বিশ্বাসে বড় আস্থা আমার।

রিতু জাহান ৩০ অক্টোবর ২০১৮, মঙ্গলবার, ০৬:৫৮:৫১অপরাহ্ন একান্ত অনুভূতি ১৯ মন্তব্য

বেশ কয়েকদিন থেকে শরীরটা ভালো যাচ্ছিলো না। আমি খুব আশাবাদী ও প্রানচঞ্চল একটা মানুষ। সহজে ভেঙ্গে পড়ি না। হতাশা নামক বস্তুটাকে দূরেই রাখি। প্রাণ দেই না কখনো তাকে।
তবু এ হঠাৎ হঠাৎ জ্বরটায় আমি ভেঙ্গে পড়েছিলাম মনে মনে। টেস্ট করালাম টাইফয়েড ধরা পড়লে, এর কোর্স শেষ করলাম। কিন্তু কিছুদিন পর আবারো সেই একদিনের জ্বর। এ একদিনের জ্বরে আমার মনে হতো আমি অনেকদিন অসুস্থ ছিলাম। একদিনের জ্বরে ভয় পাবার কিছু নেই। কিন্তু আমি ভয় পেলাম, কারণ, আমার রিয়ানকে এখনো কিছু সময় আমাকে দিতে হবে। আমি মারা গেলে আমার দুইটা বাচ্চাকে একবেলা ভাত রান্না করে দিবে এমন কেউ নেই। তাছাড়া আমার শাশুড়ি ও ননদের তিন চারটা অপারেশন করার সময় আমি বুঝেছি অসুস্থ হয়ে হসপিটালে পড়ে থাকলে কতোটা অসহায় থাকে একজন মানুষ।
এবার রংপুর ও কুড়িগ্রামে পুরো সব টেস্ট করালাম আমার।
জুলফি বলল, রিপোর্ট একবারে পরে নিবে  ডাক্তারের কাছে যাবার সময়।

কিন্তু  মনে মনে আমি বেশ অস্থির হয়ে আছি এটা তাকে বুঝতে দেইনি। এটা আমার স্বভাব, আমি আমার অস্থিরতা, সমস্যা কখনো কাউকে বুঝতে দিতে চাই না।
আমি একাই চলে গেলাম রিপোর্টগুলো আনতে। রিপোর্ট আনতে যাবার সময় রিক্সায় বসে হাজার কথা ভাবছি। এলোমেলো সব কথা।
আমি উপরের দিকে তাকিয়ে তাকে এবার নিয়ে চতুর্থবার প্রশ্ন করলাম। আমি জানি তিনি এবারও হাসছেন আমার কথায়। আমাকে তিনি খুব ভালবাসেন এটা আমি জানি। বিশ্বাস করি সে আমার কোনো ক্ষতি হতে দিবে না। আমার এ বিশ্বাসকে আমি বড় বিশ্বাস করি।
তার সৃষ্টিকে আমি সব সময় ভালবেসেছি। তার সৃষ্টির নিয়মকে আমি কখনো বুড়া আঙ্গুল দেখাইনি। প্রকৃতিকে মেনেছি প্রকৃতির নিয়মে। তিনি চাইতে বলেছেন, আমি তার কাছে প্রতিনিয়ত চেয়েছি। তাকে ডেকেছি আমি আমার মতো করে।
আমি বিশ্বাস করি পরিবার বা আপনজন কারো কোনো বিপদ মানেই আমারও বিপদ। আমি প্রানপন চেষ্টা করেছি তাদের পাশে থাকার। নিজের শ্রম ও অর্থ দিয়ে।

ছোটোছোটো বাচ্চা রেখে দিনের পর দিন হসপিটালে থেকেছি অন্যের পাশে। বিশ্বাস করেছি, যে টাকা বা গয়নাটা আমার আলমারিতে আছে তা যদি অন্যের বিপদে কাজে না লাগে তবে তা গচ্ছিত রেখে কি লাভ! আমি সে গয়নাটা পরে কাকে দেখাব? বা টাকাটা আমি রেখেই বা দিব কোন উদ্দেশ্যে? আমি ভেবে নিব যে এই টাকা জমানো থাকলে আমার কোনো বিপদ আপদ ও অসুখ বিসুখ হলে কাজে লাগবে?
বা আমি কি ভেবে নিব এটা ভবিষ্যতে আমার সন্তানদের কাজে লাগবে? তারমানে কি দাঁড়ালো, আমি নিজের উপর ও আমার সন্তানদের উপর আত্মবিশ্বাসী নই। আমি কি ধরেই নিব যে, আমি তাদের মানুষ করতে ব্যার্থ!
না, মোটেও এই হতাশা নামক জড়বস্তুকে আমি ভাবতে পারিনি। তাই উজাড় করে সব দিয়ে চেষ্টা করেছি আপনজনদের পাশে থাকার।
কিন্তু আমার সে চেষ্টার যারা অবমূল্যায়ন করেছে এটা তাদের ব্যার্থতা। আমি আমারটুকু করেছি। আসলে পুলিশে চাকরি করে এটা একটা বিরাট সমস্যা। সবার ধারনা আমার আছে বলেই দিয়ে দিয়েছি। আরও একটা কথা কি পরিবারে একই ডিপার্টমেন্টে অন্য একজন চরমতম অনৈতিক টাইপ লোক থাকলে সমস্যা আরো তীব্র হয়। মধ্যবিত্ত পরিবারে এ এক বিরাট সমস্যা। যদি সেখানে পাঁচজনে একজন কর্মক্ষম থাকে।

আমি অনেক আগে থেকে কারমা বিশ্বাস করি। তাই আমি আমার এ"কারমার"বা ফল পেয়েছি। বার বার পেয়েছি। মানুষের অফুরন্ত শ্রদ্ধা ভালবাসা পেয়েছি। প্রফেশনের দিক থেকে জুলফিকে যারা কাছ থেকে চিনে তারা জানে সে কেমন মানুষ।

আমার প্রথম সন্তান মারা যাবার পর আমি কনসিভ করতেছিলাম না। অবশেষে তিন বছর পর ডাক্তার পারভিন ফাতেমার কাছে গেলাম। তিনি আমার সব পরীক্ষা করার পরে জুলফিকে আমার সামনেই বলে দিলেন, আমি আর কখনোই স্বাভাবিকভাবে বাচ্চা কনসিভ করবো না। আমার ইউট্রাস খুবই সরু হয়ে গেছে। আমাকে কনসিভ করতে হলে টেস্টটিউবে যেতে হবে। উনি একটা খরচের এমাউন্ট বললেন। এবং সে খরচটা আমার জন্য অনেক কষ্টসাধ্য ছিলো। তিনি বেশকিছু টেস্ট দিলেন। তা প্রায় তখনকার হিসেবে ২০০৩ এর সময়ে পঁচিশ হাজার টাকার মতো। উনি তখন শ্যামলী দুই নাম্বার রোডে ওনার বাসায় প্রাকটিস করতেন। আমরা দুজনে ওনার চেম্বার থেকে বের হয়ে শ্যামলীতেই এক ল্যাবে গেলাম। সব টেস্ট দেখে রিসিট কাটবে সে সময় আমি জুলফিকারের হাত ধরে টেনে বাইরে বের করে আনলাম। আমার দুই চোখ বেয়ে তখন পানি পড়ছে। তখন বানিজ্যমেলা চলছিলো। জুলফি আমাকে রিক্সায় করে ওদিকে যেতে লাগলো। শ্যামলী শিশুমেলার পাশ দিয়ে যাবার সময় বাচ্চাদের দেখে প্রচন্ড কান্না আসতেছিলো। আমি তখন দ্বিতীয় বার উপরে তার দিকে প্রশ্ন তুলে দিলাম। আমার অপরাধ জানতে চাইলাম। তখনও সে হেসেছে আমি জানি।

সত্যি কি অদ্ভুত! তার রহমত। আমি সে মাসেই কোনো ট্রিটমেন্ট ছাড়াই কনসিভ করলাম। শ্যামলী আল-মারকাজুলে বসতো রোকসানা আইভি আপা। উনার ওখানেই আমার দুই বাচ্চা হলো নরমাল ডেলিভারি। এ নরমাল ডেলিভারিও তার রহমত। কারন, তখন আমার শশুর শাশুড়ি দুজনেই বেশ অসুস্থ। শাশুড়ির অপারেশন। বড় ননদ তখন অসুস্থ হয়ে ঢাকা আমার বাসায়। সব মিলায়ে প্রচুর খরচ। সবমিলিয়ে আমি তাকে বললাম,"তুমিই রহমত করবে আমি জানি।" হুম তিনি রহম করেছিলেন। মেমন হতে মাত্র ছত্রিশশো টাকা আর রিয়ান হতে বিয়াল্লিশশো টাকা আমার খরচ হলো।
শুকরিয়া করেছি তার। তার সাথে আমার
এসব কথায় মান অভিমান আল্লাদ থাকে।

এর মাঝে মেমন হওয়ার ঠিক দুই দিন আগে একটা ঘটনা ঘটে।
*আমি শুয়ে আছি। ভোরের দিকে দেখছি জীনেতা এসে বসছে আমার পায়ের কাছে। সে সময় ওর যে বয়সটা হওয়ার কথা ঠিক সেরকম। চমৎকার একটা ফ্রক পরে আছে। কিছুক্ষণ পরই দেখি ও উঠে জানলা দিয়ে চলে যাচ্ছে। আমি চিৎকার করে ওকে ডাকতেছিলাম। আমি তখন ওকে হাসতে হাসতে চলে যেতে দেখলাম। এ পর্যন্ত আর কোনোদিন ওকে আমি দেখিনি।

হসপিটালে পৌছে গেছে রিক্সা আমার কখন টেরই পাইনি। রিপোর্ট পেয়ে সাথে সাথে চেক করলাম। যেটুকু বুঝলাম তাতে আলহামদুলিল্লাহ্ রিপোর্ট সব নরমাল।

মাসের শেষ, মেমন সোনার জন্য কিছু জিনিস কিনতে হবে। ওর সাথে দেখা করতে যাব। মনে হলো ব্যাগে এতো টাকা তো হবে না। রিক্সা থেকে নেমে দুই তিনবার ব্যাগ চেক করলাম। কতোটুকু কিনতে পারব তার একটা হিসেব করলাম। ভিতরে ভিতরে আমার কান্না আসতেছিলো। ছেলের জন্য কিনব অথচ আমি হিসেব করছি! জিনিস কেনার পর, যা দাম আসলো তাতে ব্যাগে হাত দিতেই ভয় করছিলো। আমি শিউর জানি ব্যাগে অতো টাকা নেই। কিন্তু, টাকা বের করতে গিয়েই দেখি আর একটা একশো টাকার নোট! আমি খুশিতে তখন সাথে সাথে উপরের দিকে তাকালাম। আমি জানি তখন তিনি খুব হাসতেছেন। চোখ ভিজে উঠলো আমার। রিক্সা করে বাসায় চলে আসলাম। আজকের এ একশো টাকার নোটটিকে এতো ভালো আর কোনোদিন লাগেনি।

জুলফিকারের ডায়েবেটিস এর কারনে পায়ে বেশ যন্ত্রনা হয়। ঘুমানোর আগে একটু ম্যাসেজ করে দিলে সে ঘুমাতে পারে। কিন্তু মাঝে মাঝে ঘুমের মধ্যে ওর পায়ে ব্যাথার কারনে ঘুম ভেঙ্গে যায়।
আমি খুব ভোরে উঠে রিয়ানের পড়া রেডি করে ওকে ডেকে টেবিলে বসি। ওর রুমের দরজা চাপায়ে দেই। ও ঘুমালে অবশ্য আমি এ কাজটা সব সময় করি।
ও সেদিন ঘুম থেকে উঠে বলছে,'সকালে খুব পা যন্ত্রণা করতেছিলো। তুমি সুন্দর করে পায়ে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলা।" আমি বললাম,"নাতো! আমি তো ভোর থেকেই টেবিলে।"আমি দুষ্টমি করে বললাম,"তোমার মেয়ে এসেই হয়তো তোমার পায়ে হাত বুলিয়ে দিছে।" জুলফিকারের চোখ ছলছল করে উঠলো। ও বলল, "সত্যি বিশ্বাস করো এমনটা হয়েছে। পিছন দিকটা শুধু দেখেছি স্পষ্ট।"
আমি নাকি এ পর্যন্ত কখনোই এতো সুন্দর করে পায়ে হাত বুলিয়ে দেইনি।
সেই থেকে সত্যি ওর পায়ে কম যন্ত্রনা একটু।
আমি মাঝে মাঝে একরকম সুগন্ধ টের পাই আমার বেডরুমে। হুম, আগে সুপারি ফুলের এক রকম ঘ্রাণ আসতো। কিন্তু তা তো বর্ষাকালে। এখন তো সুপারি ফুল নেই।
এ সুগন্ধের রহস্য আমার অজানা।

মাঝখানে একটা বড় বিপদ থেকে বেঁচে গেছি। অকারণ এ বিপদে আমার সারাজীবনের সঞ্চিত মানসন্মান ধুলোয় মিশে যেতে বসে ছিলো। আমার দুই সন্তানের পড়াশুনা, ক্যারিয়ার, জীবন সব ধ্বংস হয়ে যেতো। কিন্তু এবারও বেঁচে গেলাম এক সৃষ্টিকর্তার রহমতে ফেরেশতা নামক একজন মানুষের জন্য। আমি তাকে আজীবন শ্রদ্ধায় রেখে দিব। তিনি নিজেও জানেন না তাকে আমি কতোটা শ্রদ্ধা করি।
মানুষের কিছু বিপদ আসে নিজের কর্মদোষে। সে বিপদকে বলে ডেকে আনা বিপদ। কিন্তু আমার এ বিপদটা ছিলো কারো হিংসার বশবর্তী হয়ে আমাকে বিপদে ফেলা।
আমি এ জানোয়ার রূপি মানুষটাকে আজীবন ঘৃণায় মনে রাখব।

আমার লাইব্রেরী রুমটার পাশে একটা বারান্দা আছে। তার পাশে একটা বাগান। গাছের ফাঁক দিয়ে এক জোড়া কবর দেখা যায়। 'কবর' বেঁচে থাকা মানুষের জন্য এক বিস্ময়। অনেক রাতে এ রুমটায় অন্যরকম এক নিরবতা নামে। অনেক দূরের শব্দও মনে হয় আমি শুনতে পাই। উপর তলার বাচ্চাটা রাতে কখন কখন ওঠে আমার মুখস্ত হয়ে গেছে। বই এর পাতায় দাগাতে থাকি অকারণ।
ভোর হয়, আমার চোখের পাতা ভারী হয়।

,,,রিতু,,, কুড়িগ্রাম।

0 Shares

১৯টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ