর সাহায্যকারী হিসেবে কাজ করছিলাম। এক বৃষ্টিস্নাত দুপুরের কিছু পরে উনাকে নিয়ে জ্যামাইকায় দাওয়াতে যাই। বৈকালিক চা নাস্তার দাওয়াত। চিতোই পিঠা এবং নানান পদের ভর্তা, সাথে রকমারি পিঠা টেবিলে পরিবেশন করা হয় সেখানে। যেন কোন পিঠা উৎসবে গিয়েছি। অথচ অতিথি মাত্র আমরা দুইজন! সবচেয়ে বড় বিস্ময় ছিল, প্রতিটি খাবারই বেশ সুস্বাদু এবং লোভনীয় ছিল। যেন নিপুন হাতের কোন কারিগরের তৈরি। খাবারের টেবিলে গল্পচ্ছলে জানতে পারি উনি আসলে একজন পিঠা কারিগর। ঘরে বসে জনপ্রিয় সব পিঠা এবং ভর্তা তৈরি করে গ্রোসারি দোকানগুলোতে বিক্রির জন্যে দিয়ে থাকেন। যারা সুদূর বাংলাদেশে পরিবার রেখে এসেছেন, কর্মব্যস্ত সময় কাটান, সেইসব ব্যাচেলররাই মূলত এইসব তৈরি খাবারের ক্রেতা।

সন্ধ্যার কিছু আগে আমরা যখন সেই বাড়িটি থেকে বাইরে বেরিয়ে আসি, ততক্ষণে আকাশ পরিস্কার হতে শুরু করেছে। দুই একটি কাঠবিড়ালি বেরিয়ে এসে গাছের এ ডাল ও ডালে ছুটোছুটি করছে। পোষা কুকুর নিয়ে পাশ কেটে হেঁটে গেছে এক বৃদ্ধ। শহরে আবারো সকলের ব্যস্ততা। বৃষ্টি শেষের ধরণি তখন শান্ত, সতেজ, নির্মল। বিদেশ বিভূঁইয়ে গৃহিণীরা অলস বসে নেই। যদিও তাঁদেরকে গৃহকর্মে সহযোগিতা করার কেউ নেই এদেশে। তবুও কেউ কেউ অর্থ সাশ্রয় করছেন ঘরে বসে নিজ হাতে পরিবারের জন্যে রকমারি খাবার তৈরি করে, কেউবা খানিকটা কায়দা করে অর্থ আয় করছেন। থেমে নেই কেউ। নদীর স্রোতধারা এবং মানুষ, এই দুইয়ের মাঝে কোন পার্থক্য নেই। দুই-ই বহমান। যান্ত্রিক এই শহরে আমাদের যাপিত জীবনকে বাইরে থেকে ছকে বাঁধা নিঃস্পৃহ জীবন মনে হয় হয়তো, কিন্তু মানুষের ভেতরে কিছু করবার স্বতঃস্ফূর্ত আগ্রহ এবং উদ্দীপনার কমতি নেই মোটেও।

রিমি রুম্মান
নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র

0 Shares

৮টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ