আমি খুব স্বপ্নবাজ একজন মানুষ। একজন স্বপ্নবাজ মা। প্রচন্ড স্বপ্ন দেখি আমি। সে স্বপ্নকে স্বপ্ন দেখা পর্যন্ত সীমাবদ্ধ রাখি না। তাকে প্রতিনিয়ত যত্ন করি। আমার সব স্বপ্ন আমার দুই সন্তানকে নিয়েই।
সন্তান বড় হবে, পুরো বিশ্বকে জানবে। তারা সমুদ্র সমান জ্ঞান অর্জন করবে, আমি তা সব সময় চাইতাম ও চাই। প্রচুর কথা বলতাম ছোটোবেলায় তাদের সাথে। এ নিয়ে জুলফিকার ও পরিবারের অনেকেই বলতো, কেমন করে আমি সারাদিন ওদের সাথে এমন করে কথা বলতে পারি!
একসময় টিভি দেখতাম বেশ। মেমন হওয়ার পরে ছেড়ে দিলাম। মেমন যেটা পছন্দ করতো তাই দেখতাম। পাপাই কার্টুন, টম এন্ড জেরি। মা ছেলে হি হি করে হাসতাম। এখন দেখি রিয়ানের সাথে মটু পাতলু। খুব প্রাণচঞ্চল এক ছেলে আমার। খুবই মিশুক প্রকৃতির। মেমন কথা খুব কম বলে। খুব সহজে কারো সাথে মিশতে পারে না। সে প্রচন্ড অভিমানী। এ কথা শুধু আমি জানি। দুঃখ পেলে সে মুখে হাসে ঠিকই। শুধু চোখ ভরা জল জমে থাকে। গাল বেয়ে পড়ে না। সে কান্নায় কোনো শব্দ নেই। অসহায়ের মতো তাকিয়ে থাকে। তার এ দিকটা মায়ের মতো। প্রচন্ড দুঃখ পেয়ে অসহায়ের মতো চুপ করে বসে থাকি। অপরপক্ষ মনে করে হয়তো কোনো প্রভাব পড়েনি। এটা মনে করে আঘাতের পরিমাণ তাদের বেড়ে যায়। কিন্তু কতোটা প্রভাব পড়েছে তা শুধু এ মন জানে। তবে মেমন মোটেও আমার মতো প্রতিবাদী হয়নি। আমি কখনো কখনো প্রতিবাদ করি।রিয়ান আবার যা তার মনে তা সরাসরি বলে ফেলে।

তারা প্রচন্ড ভালবাসার মাঝে বড় হবে সে চেষ্টা করেছি সব সময়। বৈরি পরিবেশ সামনে আসেনি যে তা নয়, এসেছে। ছুঁড়ে ফেলেছি মুহূর্তে তা। হঠাৎ হোঁচটে হাতে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে গেছি। বাচ্চাদের দুই হাতের মুঠে পুরে স্বপ্নের পিছনে দৌড়ে গেছি।
তাদের সামনে উপস্থাপন করেছি বড় বড় সব মানুষদের আদর্শবান কথা। উপরে উঠার সিঁড়ির ধাপগুলো ব্যাখ্যা করেছি। মুগ্ধ হয়ে শুনতো। শুনতে শুনতে একসময় ঘুমিয়ে যেতো। মেমন খুব ভালো শ্রোতা। সে খুব মনোযোগ দিয়ে শোনে। ওর চিন্তাভাবনা একমাত্র আমি বুঝতে পারি। মুচকি হাসির এক ছেলে আমার। আমি চাইতাম তারা চিন্তা করবে অন্যরকম। গতানুগতিক প্রাইভেট, কোচিং, শুধুমাত্র স্কুলের পাঠ্য বই এর বাইরেও যে বিশাল জ্ঞান ভান্ডার আছে তা তাদের সামনে আনার চেষ্টা করেছি তাই। তাদের জন্মদিন বা ছোটোখাটো প্রাপ্তিতে বই তুলে দিয়েছি হাতে। হাতে তুলে দিয়েছি ডায়রি। গল্পের সারমর্ম লিখতে দিয়ে সে কখন যেনো ঠিকই একটা গল্প দাঁড় করিয়ে ফেলতো। আমি মা হয়ে অবাক হয়ে জড়িয়ে ধরতাম ওর মুখটা। সবাই বলে মেমন মায়ের বাধ্য সন্তান। সত্যিই তাই, আজ পর্যন্ত ওর কাছে আমি যা চেয়েছি তা ও আমাকে দিয়েছে।
ছোট্ট সেই মেমন আমার আজ ক্লাস নাইনে উঠে গেছে। এবার বই মেলায় তার বই বের হচ্ছে। অনেকের মনে প্রশ্ন আসতে পারে, লিখতে পারে বলেই কি বই বের করতে হবে? বিষয়টা ঠিক তেমন নয়।
আমি প্রচন্ড আশাবাদী একজন মানুষ। তবু কোথা থেকে এক হতাশা আমাকে ঘিরে ধরে। আমি যখন দেখি রাস্তার ধারে ঘাড়ে ব্যাগ নিয়ে একটু একটু ছেলেমেয়ে পাড়ার মোড়ের দোকানে বসে আড্ডা মারছে বা ফোনে অশ্লিল কিছু শেয়ার করছে, কখনো বা কিশোর গ্যাঙ তৈরি করছে। একই ক্লাসের সহপাঠি মেয়ে বন্ধুকে নিয়ে মারামারি হচ্ছে। এসব দেখে আৎকে উঠি আমি। ফেসবুকে ক্লাস সেভেন সিক্সের বাচ্চা স্টাটাস দেয়,' আজ থেকে অতীত ভুলে গেলাম!'
এসব দেখে বুকের কোথাও একমুহূর্ত বাতাস শূন্য হয়ে যায় আমার।

একটা গল্প দিয়ে উদাহরণটা দিতে চাই।
আমি তখন ঢাকা শ্যামলীতে। আমার নীচতলা বাসায় থাকতো এক পরিবার। দুই ছেলে, প্রিন্স পিয়াস। আমার তখন মেমন রিয়ান হয়নি। প্রথম সন্তান হারানো শোক নিয়ে দিন কাটাচ্ছি। আমার মা ঐ দুই বাচ্চাকে দেখে মনে মনে ভাবতো, আমারো যেনো দুই ছেলে হয়।
ঢাকার ঐ বাসাতে আমি সাড়ে সাত বছর ছিলাম। প্রিন্স পিয়াস ওরা দুই ভাইও আস্তে আস্তে বড় হতে লাগলো। আল্লাহর রহমত ও আমার মায়ের দোয়া কবুল হওয়াতে আমার দুই ছেলে ঐ বাসাতেই হলো। প্রিন্স ছেলেটা রেসিডেন্সিয়াল স্কুলে ভর্তি হলো। বেশ ভালো স্টুডেন্ট ছিলো। আমি খেয়াল করতাম ওর মা কখনোই বাচ্চাগুলোকে দেখতো না। কখন স্কুলে গেলো বা কোথায় গেলো কোনো খেয়াল নেই। সারাক্ষন স্বামীর সাথে ঝগড়া করতো। তার চিৎকার আমি তিনতলা থেকে শুনতে পেতাম। একসময় ছেলেটাকে দেখলাম মোড়ে সিগারেট টানছে। আমার কলিজা পুরো পানি শূণ্য হয়ে গেলো। চোখের সামনে ফুটফুটে বাচ্চা দুটোকে নষ্ট হয়ে যেতে দেখলাম।
ঠিক অনেক কারণে আমি চেয়েছি তারা নিজেকে জানুক। তাদের কি পাওয়া উচিৎ তা তারা জানুক। জীবনের বাস্তবতাটাকে বুঝতে শিখুক। স্বপ্ন দেখুক। আর স্বপ্নকে যত্ন করতে শিখুক।
মেমন এবার কলেজ ছুটিতে এসে যেনো আরো উৎসাহের সাথে বাকী তার অসম্পূর্ণ লেখাগুলো শেষ করতে পারে এবং নতুন ভাবনা তৈরি করতে পারে তাই আসলে এবার বই বের করে দেয়া।
মেমনকে বই কিনে দিতে দিতে কখন যে সল্প পরিসরের এক লাইব্রেরি দাঁড়িয়ে গেছে টেরই পাইনি। মেমন কোনো বই পড়লে তা আমি আলোচনা করি। আমি যে বই পড়ে ওর সাথে আলোচনা করতে পারব তা শেয়ার করি। আমি চাই তারা অনন্তকাল বেঁচে থাকবে তাদের কর্মগুণে মানুষের ভালবাসায় পৃথিবীর আয়ুকাল পর্যন্ত।
নোটঃ যে যতো কথাই বলুক না কেনো। নতুন এ প্রজন্ম সহজলভ্য প্রযুক্তি পেয়ে কতোটা ম্যানার্স শিখেছে তা খুঁজে দেখার সময় এসেছে। কতোটুকু সময় আসলে দিচ্ছি আমরা বাচ্চাকে? স্বামী সারাদিন অফিস কি করলো, তার কৈফিয়ত আমরা সন্তানের সামনে জিজ্ঞেস করছি। অনেকের ভাষা এমন থাকে,' কেনো দেরি হলো কোথায় কার সাথে কি করছিলা?'
সংসারের নিত্য অমলিন খসড়া খাতা মেলে ধরছি সন্তানের সামনে। সন্তান সরে যাচ্ছে মা বাবা পরিবার থেকে। একটুকরো সুখ খুঁজে নিচ্ছে বাইরে থেকে। একসময় সে পুরোপুরি বাইরমুখিই হয়ে যাচ্ছে।
প্রতিটা মানুষের একটা নিজস্ব জানলা আছে। সে জানলা থেকে সে কতোটুকু কোন বাতাস নিয়ে আসবে তা তার সম্পূর্ণ অধিকারে থাকা উচিৎ। ঋতু পরিবর্তন হবে ঋতুর নিয়মেই। দক্ষিণা বাতাস যেমন আরাম দেয় তেমনি উত্তরের বাতাসে না হয় লেপের ওমে ঘর গরম করে রাখি। অযথা সে জানলায় উঁকি মেরে দেখার দরকার কি কখন দক্ষিণা বাতাস ছাড়বে এ জানলা!
বেড়ে উঠুক সন্তান প্রচন্ড ভালবাসায়। পৃথিবীটা হোক ভালবাসাময়।

,,,রিতু,,, 25.11.18. কুড়িগ্রাম

0 Shares

১৫টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ