মনের গহিনে

আজিম ১৭ আগস্ট ২০১৫, সোমবার, ১১:৫১:৪৫পূর্বাহ্ন একান্ত অনুভূতি ১০ মন্তব্য

সুন্দর ছিল দিনটি, রৌদ্রজ্জ্বল। মানুষ অবাধে যাতায়াত করতে পারে যেখানে খুশি সেখানে, করেওছে, কোন সমস্যা হয়নি । গাড়ী, বাস ভাড়া করে বহুদুর থেকে অতি প্রত্যুষে রওনা দিয়ে এসে পড়ছে নির্দিষ্ট স্থানটিতে। আশপাশ থেকেও এসেছে প্রচুর মানুষ বাড়ীটির কাছে, এসে আটকে পড়েছে যানজটে। বহুদুর হাঁটতে হাঁটতে তবুও ছুটে চলেছে মানুষ, বেলা বেড়ে যাচ্ছে, শ্রদ্ধা জানাতে দেরী হয়ে যাচ্ছে যে। চল্লিশ বছর আগে অসহায় অবস্থায় এই বাড়ীটিরই সিঁড়িতে অত্যন্ত করূনভাবে মৃত্যুবরণ করেন তিনি, আমাদের পথপ্রদর্শক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আজ তাঁর চল্লিশতম শাহাদাত বার্ষিকী।

ভোর সাতটার আগেই লোকে লোকারন্য হয়ে পড়েছে বত্রিশ নম্বর বাড়ীটার আশপাশ। মহামানবের প্রতিকৃতির পাশেই মাইকে ব্যানার দেখে দেখে ঘোষণা দেয়া হচ্ছে, এবার শ্রদ্ধা নিবেদন করছেন ওমুক সংগঠন, ওমুক পার্টি। ৪০/৫০ গজ পথ অতিক্রম করতে তাই লেগে যাচ্ছে দেড়/দুই ঘন্টা। অবশ্য সিরিয়াল ভঙ্গ করে সাইড মারতেও দেখা গেছে অনেককে, এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি। খুব কী তাড়া ছিল আপনার স্যার?

সাতচল্লিশের পর থেকে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্থান কর্তৃক এই ভূখন্ড (পূর্ব পাকিস্থান) চরমভাবে শোষিত হতে থাকে এবং যেহেতু এই দুই প্রদেশের মধ্যে ছিল ভৌগোলিক বিশাল ব্যবধান এবং শাসকগোষ্টির প্রায় সকলেই ওই ভূখন্ডেরই, তাই ক্ষমতার কারনে এদেশের মানুষকে তারা চরম অবজ্ঞা করতে থাকে। এই ভূখন্ডের কেউ পায়না কোন উচ্চপদের চাকরী, এই ভূখন্ডের উৎপাদিত অর্থকরী ফসল হতে প্রাপ্ত রাজস্ব ওই ভূখন্ডের বড় বড় শহর গড়ে তুলতে ব্যয় করা হয়। দ্রত শ্বশান হতে থাকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্থান, আমাদের আজকের প্রিয় বাংলাদেশ।

যুবক বয়স থেকেই বঞ্চণার এই চিত্রগুলো তুলে ধরতে থাকেন যুবক শেখ মুজিবুর রহমান। এরই একপযার্য়ে উর্দুকে পাকিস্থানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা আসে পাকিস্থানের প্রধান শাসক কায়েদে আযমের নিকট থেকে। আর এ ঘোষণায় ফেটে পড়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্থানের ছাত্রসমাজ তথা সবর্স্তরের মানুষ। প্রচন্ড ক্ষোভ জমতে থাকে মানুষের মনে পাক শাসকদের বিরুদ্ধে। এই ক্ষোভ জমতে জমতে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে গড়ে ওঠে বৃহৎ আন্দোলন, গড়ে ওঠে ছেষট্টির ছয় দফা, উণসত্তরের অসহযোগ আন্দোলন, যার ধারাবাহিকতায় আসে সত্তরের নির্বাচন । নিবার্চনে নিরঙ্কুশভাবে জয়লাভ করেও পাক শাসকদের ষড়যন্ত্রে শাসনক্ষমতা পায়না সম্পূর্ন গণতান্ত্রিকভাবে নিবার্চিত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।

না, গর্জে উঠতে এতটুকু দ্বিধা করেননি তিনি। গর্জনের চুড়ান্ত প্রকাশ ঘটিয়ে ফেলেন ৭ই মার্চ্চ, উনিশশো একাত্তর। ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে কোনরকম পূবর্প্রস্তুতি ছাড়াই তাঁর রাজনৈতিক জীবনের সবটুকু উজাড় করে দেন এদেশবাসীর বরাবরে। জানিয়ে দেন আর সম্ভব নয় ওদের সাথে, দেশবাসীকে প্রস্তুত হওয়ার অতি সুষ্পষ্ট নির্দেশ দিয়ে দেন তিনি সেদিন।

২৫শে মার্চ্চের কালোরাতে তাঁর একান্ত বিশ্বস্ত সহযোগী অনেকের অনুরোধ সত্ত্বেও আত্মগোপনে যাননি তিনি সম্ভবত: তাঁর অহমে লেগেছিল বলে। তিনি শেখ মুজিব, বাঙ্গালী জাতির অবিসংবাদী নেতা, তিনি পালিয়ে যাবেন! দুই ভূখন্ডের সর্বময় সিদ্ধান্ত নেয়ার বৈধ মালিক তিনি, কে আছে তাঁর কিছু করার? আর করলে করবে, তবুও আমি পালিয়ে যাওয়ার শেখ মুজিব নই। আমার ক্ষুদ্রজ্ঞানে এজন্যই তিনি ভারতে রওনা হননি। বঙ্গবন্ধু যে অনেক বড় মাপের নেতা, তা প্রমানের অনেক ঘটনার মধ্যে এটাও একটা বিরাট ঘটনা।

৭২ থেকে ৭৫, সাড়ে তিন বছরের তাঁর শাসনামল সম্পর্কে অনেকে মুখর হয়ে ওঠেন। আমিও কিছুটা হইনা বললে মিথ্যা বলা হবে। তবে সেটা আমি হই সন্তান হিসেবে পিতার সমালোচনায় কিঞ্চিৎ, আর কিছু নয়। বঙ্গবন্ধু মানুষ ছিলেন, আর মানুষের ভুল হবেই। বলা যায় ভুল হয় বলেই আমরা মানুষ, নতুবা ফেরেশতা হয়ে যেতাম আমরা। নয়মাসের যুদ্ধে ধ্বংসের একেবারে শেষপ্রান্তে এসে পড়েছিল এদেশ। যুদ্ধবিধ্বস্ত একটা দেশের পূন:র্গঠন যে কী পরিমান কষ্টসাধ্য, তা শুধু তিনিই জানতেন। তবে বঙ্গবন্ধু চেষ্টা করেছিলেন সবর্শক্তি দিয়ে, একান্তভাবে এটা বিশ্বাস করি। কোনো কোনো গভীর রাতে সেসময় ছাত্রলীগের বেড়ে-যাওয়া ছেলেদের বাড়ী বাড়ী গিয়ে রক্ষীবাহিনী হানা দিয়ে কঠোরভাবে ডান্ডাপেটা করতো। এক জেলার এরকম এক ছাত্রলীগ নেতা সেসময় রক্ষীবাহিনীর মার খেয়ে আজো মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে রয়েছেন বলে জানা গেছে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শের পথেই আছে দেশ। ৪০তম জাতীয় শোকদিবসে বিভিন্ন আলোচনা সভায় এই কথাটিই এসেছে ঘুরেফিরে আলোচকদের আলোচনায়। কিন্তু আসলে আমরা বঙ্গবন্ধুর আদর্শ থেকে যোজন যোজন দুরে সরে গেছি। আমরা তাঁর মহান আদর্শের জায়গায় ফিরে আসতে পারছিনা কোনমতেই। এর কারন যে যাই বলুক না কেন, আমরা তাঁর আদর্শকে শ্রদ্ধা করছিনা, এযুগে অচল মনে করছি তাঁর আদর্শ। আর তাই দেশব্যপী দুর্নীতির মহোৎসবকে স্বাভাবিক বলে ধরে নিয়েছি। মহাত্মা গান্ধীর ভক্ত ছিলেন বঙ্গবন্ধু। কী দেশ শাসনে, কী আন্দোলনে আমরা মহাত্মা গান্ধীর মত হয়ে উঠতে পারছিনা। হয়ে উঠতে পারছিনা মুসলিম বিশ্বের মহান খলিফা হযরত ওমর (রা:)-এঁর মতোও।

আর একদল মানুষ আছে নির্লজ্জের মত এই দিনটিতে জন্মদিন পালন করে চলেছে। এমন নয় যে, এটা তার জন্মদিন। তাহলে ৯৬-এর আগে পালন করা হয়নি কেন? ওটা পালনের সময় কী তাদের মনে পড়েনা, যে মহামানবের আহ্বানে আমরা বুঝতে শিখেছি আমাদের একটা স্বাধীন দেশ দরকার, আর তা কীভাবে সম্ভব সেটারও দিকনির্দেশনা পেয়ে গেছি যে মহামানবের কাছ থেকে, ঘাতকের নির্মম আঘাতে নিজ বাড়ীর সিঁড়িতে অসহায় তিনি পড়ে ছিলেন ঠিক এই দিনটিতে রক্তাক্ত মুখে?

জন্মদিন হলেও তো তা পালন করা অপরাধ হচ্ছে কিনা, সেটা নিয়ে দ্বিধায় পড়েন বিবেকবান মানুষেরা। আর ভূয়া জন্মদিন ঘটা করে পালন করা...

কী নির্লজ্জতা!

0 Shares

১০টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ