যৌতুকের বলি ৬ষ্ঠ পর্ব

মনির হোসেন মমি ৭ মার্চ ২০১৫, শনিবার, ০৯:৪৫:৫০অপরাহ্ন বিবিধ ১৩ মন্তব্য

অন্যান্য দিনের মতো আজও আকমল তার বন্ধুদের নিয়ে অপেক্ষা করছেন ফুলীর জন্য...আজ সে স্কুলে আসেনি,সেদিনের ঘটনার পর ফুলী আজ প্রায় পাচ ছয় দিন হয়ে গেলো সে স্কুলে আসছেনা।আকমল খুব চিন্তায় পড়ে গেলেন,হঠাৎ কি হলো তার না আসারতো কোন কারন দেখছি না।এ দিকে দীর্ঘক্ষণ একই স্থানে অবস্থান করাতে তার বন্ধুদের মাঝেও বিরক্ত এসে যায়।
-ধ্যাততরি,তুই যার জন্য অপেক্ষা করছিস সে আর আসবে বলে আমাদের মনে হয় না।
-হুম....তাইতো দেখছি,তবে কি জানিস আমার জন্য একটা মেয়ে লেখা পড়া বন্ধ করে দিবে আমি ভাবতে পারিনি।আমি মনে হয় ভূল করছি।
হঠাৎ তার আরেক বন্ধু তার এমন অবাক করা কথায় আশ্চর্য হলেন।
-এই...রাখ রাখ, থাম একটু,আমি কি আজ সেই রশিদ মোল্লার একমাত্র বকাটে ছেলেটির সাথেই আছি, নাকি এ এক অন্য আকমলের সাথে।
-তোর কি সন্দেহ হচ্ছে?
-সন্দেহতো বটে,অবাকও হচ্ছি....এতটা বছর যার সাথে আছি সেতো কখনি কোন কারনে ভূল করেছি স্বীকার করেনি আজ একটি মেয়ের জন্য এতটা বদলে গেল!কেমনে?
-তুই ঠিক ধরেছিস,ফুলীকে দেখার পর হতে মনটা কেমন নড়ে চড়ে উঠেছিল....হয়তো ও আমার ছন্নছাড়া বাদাইম্মা জীবনকে মায়ার বন্ধনে বেধে দিয়েছে।
-যাস্ সালা এবার হয়েছে বন্ধু আমার মজনু বণে গেছেন।
-ঠিকই কইছস এ কটা দিনে আমার শুষ্ক মনটা হঠাৎ তৃষ্ণা মেটানো পথ খুজে পেল।
তাদের পাশ দিয়েই স্কুলে যাচ্ছিল ফুলীর সহ পাঠিরা।তাদের মধ্যে একজন ছিল আকমলের পাশের বাড়ীর,তাকে স্কুলের দিকে আসতে দেখে  আকমল বন্ধুদের এখানেই দাড় করিয়ে আগন্তুক মেয়েটির দিকে একটু এগিয়ে গেল।
-কি ব্যাপার আকমল ভাই আপনি!কি কিছু বলবেন?
-হ্যা,না মানে...ফুলীকেতো কয়েক দিন যাবৎ স্কুলে আসতে দেখছি না।
-ও তাই,....আর আসবেনা।
-কেনো?
-সেই কারনতো আপনিই ভাল জানেন।
এই প্রথম রশিদ মোল্লার অংকারী ছেলেটি লজ্জায় মাথা নত করেন।
-এ ভাবে বন্ধুদের নিয়ে দল বেধে ভালবাসা হয় না।মেয়েদের মন পাওয়া এতো সহজ না...চলি আমার ক্লাশের সময় হয়ে এলো।

মেয়েটি চলে গেল তার গন্তব্যে আকমল বন্ধুদের কাছে ফিরে গিয়ে একটু মন মরা হয়ে চুপচাপ বাড়ীর দিকে রওয়ানা দিলো।বন্ধুদের কাউকে কিছুই বললনা বরং এক বন্ধুর প্রশ্নের উত্তরও দিলেন না।

এ দিকে ফুলী তার স্কুল অবসরে বান্ধবীদের নিয়ে হেসে খেলে দিন অতিবাহিত করছেন।লেখা পড়া বন্ধ হয়ে যাওয়াতে হাতের কাজ শিখছেন পাশের বাড়ীর এক জনের কাছ থেকে।এ ভাবে মাস দিন বছর পেরিয়ে যাচ্ছে এর মধ্যে ফুলীর বিয়ের জন্য বিভিন্ন স্থান থেকে ঘটকে ঘর আনলেও শেষ পর্যন্ত মোড়লের ছেলের কারনে কোন সম্মদ্ধ আর পাকা হয় না।

সে দিনের পর হতে মোড়লের বকাটে ছেলের আরো বেশ পরিবর্তন আসে বার বার নিজের মনকে প্রশ্ন করতে থাকেন আর ফুলর নিকট ক্ষমা চাওয়ার কাহিনীর জাল বুনতে থাকে একটি অজানা ভাল লাগার অনুভূতি বার বার তাকে ধিক্কার দেয়।তার লম্বা চুলে পরিবর্তন আসে পোষাকে মাধুর্য্যতা লক্ষনীয় বন্ধুদের আড্ডাটাও আর আগের মতো নেই, এই একটি বছরে আকমল একে বারে ভাল ছেলে হিসাবে গ্রামে পরিচিত পেতে থাকেন এমনকি অনেকেই তার সৎ ব্যাবহারের সহিত তার পিতা মোড়লের চরিত্র মিলাতে হিমসিম খাচ্ছে।তবে ফুলী নামক যে মেয়েটিকে সে ভালবাসত দূর থেকেই তার পথ পানে আজও চেয়ে থাকেন কখন সে হ্যা বলবেন,ফুলীও কোন কারনে তার পড়লে মাথা নীচু করে কোন প্রশ্নের জবাব না দিয়েই প্রস্থান নেন।

রশিদ মোল্লাও ধীরে ধীরে ছেলের এমন পরিবর্তনে অবাক হন তবে সে কখনই ছেলের সাথে তেমন কোন বলেননি আজ কথা বলার প্রয়োজনবোদ দেখে বৈঠকের পর অন্দর মহলে ছেলের সাথে কথা বলেন।মোড়ল অন্দর মহলে প্রবেশ করেন ছেলে আকমল তার বাবার সামনে মাথা নীচু করে দাড়িয়ে থাকেন।
-কি ব্যাপার আব্বাজান, তুমি এমন হলে কি করে বেশ কয়দিন যাবৎ দেখছি তোমার পোষাকে চালচলনে বেশ পরিবর্তন?
-কৈ কিছু নাতো।
-দেখো আমি তোমার জন্মদাতা আর জন্ম দাতারা তাদের ছেলে মেয়ের চাল চলন দেখেই বুঝতে পারেন সন্তান কোন সমস্যায় আছে।বলো কি সমস্যা তোমার।
-না,আমার কোন সমস্যা নেই,
-নাহ্ তুমিতো এমন কখনই ছিলে না।তবে আমি যা লোক মুখে শুনেছি তা যদি সত্য হয় তবে সমস্যা কোথায়,তোমর যাকে পছন্দ হইবে তাকেই বিয়ে করবে।
পিতার এমন কথা শুনে ছেলে একটু নড়াচড়া দিলেন।
-কি,আমরা যাবো প্রস্তাব নিয়ে?
-যেতে পারেন তবে লাভ হবে বলে আমার মনে হয় না।
-কেনো?
-ওর বাবা এখানে আত্ত্বীয়তা করবেন না।
-আপোষে রাজি না হলে জোড়ে করাব।........তুমি এখন যাও আমি দেখছি কি করা যায়।
মোড়ল আবারও বৈঠক খানায় আসেন সেখানে ছিলেন গ্রামের মেম্বারের দল।তাদের সাথে ছেলের ব্যাপারটি সেয়ার করেন।মোড়লের কথা শুনে মেম্বাররা কথার জবাব দেন।
-আলমাছ বেপারীতো মুক্তিযোদ্ধা।
মেম্বারের কথা টান দিয়ে মোড়লের চামচা কথা বলেন।
-শুধু মুক্তিযোদ্ধা না তার তিন ভাই যুদ্ধে শহীদও হয়েছেন।
মোড়ল ধমক দেন চামচাকে।
-চুপ কর হারামজাদা,তাতে কি আমারতো মুক্তিযুদ্ধের সার্টিফিকেট আছে।
-হ'তয় টাকার বিনিময়ে,
-চুপ কর হারামজাদা।তুই বেশী কথা কছ।
-শুনেন মেম্বার গনেরা কালই যাবো প্রস্তাব লইয়া,আপনারা প্রস্তুত থাইকেন।

থানার বড় দাড়োগা সহ প্রায় পনের বিশ জনের একটি দল নিয়া ফুলীদের বাড়ীতে হাজির হলেন রশিদ মোল্লা।মোল্লাকে দেখে আলমাছ মিয়া প্রথমে একটু বিরক্ত ভাব দেখাইলেও পরে মেহমান ভেবে ঘরের ভিতরে বসতে দেন।ফুলীদের মাটির ঘরটির দরজার চৌকাঠটি ছিল উচ্চতায় খাটো তাই মোল্লা ভিতরে প্রবেশ করতে দরজার চৌকাঠে কপালে আঘাত পান সঙ্গে সঙ্গে কপাল ফোলে কপালের মাংস খানিকটা বৃত্তাকার হয়ে গেল।কপাল হাতাতে হাতাতে মোল্লা ভিতরে প্রবেশ করে বসেন একটি করমটে চকিতে।বসার কিছুক্ষণের মধ্যে মেহমানদের জন্য সরবত ফলফ্রুট এসে যায়।আলমাছ অন্দর মহলে তার পরিবারের সাথে কথা বলছেন।এদিকে মোল্লার ডাক পড়ে।
-কৈ আলমাছ মিয়া,?একটু এদিকে আসো না জরুলি কথা সেরে ফেলি।
আলমাছ মোল্লার ডাকে সারা দিয়ে তৎক্ষণাত তার পাশে বসেন।
-শোন আলমাছ মিয়া,আমার মেঝো ছেলে আকমল তোমার মেয়ে ফুলীকে পছন্দ করে।আমি আমার ছেলের বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছি।
-কিছু মনে করবেন না,আমি গরিব মানুষ এভাবে হুট করে চইল্লা আইবেন বুঝতে পারিনি।
-সমস্যা নেই তোমার আপ্যায়নে আমরা খুশি হয়েছি....তয় কথা হলো এখন তোমার মতামত দাও,তোমার মত পেলে আমি শুভ কাজটি দ্রুত সেরে ফেলব।
-আমাকে একটু অন্দর মহলে যাবার অনুমতি দিলে মেয়ের মায়ের সাথে কথা বলে আসতাম।
-ঠিক আছে ঠিক আছে তুমি যাও।
আলমাছ অন্দর মহলে তার সহধর্মিনীর সাথে কথা বলছেন।মেয়ে যখন আছে বিয়ের ঘর আসবে যাবে তবে মোড়লের ছেলের ফুলীর উপর নজর পড়েছে তাই মেয়েকে অন্যত্র বিয়ে দিতেও পারবনা।যেখানেই বিয়ে দিতে যাবো সেখানেই ভেজাল করবে সে।
-মেয়ে রাজি হবে তো?
আলমাছের স্ত্রী বললেন।
-ও আমাদের মতে বাহিরে যাবে না।
ঠিক সেই সময় ফুলী তাদের কাছাকাছি আসেন এবং অনেকটা রাগে তার মনের ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
-অমত থাকত না যদি মোড়ল রাজাকার না হতেন।তাদের জন্য আমার তিনজন চাচাকে শহীদ হতে হয়েছে আর তাদের সাথেই আমরা আত্ত্বীয়তা করব এটা কেমন কথা।
আলমাছ বসা থেকে উঠে মেয়ের মুখ চেপে ধরেন।
-আস্তে বল মা আস্তে বল,তুমি রক্তের বিনিময়ে শহীদ পরিবারের সন্তান হইছো,তোমার কোন সার্টিফিকেট নাই শক্তি সামর্থ্য কোনটাই নাই আর ওদের দেখো এখন সব আছে ওদের,টাকা পয়সা ক্ষমতা সব সব আছে এমন কি যক্ষের ধন যুদ্ধের সার্টিফিকেটও আছে স্বাধীন দেশে রাজাকার হয়ে এখনও সে বুক ফুলিয়েই চলে তার সঙ্গ দেন কত্ত বড় বড় নেতা মন্ত্রীরা এমন কি স্বাধীনতার পক্ষের শক্তিরাও ।
-তবুও বাবা, আমি মেনে নেবো কি করে,ওদের ঘরে গেলে ওদের এক একটিকে মনে হবে দানব খুনী রাজাকার।
-এ ছাড়া উপায়ও নেই রে মা,ওদের ইচ্ছের বাহিরে গেলে ওরা আবারও সেই '৭১ এ কায়দায় আমাদের উপর অত্যাচার চালাবে।
-তাই বলে!তাই বলে মুখ বুঝে সইতে হবে?
-হ রে মা হ,পানিতে বাস করে কুমিরের সাথে যুদ্ধ করে টিকে থাকা যায় না,,,,,,আর কিছু বলিস না মা,একজন অসহায় কন্যা সন্তানের বাবা এই সমাজে কতটা অসহায় তুমি তা এখন বুঝবে না।আমি না করলে ওরা তোমাকে উঠিয়ে নিয়ে যাবে তখন আমর সব কূলই হারাবে,দেখছস  না থানার দাড়োগা সহ আইছে।

ফুলী চুপ হয়ে যায় তার ছোট আরো দুটি বোন একটি ভাই আছে তাদের ভবিষৎতের দিকে তাকিয়ে নিজের মনের বিরুদ্ধে নিজেকে কোরবানী করল।আলমাছ মিয়া চোখের জল মুছতে মুছতে বৈঠকে ফের প্রবেশ করেন।মোল্লার চামচা দাড়োগা জিজ্ঞেস করেন।
-কি হলো আলমাছ, তোমার জবাবটা কি?
-কি বলব,মেয়ে কিছুটা অরাজি তবুও আপনারা এসেছেন যখন তখন আর না করি কেমনে।
-আলাদুলিল্লাহ,শুভ কাজ যত তাড়া তাড়ি সম্ভব সেরে ফেলাই ভালো।
সাথের এক মেম্বারের জবাব।তার পাশেই ছিল মোড়লের খাস চামচা সে মাঝ খানে কথার বা হাতটি ঢুকান।
-বিয়ের কথাতো ফাইনাল হলো,এখন কথা হলো গিয়ে,আমাগো হুজুরের এক মাত্র মেঝো ছেলে তাকে যখন গ্রামবাসী জিগাইবো ছেলের বিয়েতে শশুড়বাড়ী হতে কি পেলেন তখন হুজুরের মুখ দেখাবেন কেমন করে?তাই বলছিলাম......জামাইয়ের বড় শখ একটা হোন্ডার ।
-আপনারাতো জানেনই আমার তেমন কোন অর্থ সামর্থ নেই যা আছে থাকার মধ্যে এই ভিটে বাড়ীটা আর পশ্চিম দিকে রাস্তার সাথে দশ শতাংশ খেতি জমিন।
-সমস্যা কি,তোমার টাকা লাগব হুজুরের লাগব জমিন,না মানে বলছিলাম কি ঐ খেতি জমির দলিলটা হুজুরের কাছে বন্ধক রেখে ছেলের জন্য একটা হোন্ডা আর তোমার মেয়েকে তুমি সাজাইয়া দিবা।
চামচার কথা শুনে মোড়ল ছলনায় ধমক দেন।
-চুপ কর হারামজাদা খালি খালি বেশী কথা কছ,দুদিন পর আমার কুটুম হইবো আর তাকে তুই.......তুই তুই আর মানুষ হবি না হারামজাদা।
মোড়ল জানত আলমাছ গরিব হলেও এক সময় ছিলেন জমিদার তাদের মীর্জা বাড়ীর বংশের ডাক নাম এখনও আছে।সে নিশ্চয় মেয়েকে ঠকাবেন না।যেমন ভাব না তেমনি ফল আলমাছ মিয়া চামচাকে মোড়লের ধমক দেয়াটাকে সায় দিলেন না।
-রশিদ কি যে বলো ভাই আমি কি আমার মেয়েকে খালি গায়ে তোমার ঘরে তুলে দেবো নাকি, আমারতো মান সম্নান আছে।
-তাহলেতো কোন কথাই নেই....
চামচায় এক লাফে উঠে এসে মোল্লার আনা মিষ্টির বক্স থেকে খোলে সবাইকে মিষ্টি মুখ করাল এবং বাকী মিষ্টিগুলো ফুলীর ছোট ভাইটির হাতে তুলে দিলো।
-তা হলে আজ উঠি...কালকের মধ্যেই একটি তারিখ ঠিক করে তোমার মতামত নিবো।

চলবে...
যৌতুকের বলি ৫তম পর্ব

0 Shares

১৩টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ