মামাকে দেখতে যাওয়া (পর্ব-২৯)

শামীম চৌধুরী ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২০, শনিবার, ০৫:১৮:২৮অপরাহ্ন ভ্রমণ ২২ মন্তব্য

আগের পর্বের লিঙ্ক-  মামাকে দেখতে যাওয়া (পর্ব-২৮)

পর্ব-২৯

আমাদের ২০ জনকে নিয়ে কেন্টার বনের ভিতর ছুটে চললো। গাইড সঞ্জিত কে বললাম প্রথমে আমাদের কোন জোনে নিয়ে যাবে? জবাবে বললো ২ নং জোন হয়ে এক নং জোন হয়ে শেষ করবে। কারন যাইতে চাইলে বললো ১ নাম্বারে আগে গেলে এর অর্ধেক পথ ফিরে এসে ২ নাম্বারে যেতে হবে। আর ২ নাম্বারে প্রথমে গেলে পাহাড়ের কোল ঘেঁষা একটা বাইপাস রাস্তা আছে। সেটা দিয়ে প্রবেশ করলে সময় বাঁচবে ও আলো ভাল পাওয়া যাবে।
 
আমরা সঞ্জিতের সঙ্গে আর কোন কথা না বাড়িয়ে কেন্টারে বসে বনের দুই ধারে বণ্য প্রাণী খুঁজছি। এই চলার রাস্তায় বাঘ দেখা যাবে না সেটা আমি নিশ্চিত ছিলাম। কারন বাঘ নিশাচর প্রাণী। রাতের আধারে শিকার খুঁজে। দিনের বেলায় শিকার করা পশুটি খায়। পাঠক বন্ধুদের বাঘের চরিত্র, খাদ্যাভ্যাস, শিকার ধরনের পদ্ধতি ও শিকার ভক্ষন সম্পর্কে কিছুটা ধারনা দিলে তারা বাঘ সম্পর্কে মোটামুটি একটা সম্যক ধারনা পাবে। তাতে করে পাঠকদে বাঘ সম্পর্কে অনেকটাই জানা হবে বলে আমার বিশ্বাস।
 
বাঘের উপর লেখা গবেষক ও শিকারীদের প্রচুর বই পড়েছি। সকলেই বাঘের খাদ্যাভ্যাস,শিকারের পদ্ধতি ও শিকার করা জন্তু ভক্ষন করার সময় সম্পর্কে একই মতামত পেশ করেছেন। কোন শিকারী বা গবেষক দ্বিমত পোষন করেন নাই।
 
ভারত উপমহাদেশে জিম করবেট ছিলেন একজন পেশাদারী শিকারী। তার বাবার সঙ্গে তিনি ও তার বোন ছোট বেলায় ভারতের কুলাধঙ্গীর কুমায়ুনে বসবাস করতেন। তার স্কুল জীবনও কেটেছে কুমায়ূনের নৈনিতালে। জিম করবেট ২০ বছর বয়স থেকে বৃটিশ সরকারের অধীনে ভারতের রেলওয়ে চাকুরী করেন। ছোট বেলা থেকেই তিনি বন্দুক দিয়ে শিকারে অভ্যস্ত ও পারদর্শী ছিলেন। সেই সময় মানুষ খেকো বাঘ শিকারের জন্য বৃটিশরা জিম করবোটকে পাঠাতেন। তার নিজ লেখা জিম করবেট রচনা সামগ্রীতে বাঘ শিকারের লোম হর্ষক কাহিনী বর্ননা আছে। পরবর্তীতে ভারত সরকার তার সফলতার জন্য কুলাধঙ্গীকে জিম করবেট নামকরনঃ করেন। বর্তমানে সেটা এখনও বাঘ অধ্যুষিত অঞ্চল বলে খ্যাত।
 
বাঘ কখনই সম্মুখ বা মুখোমুখি শিকার করে না। বাঘের শিকার করা জন্তুকে সে প্রথমে টার্গেট করে। পরে ধীরে ধীরে কৌশল অবলন্বন করে আগাতে থাকে। যে জন্তুকে সে টার্গেট করবে তাকেই পিছন থেকে শিকার করবে। টার্গেট করা জন্তুটি তার নাগালের মধ্যে চলে আসার সঙ্গে সঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়ে শিকার ধরবে। শতকরা ১ টি শিকার ছুটে যায় বলে গবেষকরা বলেন।
 
বাঘ খুবই অলস প্রানী। ঝোঁপের ভিতর নিজেকে এমন করে আড়ালে রাখে যেন অন্য প্রানীরা দেখতে না পায়। বাঘ সবই দেখে। অথচ বাঘকে কেউ দেখতে পায় না। এরা মাটিতে দেহ মিশিয়ে হামাগুঁড়ি দিয়ে চলতে পারে। যার জন্য অন্যান্য প্রানীর পক্ষে বাঘকে নজরে আনা অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। একমাত্র বানরই বাঘকে দেখতে পায়। বানর তার ডাকে প্রথমেই হরিনকে সজাগ করে। বনের ভিতর হরিনের দ্বিগবিদিগ ছুঁটাছুটিতে অন্যান্য প্রানীরা সজাগ হয়ে যায়। তাই বানরের সঙ্গে হরিনের একটা অলিখিত দোস্তি সম্পর্ক আছে।
 
বাঘ শাবক তার দুই বছর বয়স থেকে শিকার শুরু কর। প্রথমে ছোট ছোট প্রানী দিয়ে শিকারে অভ্যস্ত হয়। এই সকল প্রাণীদের মাঝে বনমেরাগ, ভল্লুক ছানা, শুকরের ছানা ও সজারু উল্লেখযোগ্য। দুই বছর পর্যন্ত ছোট ছোট শিকারে পারদর্শী হয়ে প্রথমেই টার্গেট করে বনের হরিনকে। পরে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শুকর, বন্যগরু বা মহিষ, প্রাপ্ত বয়স্ক ভল্লুক, হাতি থেকে সব জন্তুই শিকারের টার্গেটে আনে।
 
বাঘ রাতে শিকার করে প্রথমেই জন্তুরটির রক্ত ও পেটের নরম অংশ সহ নাড়িভুঁড়ি খায়। পরবর্তীতে মড়িটাকে ( শিকার করা মৃত জন্তুটিকে গবেষকরা মড়ি নামকরন করেছে) ঝোঁপের ভিতর পাতা দিয়ে আড়াল করে রাখে। যেন অন্য প্রাণী মড়িটিকে দেখতে না পায়। মড়ি উম্মুক্ত থাকলে শকুন বা ঈগল জাতীয় পাখির উপদ্রব বেড়ে যায়। লুকানো মড়িটির দেহ পঁচার জন্য ৬/৭দিন রেখে দেয়। দেহটি পঁচে আসলে নরম হয়। তখন খাবারে সুবিধা হয়। মড়িটিকে ৩/৪ দিন ধরে খায়। গবেষকদে গবেষনায় জানায় যায় যে, মড়ির লোম সহ খায়। গবেষকরা বাঘের মলে লোমের অস্তিত্ব পেয়েছেন। দিনের বেলায় জলাশয় বা মিঠা পানি আছে এমন জায়াগায় পানি খেয়ে সারাদিন ঘুমায়। মোটমুটি এই হলো বাঘের খাদ্যাভ্যাস।
 
বাঘের আরেকটি বৈচিত্রময় চরিত্র হচ্ছে প্রজননকাল। প্রজনন সময়ে পুরুষ বাঘ মেয়ে বাঘের সঙ্গে জুটি বাঁধে। সঙ্গমের পর মেয়ে বাঘ পুরুষ বাঘ থেকে আলাদা হয়ে যায়। তখন তার সঙ্গিনীকে খুঁজে পাওয়ার জন্য বাঘ হিংস্র হয়ে উঠে। সে সময় গাছ-পালা উপড়ে ফেলারও ইতিহাস আছে। বাঘের হুংকারে বনের মাটি পর্যন্ত কেঁপে উঠে। বাঘিনী পুরুষ বাঘ থেকে আলাদা হবার মূল কারন হলো প্রসব করা বাচ্চা পুরুষ বাঘ খেয়ে ফেলে। কারন সে সঙ্গমের পর যে সুখ পায় তা অন্য কাউকে ভাগ বসাতে দিতে চায় না। তার ধারনা এই বাচ্চারা তার প্রজনন সুখের বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে। সবই বিধাতার নিয়ম। তাই বাঘিনী সঙ্গমের পর এমন জায়গায় পালিয়ে যায় যেখানে পুরুষ বাঘ তাকে খুঁজে পায় না। ইতিহাস থেকে জানা যায় সঙ্গমের পর বাঘিনী পুরুষ বাঘ থেকে শত মাইল দূরে কোন গুহায় বা বড় গাছের খোঁড়লে বাসা বানিয়ে সেখানেই বাচ্চা প্রসব করে। মূলতঃ বাঘিনীই বাচ্চাদের পরিচর্যা ও খাদ্যাভ্যাস গড়ে তুলে।
 
আমরা অনেকেই শুনে থাকি মানুষখেকো বাঘের কথা। একটা প্রশ্ন আমাদের মাঝে থেকেই যায়। বাঘ কেন মানুষখেকো হয়? বাঘের মানুষখেকো হবার পিছনে গবেষকরা দুটি কারন উল্লেখ করেছেন। প্রথম কারনে বলেছেন, বাঘ বয়সপ্রাপ্ত হলে বা বার্ধ্যকে চলে আসলে তখন কষ্ট করে শিকার ধরার শক্তি পায় না। শিকারের জন্য চারটি দাঁত ও থাবার নখ ভেঙ্গে যায়। যার জন্য শিকার করা জন্তুর সঙ্গে শক্তিতে জয়ী হতে পারে না। এত পরিশ্রম করে শিকার ধরতেও পারে না। তখন সে জনবসতি গ্রামে বা লোকালয়ে রাতে চলে আসে। রাতের বেলায় প্রাকৃতিক ডাকে সাড়া দেবার জন্য মানুষ যখন ঘর থেকে বের হয় তখন শিকার ধরতে বাড়ির আশে পাশে ঘাপটি মেরে বসে থাকে। তাতে বাঘের কোনই পরিশ্রম হয় না। আর একবার মানুষের রক্ত মাংসের স্বাদ পেলে তখন সে অন্য জন্তু শিকারের আগ্রহ হারিয়ে ফেলে।
 
দ্বিতীয় কারনটি উল্লেখ করেছে বাঘের বাচ্চা যখন শিকার শুরু করে তখন প্রথমেই সে সজারু দিয়ে শুরু করে। সজারু একটা অদ্ভত আত্মরক্ষামূলক প্রাণী। তার দেহ অসংখ্য সুচারুর মতন কাঁটায় আবৃত। কাঁটাগুলি ৫ ইঞ্চি থেকে ৯ ইঞ্চি দৈর্ঘ্যের হয়। সজারু বাঘের থাবায় পড়লে প্রানে বাঁচার জন্য তার দেহের কাঁটা দিয়ে বাঘকে আঘাত করে। তখন বাঘের শরীরে ৫০-৭০টি বিভিন্ন আকারের কাঁটা প্রবেশ করে। এই কাঁটাগুলি ধীরে ধীরে বাঘের শরীরে পঁচন ধরায়। আবার এই কাঁটার কিছু সংখ্যাএমনিতেই ভাল হয়ে যায়। যে কয়টি কাঁটা দেহে গেঁথে থাকে সেগুলির বিষ বেদনার যন্ত্রনায় ধীরে ধীরে বাঘ দূর্বল হয়ে পড়ে। তাই বলে তার খাবার বন্ধ থাকতে পারে না। এমন পরিস্থিতিতে পড়লে তখন সেই বাঘটি মানুষখেকো হয়ে উঠে। আবার অনেক সময় মারাও যায়।
 
পাঠক বন্ধুরা, যদিও আমরা বাঘের দেখা পাইনি। তারপরও ভ্রমন গল্পের শিরোনাম যেহেতু ”মামাকে দেখতে যাওয়া” তাই ভাবলাম বাঘ সম্পর্কে একটু আলোকপাত করা প্রয়োজন। আমি বিশ্বাস করি, পাঠক বন্ধুদের কিছুটা হলেও বাঘ সম্পর্কে ধারনা দিতে পারলাম।
 
২ নাম্বার জোনে ঢুকার পথে আমরা বেশ কিছু বণ্যপ্রাণী দেখলাম। খুব কাছ থেকেই এদের দেখা পেলাম। মনে মনে কল্পনা করলাম, আহারে যদি মামাকে এমন কাছ থেকে দেখা যেত তবে জীবনের একটি অপূরনীয় শখ পূরন হতো। এমনটি ভাবতে ভাবতে আমরা কয়েক প্রজাতির বন্যপ্রানীর ছবি তুললাম। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য মুখপোড়া হনুমান,সম্বর,হরিন ও বণ্য শুকুর। হরেক প্রজাতির পাখিরও দেখা পেলাম। যেহেতু বণ্যপ্রাণী অধ্যুষিত এই বন তাই পাখির দিকে খুব একটা নজর দিলাম না। তারপরও নেশাতো কাটে না। বামুনে শালিকের ছবি তুলে আমরা যখন ১ নাম্বার জোনের দিকে অগ্রসর হলাম তখন সময় বেলা ৩:৩০মিনিট।
মুখপোড়া হনুমান।
বণ্যশুকর।
সম্বর হরিন।
বামুনে কাঠশালিক।
চিতল বা চিত্রা হরিন।
(চলবে)

 

0 Shares

২২টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ