মিতুর মেঘ বৃষ্টি

রায়হান সিদ্দীক ২১ মার্চ ২০১৯, বৃহস্পতিবার, ০৪:০৫:০০অপরাহ্ন গল্প ১৭ মন্তব্য

১.

রহমান সাহেব ছেলেটার দিকে তাকিয়ে আছেন। ছেলের মুখ ভর্তি দাড়ি আর মাথাভর্তি চুল। মাঝে মাঝে চুলে আঙুল দিয়ে খুটিয়ে নখে করে কি সব ময়লা তুলছে। শরীরে একটা পাঞ্জাবি, পাঞ্জাবিটা দেখে চেনা চেনা লাগছে। এরকম একটা ময়লা রঙের পাঞ্জাবি তারও ছিল। পাঞ্জাবিটা মিতুর অপছন্দ ছিল, তাই সেটা সে কোন ফকিরকে নাকি দিয়ে দিয়েছে।

- আসসালামু আলাইকুম স্যার

- ওয়ালাইকুম। আপনি কে?

- মিতুর কাছে এসেছিলাম। আপনি মিতুর আব্বা?

- জ্বি। মিতু কে কি কাজে দরকার?

- স্যার আমার একজন বিখ্যাত পরিচালকের এসিস্ট্যান্ড ডিরেকটর হিসেবে চাকরি ফাইনাল হয়েছে। বেশ ভালো বেতন, ৮ হাজার টাকা।

- ও আচ্ছা।

- স্যার মিতু কে একটু ডেকে দিবেন? খবরটা ওকে দেয়া খুব প্রয়োজন। শুনলাম ওর বিয়ে দেয়ার জন্য আপনারা তোরজোর শুরু করে দিয়েছেন? এটা ঠিক না স্যার। ওর পছন্দটা জানতে চেয়েছেন?

- কিছু মনে করবেন না। মিতুর বিয়ে হয়ে গেছে দুই সপ্তাহ হয়ে গেলো। আপনি খবর পান নি বোধ হয়।

- ও।

- ভিতরে আসেন। দুইটা ভাত মুখে দিয়ে যান, আর আমার মেয়ের জন্য দোয়া করবেন।

- অবশ্যই করবো। খালি পেটের দোয়া খাস দোয়া হয়। দোয়া বের করার জন্য পেটে খাবার ফেলতে হয় না। পেটে খাবার পড়লে পরে যা বের হয়, তাকে বলে হাগু।

রহমান সাহেব ছেলেটার দিকে হা করে তাকিয়ে রইলেন। ছেলেটা চলে যাচ্ছে। একবারও ছেলেটা পিছনে ফিরে তাকালো না।

 

রহমান সাহেব ঘরে যেতেই মিতু ছুটে এলো। মিতুর মুখে গামছা চিপড়ানো হাসি। অনেক কষ্টে সামান্য হাসি বেরুচ্ছে।

- লোকটা কি বললো আব্বু?

- বললো চাকরি হয়েছে। ৮ হাজার টাকা বেতন। সেই খুশিতে উকুন মারছিলো!

- সারাদিন বাইরে থাকে। মাঝে মাঝে পুকুরে ডোবায় গোসল করে। মাথাটা ঠিক মত ধোয় না।

- বলিস কি?

- উনি একটা পাগল। শোন আব্বু, উনি প্রত্যেকবার আমাকে চমকে দেন। এবার আমি উনাকে চমকে দিয়েছি। ভালো হয়েছে না?

- ছেলে ও আচ্ছা বলে চলে গেছে। চমকেছে বলে মনে হয় নাই।

- একটুও চমকায় নি? চেহারা শুকিয়ে যায় নি আমার বিয়ের খবর শুনে?

- শুকনো চেহারা আর কত শুকাবে? পাগলেরা সহজে চমকায় না।

- হুম। কড়া কিছু করতে হবে। ঝানু মাল, আরেকটু কসরত করতে হবে চমকাতে হলে।

- তুই কি পাগল হলি নাকি? যা আমাকে এক কাপ চা দে।

- আমি চা বানাতে গেলাম। ওই লোক আবার আসবে। আসলে উনাকে ঘরে বসতে বলবে। ওনার  জন্য  আমি গরুর কালা ভুনা আর চালের রুটি বানিয়েছি। তুমি উনাকে খাওয়াবে।

- আমার চা দরকার নেই। আমি ঘুমুতে গেলাম।

 

কথাটা বলতে না বলতেই বাইরে থেকে পাগলরূপী ছেলেটা মিতু মিতু বলে ডাকাডাকি করতে লাগলো। মিতু খিলখিল করে হাসতে হাসতে রান্নাঘরে চলে গেল। রহমান সাহেব বিরক্ত মনে বসে রইলেন।

২.

ছেলেটা খাচ্ছে, রহমান সাহেব চুপ করে ছেলেটার খাওয়া দেখছেন। ছেলেটা ভদ্রতার আশেপাশে নেই, খেয়েই যাচ্ছে। নিজ হাতে মাংস নিচ্ছে, রুটি নিচ্ছে। রহমান সাহেব রাগে ফেটে যাওয়ার অবস্থায় চলে গেছেন

- স্যার মাংস কি আপনি রান্না করেছেন?

- না।

- যেই রান্না করুক, চমৎকার হয়েছে। খেয়ে আরাম পাচ্ছি।

- হুম। খান।

 

ছেলেটা আশেপাশে তাকাচ্ছে আর খাচ্ছে। রহমান সাহেবের অবস্থা ভালো ঠেকছে না। এই ছেলে এমন করছে কেন? ঘরের কিছু নিয়ে দৌড় দিবে নাকি? আর এই ছেলের পেটে হাতি না অন্য কিছু আছে? এত খাচ্ছে কিভাবে?

 

- স্যার একটা কথা বলবো, একটু সামনে ঝুঁকলে ভালো হয়।

- সামনে ঝুঁকতে হবে কেন?

- গোপন কথা। ফিসফিস করে বলবো। আসেন, ঝুঁকে পড়েন।

অনিচ্ছা সত্বেও রহমান সাহেব ঝুঁকলেন। ছেলেটাও ঝুঁকে পড়লো। তার মুখ হাসি হাসি।

 

- স্যার, এই রান্না মিতু করেছে, আমি জানি। ও রান্না ঘরে আছে। আমি ওর চুলের গন্ধ পাচ্ছি।

- কীসের গন্ধ পাচ্ছেন?

- স্যার, আপনার মাথায় চুল নেই। আমি শ্যাম্পু দেই না কতদিন ধরে, মনে নেই। কিন্তু আমি এই ঘরে কড়া সানসিল্ক এর গন্ধ পাচ্ছি।

 

রহমান সাহেব আবার হা করে তাকিয়ে রইলেন ছেলের দিকে।

 

- আমি এখন একটু রেগে গিয়ে চিৎকার করবো। আপনি কিছু মনে করবেন না। ইঁদুরের গর্তে গরম পানি ফেললে ইদুর বের হয়ে যায় শুনেছেন না? আমিও গরম কথা ঢালবো। আপনি রেডি?

- হ্যাঁ?

রহমান সাহেবকে অবাক করে দিয়ে ছেলেটা চিৎকার করে উঠলো,

- এ কেমন বিচার? মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিলেন, এখন খেতে বসিয়ে মাংসের জায়গায় চর্বির দলা দিচ্ছেন?

- জ্বি?

- এর চেয়ে আপনার মেয়ের হাতের আলু ভাজি দিয়ে দুইটা আটার রুটি খেতে পারলেও ভালো লাগতো। কিন্তু এসব কি? জুতো মেরে গরু দান, গরুর মাংস চর্বি দান আগে দেখি নাই। আপনি একটা পাষাণ!

- ভাই আপনি কি শুরু করলেন???

- আট হাজার টাকার চাকরির খবরটাও দিতে দিলেন না। মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিলেন। এখন এসব খাওয়াচ্ছেন। আমার কষ্ট টা দেখলেন না আপনি!

 

কথাটা বলেই ছেলেটা কান্না করতে থাকলো। হু হু কান্না দেখে প্রস্তুতি থাকার পরেও রহমান সাহেব হতভম্ব হয়ে গেলেন। আরও অবাক হলেন নিজের মেয়েকে কান্না কান্না চেহারায় ঘরে ছুটে আসতে দেখে।

 

- এত বড় মিথ্যা না বললেও পারতেন। একটা পিস চর্বির দলা রান্না করিনি আমি! খুজে দেখাতে পারলে নিজের বুড়ো আঙ্গুল নিজে চিবিয়ে খেয়ে ফেলবো। দেখান।

- সব খেয়ে ফেলেছি। দেখাবো কি? আর আপনি এখানে কি করছেন? আপনার স্বামী কই? দুই সপ্তাহের মধ্যে বাবার বাড়ি চলে এলেন? জামাইয়ের জন্য মায়া দয়া নেই?

- আপনি চুপ করেন! বেশি কথা বলেন আপনি!

 

ছেলেটা কান্না থামানোর হাজার চেষ্টা করেও কান্না থামাতে পারছে না, এমন অভিনয় করে যেতে লাগলো। রহমান সাহেব তার মেয়ের কাচুমাচু মুখ দেখে চুপসে গেলেন। এই মেয়ে আট হাজার টাকা বেতন পায়, এমন এক পাগলের জন্য পাগলী হচ্ছে। আট হাজারে ঢাকা শহরে কি হয়? তিন বেলা আটা রুটি ভাজি খেলেও তো পোষাবে না! এই মেয়ে কি চায়? রহমান সাহেব ভাবতে লাগলেন।

0 Shares

১৭টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ