মামাকে দেখতে যাওয়া- পর্ব(৪)

শামীম চৌধুরী ১৬ মে ২০২০, শনিবার, ০৩:০৭:২৮পূর্বাহ্ন ভ্রমণ ২৬ মন্তব্য
বনের গাইড রতন কৈরালার কাছে বাঘের সঠিক হিসাবটা জানার পর মনে হলো বণ্যপ্রানী চোরাকারবারী বা পাচারকারী শুধু বাংলাদেশে নয়। পৃথিবীর সব দেশের বনেই আছে। সেই মহুর্তে দীর্ঘদিনের চেপে থাকা ক্ষোভটা একটু প্রশমিত হলো। কারন ধারনা ছিলো শুধু আমাদের দেশেই বনরক্ষীদের সহযোগিতায় চোরাকারবাীরা বনের কাঠ ও বণ্যপ্রানী পাচার করে।মনে শান্তি পেলাম রতনের কাছে থেকে জানার পর।
 
কথার ফাঁকে ফাঁকে আমাদের জিপসী গাড়ি ধীর গতিতে বনের রাস্তা ধরে সামনের দিকে যাচ্ছে। হঠাৎ গাড়ি থামিয়ে রতনকে গাড়ির চালক ইশারা দিলো। রতন বুঝে গেল। পরে আমাদেরকে বললো শব্দ করবেন না। রতনের নির্দেশে ভাবলাম হয়তো মামার দেখা পেয়েছে। সবাই চুপ হয়ে রইলাম। উত্তেজনা বেড়ে গেল। সাথে ভয়ও। হাতের লোম কাটা দিয়ে দাঁড়িয়ে গেল। একদিকে জীবনের প্রথম খোলা গহীন বনে বাঘ দেখার আনন্দ আরেক দিকে ওয়াইল্ডলাইফ ফটোগ্রাফীতে এই প্রথম বাঘের ছবি তোলা। যা আমাদের দেশে হাতে গোনা কয়েকজন ফটোগ্রাফার বাঘের ছবি সুন্দরবন বা দেশের বাহির থেকে তুলতে পেরেছেন। বেশ কিছুক্ষন আমরা পিনঃপতন চুপ হয়ে গাড়িতে বসে আছি। কিছুক্ষন পর রতন গাড়ির চালককে বললো হাত দুয়েক সামনে যেয়ে গাড়ির স্টার্ট বন্ধ করতে। পরে আমাদেরকে আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করে নিম্নস্বরে বললো সাহাব’জি উধার Blue Buffalo মানে নীলগাই।
নীলগাই (পুরুষ)
জীবনের প্রথম খুব কাছ থেকে নীলগাই দেখা। তাও আবার পুরুষ নীলগাই। আমার ভ্রমনে বন্যপ্রাণীর মধ্যে নীলগাই ছিলো তালিকার দুই নাম্বারে। এটা পেয়ে বেশ ভালো লাগলো আর আনন্দে মনটা ফুরফুরা হয়ে গেল। যে যার মতন ছবি তোলা শুরু করলাম। কোন শব্দ নেই। শুধু মেশিনগানের গুলির মতন ক্যামেরার শাটারের শব্দ। যে শব্দ পাঠক নিজ কানে না শুনলে বুঝতে পারবেন না। বিরতিহীন ৬টি ক্যামেরার শাটারের শব্দে নাকি রতনের কাছে মনে হয়েছে কোন এক যুদ্ধক্ষেত্রে গুলির আওয়াজ হচ্ছে। রতনের কথা শুনার পর সবাই হা হা করে হেসে উঠলাম।
পুরুষ নীলগাইয়ের ছবি তোলার পর কয়েকশত ফুট সামনে যাবার পর আবারও দেখা পেলাম নীলগাই এর। তবে এটা মেয়ে নীলগাই। একই ভ্রমনে পুরুষ ও মেয়ে এক সাথে পাওয়াটা অনেকটাই ভাগ্যের। ফটোগ্রাফীতে নাকি আমার ভাগ্য ভাল। সঙ্গে থাকা বন্ধুরা তাই বলে। সবাই মেয়ে নীলগাই এর ছবিও তুললাম।
বহু বছর আগে আমাদের দেশে নীলগাইয়ের অস্তিত্ব ছিলো। আজ বিলুপ্ত। মাঝে মাঝে ভারত থেকে দুই একটা চাপাইনবাবগঞ্জের রহনপুর সীমান্ত দিয়ে দুই একটা নদী পার হয়ে খাবার জন্য চলে আসে। গতবছর এমন একটা মেয়ে নীলগাই রাজশাহীতে পাওয়া যায়। পরে সেটাকে সেবা শুশ্রষা করে ডুলহাজারী সাফারী পার্কে ছেড়ে দেয়া হয়। দুই সপ্তাহ পর সেই মেয়ে নীলগাইটি মারা যায়।
নীলগাই মেয়ে
গাড়ি এবার কিছুটা গতিতে ছুটে চলছে। গাড়ির গতি বাড়ানোর কারন জানতে পারলাম সামনে বাঘের আরো বেশ কয়েকটি স্পট আছে। এক জায়গায় অনেকক্ষন সময় নষ্ট হলে পরে সূর্যের আলো না থাকার সম্ভবনা বেশী। যেখানে নীলগাইয়ের ছবি তুলেছি সেটাও নাকি বাঘের একটা স্পট। মাঝে মাঝে মামাকে এখানে দেখা যায়। গাইড ও গাড়ির চালক কোন অবস্থাতে আমরা যেন নিরাশ না হই সেদিকে তাদের মনোনিবেশ ছিলো চোখে পড়ার মতন। রতনের কাছে সূর্যের আলোর স্বল্পতার কথা শুনার পর আমার মনে পড়ে গেল, আমি সবসময় বলি -
”চিত্রশিল্পী ছবি আঁকে রংও তুলি দিয়ে
আলোকচিত্রী ছবি তুলে আলো দিয়ে”।
 
এখন যে স্পটটাতে যাচ্ছি সেটার নাম চিতল টাইগার জোন। বেশ কিছুদিন আগে এখানে বাঘিনীর সাথে দুটি বাঘের শাবক দেখা গেছে। শুনেই আবারো উত্তেজনা বেড়ে গেলা। রতনকে আমরা সবাই বললাম যদি তুমি আমাদের আজ বাঘ দেখাতে পারো তবে আমরা সবাই তোমাকে খুশী করে দিবো। জবারে রতন বললো সাহাব’জী এ্যা ম্যারা ফরজ। আপলগোকো ঘুমানা। কই জায়গা ছোড়ঙ্গাী নেহি। হার জায়গামে পাত্তা পাত্তা ছান মারুঙ্গী। বখশিষকা কই জরুরত নেহি। রতনের মুখে কথাগুলি শুনার পর ওর উপর বিশ্বাস ও ভালবাসার জন্ম নিলো।
 
চিতলে পৌছার বেশ আগে আমাদের মাঝে প্রফেসর আমিনুর রহমান ভাই চিৎকার দিয়ে উঠলেন। আমাকে বললেন শামীম ভাই গাড়ি থামান। আমি রতনকে গাড়ি থামানোর জন্য বললাম। ভাবলাম মামার দেখা পেল নাকি? পরে আমিন ভাই দেখালেন Indian hare বা ভারতীয় খরগোশ। ওয়াইল্ডলাইফ ফটোগ্রাফীতে এটাও আমার সংগ্রহে ছিলো না। আমরা গাড়িতে দাঁড়িয়ে সবাই খরগোশের ছবি তুললাম। বনের ভিতর কোন পর্যটককে গাড়ি থেকে জমিনে বা মাটিতে নামার কোন অনুমতি নেই। সম্পূর্ন নিষিদ্ধ। গাইডকে শতকোটি টাকা দিলেও সে কোন পর্যটককে এ সুযোগ করে দিবে না। কারন জানতে চাইলে জবাব পেলাম যদি বাঘ বা অন্য কোন বণ্যপ্রানীর আক্রমনে কোন দেশী বা বিদেশী পর্যটকের প্রানহানী হয় তবে তার সমস্ত দায়দায়িত্ব বন বিভাগের। যার জন্য এই একটা ক্ষেত্রে ওরা কোন আপোষ করতে রাজী নয়। তাছাড়া বেশ কয়েকটি হিংস্র প্রাণী এই বনে আছে। যারা মানুষ হত্যার করার যোগ্যতার আছে। তাদের মধ্যে বেঙ্গল টাইগার, হায়ানা ও কালো চিতাবাঘ অন্যতম।
Indian hare বা ভারতীয় খরগোশ।
মামাকে দেখতে যাওয়া পর্ব-৩ এ আমি সারিস্কা টাইগার ফরেষ্টে বেশ কিছু বণ্যপ্রানী ও পাখির নাম বলেছিলাম। যা আমাদের গাইড রতন কৈরালা থেকে জেনেছিলাম।
 
সেখানে আমাদের সবার প্রিয়, ব্লগের প্রাণপুরুষ ও আমার স্নেহের শ্রদ্ধাভাজন ব্যাক্তি ইঞ্জা ভাই আমার সেই পর্বে মন্তব্যে জানতে চেয়েছিলেন ভারতীয় সোনালী কাঁঠাল ও অসম্পূর্ন মাঙ্গুজ সম্পর্কে। সেটাকে আমাদের দেশে বলে Cerb eating Mangoose. আর সোনালী কাঁঠাল হচ্ছে আমাদের দেশের Golden jackal বা সোনালী শিয়াল।
 
আমি ইঞ্জা ভাইয়ের মন্তব্যের জবাবে বলেছিলাম পরবর্তী পর্বে ছবি সহ দিবো। যাতে সব পাঠক/পাঠিকারাও প্রানী দুটি সম্পর্কে জানতে পারে। ইঞ্জা ভাইয়ের জানার আগ্রহকে সম্মান দিয়ে প্রানী দুটির ছবি দিলাম।
Cerb eating Mangoose. বা অসম্পূর্ন ম্যাঙ্গুজ।
Golden jackal বা সোনালী কাঁঠাল।
ভারতীয় খরগোশের ছবি তোলার পর আমার ছেলে দেখতে পেলো গাছ থেকে একটি সাপ নামছে। আমাকে বলে বাবা সাপ দেখলাম। আমি বললাম কোথায়? সে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো। ততক্ষনে সাপটি এমন জায়গায় চলে গেছে তা ক্যামেরায় ছবি তোলা সম্ভব না। পরে রতন বললো এখানেই ওর বাসা আছে ও বাচ্চা আছে। আমি জানতে চাইলাম তুমি কি করে বুঝলে? জবারে জানালো সাহাব’জী বিশ সাল এ্য বনমে হ্যায়। কাহা কাহা বনমে কোন জীব ঘুমতা ফিরতা সব আমলে হ্যায়। পরে সে সাপের বাচ্চা সহ বাসাটা দেখিয়ে দিলো। আমরা সবাই ছবি সাপের ছবি তুললাম।
Indian Rock Python (Baby)বা ভারতীয় অজগর
চলবে-
0 Shares

২৬টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ