বঙ্গবন্ধু প্রথমতঃ বাংলাদেশের স্বাধীনতা চান নি।

বঙ্গবন্ধু ঘোষিত ৬ দফা দাবীর কোথাও স্বাধীনতার দাবী ছিলনা, তিনি ছয় দফায় পূর্ব পাকিস্তানের আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন চেয়েছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষা করে বাঙ্গালীর নিজস্ব শাসনক্ষমতা। এর আগে  ৫৪-এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন আন্দোলন ঘনীভূত হয়ে উঠেছিল কিন্তু সেটা শেষ পর্যন্ত আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবীতে পর্যবসিত হয়।

১৯৬৬ সালে ৫ ও ৬ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের লাহোরে অনুষ্ঠিত বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর এক সম্মেলনে বাংলার প্রাণপ্রিয় নেতা আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ৬ দফা দাবি পেশ করেন।  ওই সম্মেলনে উপস্থিত  ছিলেন ৭৪০ জন প্রতিনিধি। পূর্ব পাকিস্তান থেকে উপস্থিত  ছিলেন মাত্র ২১ জন, এর মধ্য বঙ্গবন্ধুসহ  আওয়ামী লীগের পাঁচ জন। দফা দাবি উত্থাপন করা হলে উপস্থিত ৭৩৫ জন প্রতিনিধি তা তাৎক্ষণিকভাবে নাকচ করে দেন। লক্ষ্য করুন, এ দেশের ২১ জন প্রতিনিধির মধ্য মাত্র পাঁচ জন ছয়দফার পক্ষে ছিলেন আর বাঁকিরা সাথে সাথে ছয়দফা নাকচ করে দেন।   ছয় দফার দাবির মূল লক্ষ্য ছিল পাকিস্তান হবে একটি যৌথরাষ্ট্র এবং এই কর্মসূচীর ভিত্তিতে পাকিস্তান নামক যৌথরাষ্ট্রের প্রতিটি অঙ্গরাজ্যকে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন দিতে হবে।  লাহোরে অনুষ্ঠিত সম্মেলনের সভাপতি চৌধুরী মোহাম্মদ আলী ছয় দফা দাবি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনায় অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করলে ১১ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে এসে ঢাকা বিমানবন্দরে সংবাদ সম্মেলনে এ বিষয়ে বিস্তারিত তুলে ধরেন।

আসুন দেখি ছয় দফা দাবীতে কি বলা হয়েছে।

প্রথম দফা : সরকারের বৈশিষ্ট হবে Federal বা যৌথরাষ্ট্রীয় ও সংসদীয় পদ্ধতির; তাতে যৌথরাষ্ট্রের অঙ্গরাজ্যগুলো থেকে কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপক সভার নির্বাচন হবে প্রত্যক্ষ এবং সার্বজনীন প্রাপ্তবয়স্ক ভোটাধিকারের ভিত্তিতে। কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপক সভার প্রতিনিধি নির্বাচন জনসংখ্যারভিত্তিতে হবে।

দ্বিতীয় দফা : কেন্দ্রীয় সরকারের দায়িত্ব থাকবে কেবল প্রতিরক্ষা ও বৈদেশিক বিষয় এবং তৃতীয় দফায় ব্যবস্থিত শর্তসাপেক্ষ বিষয়।

তৃতীয় দফা : পুর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য দুটি পৃথক মুদ্রা-ব্যবস্থা চালু করতে হবে, যা পারস্পরিকভাবে কিংবা অবাধে উভয় অঞ্চলে বিনিময় করা চলবে। অথবা এর বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে একটি মুদ্রা-ব্যবস্থা চালু থাকতে পারে এই শর্তে যে, একটি কেন্দ্রীয় সংরক্ষণ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হবে, যার অধীনে দুই অঞ্চলে দুটি রিজার্ভ ব্যাংক থাকবে। তাতে এমন বিধান থাকতে হবে যেন এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে সম্পদ হস্তান্তর কিংবা মূলধন পাচার হতে না পারে।

চতুর্থ দফা : রাজস্ব ধার্য ও আদায়ের ক্ষমতা থাকবে অঙ্গরাজ্যগুলোর হাতে। প্রতিরক্ষা ও বৈদেশিক বিষয়ের ব্যয় নির্বাহের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারকে প্রয়োজনীয় রাজস্বের যোগান দেয়া হবে। সংবিধানে নির্দেশিত বিধানের বলে রাজস্বের এই নির্ধারিত অংশ স্বাভাবিকভাবেই কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে জমা হয়ে যাবে। এহেন সাংবিধানিক বিধানে এমন নিশ্চয়তা থাকবে যে, কেন্দ্রীয় সরকারের রাজস্বের প্রয়োজন মেটানোর ব্যাপারটি এমন একটি লক্ষ্যের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হতে হবে যেন রাজস্বনীতির উপর নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা নিশ্চিতভাবে অঙ্গরাজ্যগুলোর হাতে থাকে।

পঞ্চম দফা : যৌথরাষ্ট্রের প্রতিটি অঙ্গরাজ্য যে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করবে, সেই অঙ্গরাজ্যের সরকার যাতে স্বীয় নিয়ণ্ত্রনাধীনে তার পৃথক হিসাব রাখতে পারে, সংবিধানে সেরূপ বিধান থাকতে হবে। কেন্দ্রীয় সরকারের যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার প্রয়োজন হবে, সংবিধান নির্দেশিত বিধি অনুযায়ী নির্ধারিত অনুপাতের ভিত্তিতে অঙ্গরাজ্যগুলো থেকে তা আদায় করা হবে। সংবিধান নির্দেশিত বিধানানুযায়ী দেশের বৈদেশিক নীতির কাঠামোর মধ্যে, যার দায়িত্ব থাকবে কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে, বৈদেশিক বাণিজ্য ও বৈদেশিক সাহায্য সম্পর্কে চুক্তি সম্পাদনের ক্ষমতা আঞ্চলিক বা প্রাদেশিক সরকারগুলোর হাতে থাকবে।

ষষ্ঠ দফা : ফলপ্রসূভাবে জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষার কাজে সাহায্যের জন্য অঙ্গরাজ্যগুলোকে মিলিশিয়া বা আধা-সামরিক বাহিনী গঠনের ক্ষমতা দিতে হবে।

আপাতবিচারে ছয় দফায় সরাসরি স্বাধীনতার ইঙ্গিত না থাকায় স্বাধীনতা-প্রত্যাশী অনেকেই বিস্মিত হয়েছিলেন। যেমন অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের (ন্যাপ নেতা) এক প্রশ্নের উত্তরে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আরে মিয়া বুঝলা না দফা তো একটাই, একটু ঘুরাইয়া কইলাম।’ এ এক দফা যে কী, তা কারো বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। স্বাধীন পূর্ববাংলা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ’৬২-তে গঠিত ‘নিউক্লিয়াস’-এর সদস্য ছাত্রলীগ নেতা আবদুর রাজ্জাক স্বাধীনতার অনুল্লেখ সংক্রান্ত প্রশ্ন বঙ্গবন্ধুকে করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর উত্তর ছিল, ‘ওপারে যাওয়ার সাঁকো তৈরি করে দিলাম।’

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক জীবনের অন্যতম গৌরবময় অধ্যায় হলো ৬-দফা আন্দোলনে নেতৃত্ব। এই ৬ দফা আন্দোলনের মধ্য দিয়েই অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে ১৯৬৯-এর গণঅভ্যূত্থান, আর এর জের ধরে ৭০ এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ তথা বাঙালিরা তাদের বিজয় ছিনিয়ে আনে ।

৭০ এর নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন এবং সরকার গঠনে ও শাসনতন্ত্র প্রণয়নের যোগ্যতা অর্জন করা সত্ত্বেও  আওয়ামীলীগকে সরকার গঠন করতে দিতে অস্বীকৃতি জানায় সামরিক জান্তা ইয়াহিয়া খান এবং সে সামরিক শক্তি প্রয়োগ করে বাঙালির অধিকার নস্যাৎ করার চক্রান্ত চালাতে থাকে। আবার নির্বাচনে দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতাপ্রাপ্ত দল পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো শেখ মুজিবের পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার বিরোধিতা করেন এমনকি মুজিবের ৬-দফা দাবি মেনে নিতেও অস্বীকৃতি প্রকাশ করেন। মার্চের ৩ তারিখ পূর্ব ও পশ্চিম অংশের এই দুই নেতা পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টকে সঙ্গে নিয়ে দেশের ভাগ্য নির্ধারণে ঢাকায় বৈঠকে মিলিত হন। তবে বৈঠক ফলপ্রসূ হয় না। মুজিব সারা দেশে ধর্মঘটের ডাক দেন।

এর কিছুদিন পরে অর্থাৎ ১৯৭০ সালের ১২ই নভেম্বর ভোলার সাইক্লোন পূর্ব পাকিস্তানের উপকূলীয় অঞ্চলে প্রবল জলোচ্ছ্বাসের সৃষ্টি করে যাতে প্রায় পাঁচ লাখ লোক প্রাণ হারায়।  পাকিস্তানের সামরিক সরকার এমন ভয়াবহ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের পরও জরুরি ত্রাণকার্য পরিচালনায় গড়িমসি করে ফলে ঘূর্ণিঝড়ের পরও যারা বেঁচে ছিল তারা মারা যায় খাবার আর পানির অভাবে।  ঘূর্ণিঝড়ে বিপর্যস্ত মানুষগুলোর প্রতি পাকিস্তান সরকারের এমন নিষ্ঠুরতা দেখে পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ মানুষ ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। ইতিহাসে প্রথমবারের মত একটি প্রাকৃতিক ঘটনা একটি দেশে গৃহযুদ্ধের অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

অবশেষে আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। উনিশশো একাত্তরের সাতই মার্চ, তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে তিনি দিলেন সেই ঐতিহাসিক ভাষণ। ছড়িয়ে দিলেন স্বাধীনতার ডাক “ এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম, আমাদের মুক্তির সংগ্রাম”।

ভাষণ দিতে যাওয়ার জন্য গাড়িতে ওঠার সময়ে পূর্ব পাকিস্তানের জিওসি মেজর জেনারেল খাদিম হোসেন রাজার একটি চিরকুট বঙ্গবন্ধুর হাতে ধরিয়ে দেয়া হয়েছিল, যাতে লেখা ছিল, স্বাধীনতা ঘোষণা করলে বাজুকা কামান থেকে গোলা বর্ষণ করা হবে। একদিকে ইয়াহিয়া জান্তার সামরিক বাহিনীর চিরকুট অন্যদিকে তাত্ক্ষণিক স্বাধীনতা ঘোষণা করলে বাঙালিদের বিচ্ছিন্নতাবাদী ঘোষণা করার ভয় যা আন্তর্জাতিক আইনেরও পরিপন্থী হতো। সুতরাং বঙ্গবন্ধুর যা বলার ও করার ছিল তা তিনি করলেন অত্যন্ত সুচারুভাবে। তিনি স্বাধীনতার ডাক দিলেন কিন্তু স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেন না। বাঙ্গালীর যা বোঝার ছিল বুঝে নিল, বুঝে নিল সামরিক জান্তাও। ২৫শে মার্চের কালো রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে বন্দি হলেন শেখ মুজিব, দেশ জুড়ে শুরু হল অপারেশন সার্চ লাইট। স্বাধীনতা যুদ্ধের শুরু সেখানেই।

দৈনিক জনকণ্ঠ ৫ই মার্চ ২০১৪ সংখ্যায় “মুক্তিযুদ্ধ যেভাবে শুরু হয়েছিল” নিবন্ধে সরদার সিরাজুল ইসলাম লিখেছেন “বিশ্বের ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুর অসহযোগ আন্দোলন একটি নজিরবিহীন ঘটনা। মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলন সফল হয়নি। অস্ত্রের জোরে সমরনায়কদের রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের ঘটনা ইতিহাসের পাতায় নতুন কোন সংযোজন নয়। কিন্তু শুধু সমরনায়কদের কথাই বা বলি কেন, রাজনৈতিকভাবেও বিপ্লব, সশস্ত্র অভ্যুত্থান ইত্যাদির মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল বা দেশের শাসনভার গ্রহণের ঘটনাবলীর সাক্ষ্য দেবে যুগ যুগান্তরের ইতিহাস। বাস্তিল কারাগারের পতন ও ফরাসী বিপ্লব, রুশ বিপ্লব ও লেলিনের ক্ষমতায় অধিরোহণ, চীনে গণমানুষকে সঙ্গে নিয়ে মাও সে তুং-এর লং মার্চের মাধ্যমে জনগণের শাসন প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি বিষয়ক রাষ্ট্রক্ষমতার পরিবর্তনের কথা শিক্ষিত সচেতন মানুষের অবিদিত নয়। কিন্তু তবু বলতে হয়, বঙ্গবন্ধুর অসহযোগ আন্দোলন আজও দুনিয়ার এক নজিরবিহীন ইতিহাস। কারণ এই আন্দোলন শুধু আমাদের সফল মুক্তিযুদ্ধের সূচনা ও পটভূমিও তৈরি করেনি এবং সেই আন্দোলন কালেই কার্যত বাঙালীরা কয়েকদিনের জন্য হলেও পাকিস্তানের রাষ্ট্র ক্ষমতা চালিয়েছিল। সে দিনের পাকিস্তানের প্রেডিডেন্ট স্বয়ং ঢাকায় উপস্থিত থাকা সত্ত্বেও এতদাঞ্চলের গোটা প্রশাসনিক কার্যক্রম চলছিল একটি মাত্র মানুষের নির্দেশ অনুযায়ী। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।”

তার নেতৃত্বেই এ দেশ স্বাধীন হয়েছিল।

(কৃতজ্ঞতাঃ তথ্য উপাত্ত নানা ব্লগ এবং উইকিপিডিয়া থেকে সংগৃহীত এমনকি কোন কোন বাক্য বা বাক্যাংশ পাঠকের মন্তব্য থেকেও সরাসরি বা কিঞ্চিৎ সংযোজন বা পরিমার্জন করে সংযুক্ত করা হয়েছে।)

 শেখ মুজিবঃ অন্য আলোয় দেখা। (পর্ব ০২)

0 Shares

১৩টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ