আমার একটা স্বপ্ন ছিল।

লোকালয় ছেড়ে বহদুরে মনুষ্যবাসের অনুপযোগী কোন অচেনা দ্বীপের গহীন অন্ধকারে একটা ছোট্ট কুঁড়ে ঘরে জীবন কাটিয়ে দেওয়ার নিদারুন লিপ্সা আমার। বিজ্ঞানের সকল সুবিধা সম্বলিত একটা প্যাকেজ যেমন সার্বক্ষণিক বিদ্যুৎ সংযোগ একটা দ্রুত গতির ল্যাপটপ একটা উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন জিপিআরএস মোডেম মোবাইল সংযোগ একটা উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন সাউন্ড সিস্টেম কিছু পছন্দমতো গানের সি ডি আর সামান্যতম খাবার, ও হ্যাঁ অবশ্যই সাথে প্রতিদিন এক প্যাকেট গোল্ডলীফ।

দ্বীপের ঠিক মধ্যখানে কোন এক পাথরের গুহায় একটা মতন থাকার ব্যবস্থা, লেপ কাঁথা তোশক বালিশ এটুকু থাকলে যথেষ্ট। কিছু শুখনো জল খাবার আর সাথে বিশুদ্ধ পানির সংস্থান, বাঁকি টুকু প্রকৃতি থেকে আহরন হয়তো করে নেব। দ্বীপের জলায় বরশি দিয়ে মাছ শিকার, গাছের সুস্বাদু টাটকা ফলমূল, নিতান্ত মাছ মাংশ না পেলে শাক কচু, দিব্বি দিন গুজরান করা যাবে। শুনেছি, এল্যান্স গিন্সবার্গ নিউইয়র্কের হাইরাইজ বিল্ডিঙের মাথায় সাউন্ড সিস্টেম লাগিয়ে “আর ইউ নাটস” লেভেলে ভলিউম ঠেকিয়ে “ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দে রে” শুনতেন। আমি আমার দ্বীপের চার কোনায় চারটি সাউন্ড সিস্টেম লাগিয়ে দিয়ে নুশরাত ফতেহ আলী খানের কাওয়ালী, বড়ে গোলাম আলী খান আর জগজিৎ সিং’এর গজল, নচিকেতার জীবনমুখী গান আর মান্নাদের গান শুনতে চাই। ফতেহ আলীর “আফরিন আফরিন”, গোলাম আলীর “হাম তেরে শেহের মে আয়ি হে মুসাফির কি তাঢ়া” জগজিৎ সিং এর “ইয়ে কাগজ কি কাশতি” নচিকেতার “এ সময় অসময়” মান্নাদের “দরদী গো, কি চেয়েছি আর কি বা পেলাম” শুনতে চাই। নিশুতি রাতের নিঃসঙ্গ তারার দিকে আনমনে একাকী তাকিয়ে এই গানগুলো যে একবার শোনেনি তার ইহলৌকিক জীবন বৃথা। সাথে অবশ্যই লাক্সমিকান্ত-প্যারেলাল, জতীন-ললীত আর ডি বর্মণ এস ডি বর্মণের সুর করা গান অবশ্যই থাকতে হবে। দ্বীপের প্রান্ত ধরে ঈষৎ পানিতে পা ভিজিয়ে চারিধার ঘুরে ঘুরে একাকি এক নিঃসঙ্গতা উপভোগের এই নির্লোভ দুর্লভ মুহূর্তটি কিছুতেই মন থেকে মুছে ফেলতে পারি না।

কিছু বই সাথে রাখতে চাই।

আমার ক্ষুদ্র জীবনের সেরা কয়েকটি বই যেগুলো কয়েকবার পড়ার পরেও আজো পড়তে শুরু করলে শেষ না করে উঠতে পারিনা সেগুলো সাথে নিয়েই দ্বীপান্তরে যেতে চাই। গাভ্রিয়েল ত্রলোপলোয়েস্কির “ধলা কুকুর শামলা কান” লিও তলস্তয়ের “ওয়ার এন্ড পিস” পাভেল বাঝোবের “মালাকাইটের ঝাঁপি” মারিয়ো পুজো’র “গড ফাদার” গ্রেজিয়া দেলেদ্দা’র “লা মাদ্দ্রে” পার্ল এস বাক’র “গুড আর্থ” এরিক মারিয়া রেমার্ক’র অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট এবং থ্রি কমরেডস” ওমর খৈয়াম’’র “রুবাইয়াত” ইকবালের “শিকওয়া ও জবাব-ই-শিকওয়া” জাহানারা ইমামের “সাতটি তারার ঝিকিমিকি এবং একাত্তরের দিনগুলি” এম আর আখতার মুকুলের “আমি বিজয় দেখেছি” আবুল মুনসুর আহমেদের “সোহরাওয়ার্দী থেকে শেখ মুজিব” সুনীল গাঙ্গুলির “প্রথম আলোয় এবং পূর্ব পশ্চিম” শীর্ষেন্দু’র “গর্ভধারিণী” আরও নাম না জানা অনেক লেখকের কাড়ি কাড়ি বই থাকা চাই সাথে।

সে যাক, নাগরিক কোলাহলের অন্তরালে নির্মল বিশুদ্ধ বায়ু সেবনের যে প্রাণ হাঁসফাঁস করা আকুতি, রেলিঙে বাদুরঝোলা শৈশব, স্কুলব্যাগ কাধে শিক্ষা-মজুরের নির্যাতিত কৈশোর, দশটা পাঁচটার নিত্য দিনের গদবাঁধা জীবনধারা, ভালবাসাবাসিবিহীন পৃথক পারিবারিক কালচার, পঙ্কিল আদর্শবিচ্যুত সমাজ, নীতিনৈতিকতাবিহীন ভ্রষ্ট রাষ্ট্রীয়ব্যবস্থার পাঁক গলে এ রকম একটা যন্ত্রণাবিহীন নিঃসাড় নিঃসঙ্গ ব্যক্তিকেন্দ্রিক সাম্রাজ্য গঠনের আমৃত্যু স্বপ্ন অহর্নিশ আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। পরিবার আছে, সমাজ আছে। স্ত্রী কন্যা ভাই বোন বাবা মা আত্মীয় পরিজন বন্ধু বান্ধব সব আছে। তবুও সবার আগল ভেঙ্গে নিরুদ্দেশে যাবার স্বপ্ন দেখি। সবার অপত্য স্নেহ ভালবাসা মান অভিমান করুনা আঘাত দু’পায়ে মাড়িয়ে মনের কোনে প্রতিনিয়ত একটা আলাদা মনোজগৎ গড়ে তুলি, এতে সম্ভাবনার প্রত্যাশা জাগে না বটে কিন্তু আত্মমগ্নতার যে রেশ সারা দেহ মনে আবেশ ছড়িয়ে যায় তার মোহাবিষ্ট হয়ে ক্ষণিকের যন্ত্রণা লাঘব করার চেষ্টা করি।

এগুলো স্বপ্ন বিলাসী ভাবুক মনের বেহুদা আর্তনাদ। এখনও আমি বাজারের ব্যাগ হাতে ছুটি, বৃদ্ধা মা যায় মেয়েটাকে স্কুলে পৌঁছে দিতে, বাবাটা বিছানায় তিন বছর হল শয্যাগত, ভাই চাকুরী না পেয়ে নেশা টেশা করে কি না কে জানে, অবিবাহিত বোনটার বয়েসের ভারে কমনীয়তা ভাটির পথে, বউটা সেই সকাল থেকে হাড়ি চুলোয় লাকড়ি ঠেলতে ঠেলতে জেরবার।

সময় কোথায় তাদের স্বপ্ন দেখার!

0 Shares

১০টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ