মামাকে দেখতে যাওয়া (পর্ব-২৭)

শামীম চৌধুরী ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২০, সোমবার, ০৫:৩১:১১অপরাহ্ন ভ্রমণ ১৭ মন্তব্য

আগের পর্বের লিঙ্ক- মামাকে দেখতে যাওয়া (পর্ব-২৬)

পর্ব-২৭

রন্থাম্ভোর ন্যাশনাল পার্কের অভিমুখে দ্রুত গতিতে গাড়ি ছুঁটে চলছে। গাড়িতে বসেই প্রকৃতির সৌন্দর্য ও সকালের রোদের মিষ্টতা অনুভব করছি। বিধাতার নিজ হাতে গড়া প্রকৃতি যে কাউকে আকৃষ্ট করে। আমিও মানুষ। আমারও মন আছে। ভালোবাসা আছে। প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করার লোভও আছে। আধিকারও আছে। মাঝে মাঝে মনে হয় স্বার্থপরের মতন প্রকৃতি থেকে সব কিছুই লুটে নিচ্ছি। অথচ প্রকৃতিকে দেবার মতন কিছুই করছি না। বরঞ্চ প্রকৃতিকে ধ্বংস করছি। ভাবনাগুলি সব সময় তাড়িয়ে বেড়ায়। ইচ্ছা থাকা সত্বেও প্রকৃতিতে বসবাসকারী মানুষরূপী হায়েনার জন্য কিছুই করার থাকে না। এরা প্রকৃতিকে অসুস্থ্য করার মূল কারিগর। অথচ এরাই প্রকৃতি থেকে তাদের পাওনা কড়ায় গন্ডায় আদায় করে নেয়। আর যার জন্য প্রকৃতি মাঝে মাঝে রিরূপ আচরন করে। ধ্বংস করে মানব সভ্যতার নিজস্ব বলয়। যার জন্য দায়ী আমরাই। প্রকৃতিকে ভালোবাসলে প্রকৃতিও আমাদের ভালোবাসবে। চিরন্তন সত্য কথা।
 
রাস্তার দুই ধারে যে দিকে চোখ যায় শুধু সবুজ আর সবুজ। ফসলী জমি । এ যেন সবুজের হোলি খেলা। রাস্তার ধারে দন্ডায়মান বৈদ্যুতিক খুঁটিতে বসে আছে হরেক প্রজাতির পাখি। সবাই ব্যাস্ত নিজ নিজ আহারের সন্ধানে। তারা এই প্রকৃতি থেকেই তাদের খাদ্য জোগাড় করে নেয়। মানুষ ও বণ্যপ্রাণীর মধ্যে কোন ফারাক নেই। সবাইকে যার যার খাদ্যের ব্যাবস্থা করতে হয়।
 
ঘড়ির কাঁটায় সকাল ৯:৩০মিনিট। আমরা সবাই পথের ধারে একটা হাইওয়ে রেস্তোরায় প্রাতঃরাশের জন্য গাড়ি থামালাম। যার যার মতন ফ্রেশ হয়ে নাস্তার জন্য বসলাম। এরা সবাই নিরামিষভোজী। ডিম পর্যন্ত এখানকার রেস্তোরায় পাওয়া যায় না। একই ধরনে খাবার খেতে খেতে মুখে অরূচি এসে গেছে। কিছুই করার ছিলো না। বাধ্য হয়েই জীবন বাঁচানোর জন্য শক্তি সঞ্চয়ের জন্য খেতে হচ্ছে। আমার ছেলে ভাল হিন্দি বলতে পারে। সবাই ছেলেকে বললো নাস্তার ম্যানু ঠিক করে অর্ডার দেবার জন্য। ছেলে লাল আটার রুটি, সব্জি ভাজি, আলুর দম, ও পনিরের সালাদ অর্ডার করলো। এখানে অর্ডার দেবার পর খাবার তৈরী করে সরবরাহ করে।
 
রাজস্থান রাজ্যে সবচেয়ে বেশী ময়ূর দেখা যায়। জয়পুর থেকে সারিস্কা হয়ে ভরতপুর পর্যন্ত আমরা যতটা পথ পাড়ি দিয়েছি সারা রাস্তা ও বন জুড়েই ময়ূরের আধিপত্য দেখলাম। আমাদের দেশের বক জাতীয় পাখি মতন এখানকার ময়ূরগুলি গাছেও চড়ে। দেখতে বেশ ভাল লাগলো।
 
হাইওয়ের রেস্তোরাটি ছিলো নির্জন এলাকায়। হোটেলে প্রবেশের পর বুঝতে পারলাম এটা কোন ঘন বনের কোল ঘেষা এলাকা। খাবার হোটেলের পাশ দিয়ে মাটির রাস্তা। এই রাস্তায় যে গাড়ি চলাচল করে তা বুঝতে পারলাম। আমরা সবাই বসে গল্প করছি। জানালা দিয়ে লক্ষ্য করলাম বেশ কিছু ময়ূর ছুঁটাছুটি করছে। আমি ক্যামেরা নিয়ে বের হলাম। খাবার হোটেলের পাশের রাস্তায় এসে দাঁড়ালাম। আমার সঙ্গে ছোট ভাই নাজিম চলে আসলো। বাকিরা সবাই নাস্তার টেবিলে। হঠাৎ খেয়াল করলাম মাটির রাস্তায় একটি ময়ূর পেখম তুলেছে। নিজ চোখে এই প্রথম ময়ূরের পেখম তুলা দেখলাম। স্রষ্টার অপূর্ব সৃষ্টিতে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলাম। বেশ কয়েকটা ছবি ফ্রেমে বন্দী করলাম।
ময়ূর
নাস্তা শেষ করে আবারও যাত্রা শুরু করলাম। রাজস্থানে মেয়েরাই ঘর-সংসার থেকে শুরু করে যাবতীয় কাজে করে। দীর্ঘদেহী মেয়েরা মুখ শাড়ির আঁচলে ঢেকে চলাফেরা করে। তাদের সৌন্দর্যের আরেকটি বৈশিষ্ট হলো সবার কোমরে রূপার বিছা।
 
হাট-বাজার থেকে শুরু করে মাঠের সব কাজই মেয়েরা করে। কিছুটা পথ যাবার পর একটা বাজার পড়লো। সেখানে মেয়েরা ঝাঁকায় পেয়ারা বিক্রি করছে। পাশে আমাদের দেশের ভ্যান গাড়ির মতন ঠেলা গাড়িতে কমলা আঙ্গুর, মাল্টা সহ হরেক রকমের ফল দিয়ে পসরা সাজিয়ে বসে আছে। পেয়ারার রং দেখে লোভ হলো। গাড়িতে বসে খাওয়ার জন্য আমরা পেয়ারা কিনলাম। সঙ্গে কিছু ফলও নিলাম। পেয়ারাগুলি ছিলো অসাধারন স্বাদের। কচি কচি পেয়ারা কামড়েই কচ কচ করে। ভিতরটা টুকটুকে লাল। আমার পাঠক বন্ধুরা পেয়ারা খেলেই বুঝতে পারতেন ফ্রেশ পেয়ারার স্বাদ কেমন।
 
হাইওয়েতে ভারত সরকারের গড়া অত্যাধুনিক কিছু ব্রীজ ছাড়া ঐতিহাসিক কিছুই নজরে পড়লো না। হাইওয়ে রোডটি ছিলো ৬ লেনের। দূর্বার গতিতে হিন্দুস্তানী ও টাটা কোম্পানীর যন্ত্রদানবগুলি ছুঁটে চলছে। তবে দূর্ঘটনা হবার আশংকা কম মনে হলো। তার মূল কারন এক লেন থেকে অন্য লেনে ওভারটেক করার কোন সুযোগ নেই। এদের সড়ক ব্যাবস্থা দেখে ভাবলাম আমাদের দেশে প্রতিদিন কত মানুষ সড়ক দূর্ঘটনায় মারা যাচ্ছে। শুধু মাত্র পরিকল্পনাহীন সড়ক ব্যাবস্থার জন্য। পৃথিবীর কোন সরকারের কাছেই মানব জীবনের কোন মূল্য নেই। তারপরও আমাদের দেশের সরকারে উদাসীনতা একটু বেশী।
 
আমার ছেলে এই প্রথম ভারত সফরে আসলো। ওর মুখে দিকে তাকিয়ে বুঝলাম খুব আনন্দ উপভোগ করছে। মাঝে মাঝে ছেলেকে বলি
বাবা বিরক্তবোধ করছো?
হেসে বলে কিযে যে বলো।
এমন ভ্রমন তোমার সঙ্গে করতে পারবো কোনদিন কল্পনাই করিনি।প্রযুক্তির যুগ। তাই ভাবলাম কেন প্রযুক্তির সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবো। তাই, জিও নেট নিয়েছিলাম। খেয়াল করলাম ছেলে তার মা বোনের সঙ্গে ভাইবারে ভিডিওতে সব দেখাচ্ছে। ছেলের খুশীতে আমার গিন্নীও উৎফুল্ল।
সকালের নাস্তায়।
গাড়িতে বসে গল্পে গল্পে এক সময় রন্থাম্ভোর পৌছলাম। তখন সময় বেলা ১১:৩০মিনিট। আমরা এক রাত দুদিন রন্থাম্ভোর থাকবো। তাই সুজিত বেরা হোটেল বন্দোবস্ত আগেই করে রেখেছিলো। এ ছাড়াও রন্থাম্ভোর ন্যাশনাল পার্কে সাফারীর জন্য জিপসী গাড়ি বা ক্যান্টারের আসন ভাড়া হোটেল মালিকরাই করে থাকে। কারন আগে থেকে সময় বেঁধে দিয়ে গাড়ি বুকিং না দিলে এখানে কোন অবস্থাতেই জিপসী বা ক্যান্টার গাড়ির আসন পাওয়া সম্ভব না। পর্যটকদের ভীড় সবসময় লেগেই আছে। প্রথম দিন বেলা ২:৩০মিনিট ও পরের দিন ভোর ৬:৩০মিনিট দুই দিনের জন্য জিপসী জীপের বন্দোবস্ত করা ছিলো।
 
সাফারি রাইডগুলি ভোর ৬:৩০ এবং দুপুর ২:৩০ এ চালানো হয়। প্রতিটি যাত্রা প্রায় ৪ ঘন্টা চলে। সাফারিটির জন্য যানবাহনের দুটি বিকল্প রয়েছে। ২০ সিটার ওপেন টপ ক্যান্টার বা ৬ সিটার ওপেন টপ জিপসি। প্রতিটি যাত্রায় ভারতীয় জাতীয়তার জন্য প্রতি জন ৯০০ - ১৪০০ টাকা এবং বিদেশী নাগরিকের জন্য ২০০০ - ২৫০০টাকা ব্যয় হয়। পাঠকদের বুঝার জন্য একটু পরিস্কার করে বলছি। ভারতীয় নাগরিকরা যদি কেন্টারে সাফারী করে তবে জনপ্রতি ৯০০টাকা। আর জিপসী জীপে সাফারী করলে ১৪০০টাকা। তেমনি ভাবে বিদেশীদের খরচ।
 
এখানেও পার্ক অঞ্চলটি ৪টি জোনে বিভক্ত হয়েছে এবং সাফারি যানগুলি অর্ধ বেলায় ২টি জোনের বেশী যেতে পারে না। বাঘের দেখা খুব কম দেখা যায় বলে দর্শনার্থীরা প্রায়শই একাধিক ভ্রমণ করেন। সওয়াই মধপুর থেকে জাতীয় উদ্যান প্রায় তিন কিলোমিটারের পথ। এই তিন মিটার এলাকা জুড়েই রাস্তার দুই ধারে অনেকগুলি রিসর্ট রয়েছে। আমরা শুরুতেই একটি তিন তারকা মানের হোটেলে ছিলাম।
(চলবে)
0 Shares

১৭টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ