বিধবাপল্লীর বোবা কান্না

আরাফ কাশেমী ১১ এপ্রিল ২০১৫, শনিবার, ০৬:৫৫:৩৭পূর্বাহ্ন মুক্তিযুদ্ধ ১২ মন্তব্য

আজো আমি বাতাসে লাশের গন্ধ পাই
আজো আমি মাটিতে মৃত্যূর নগ্ননৃত্য দেখি,
ধর্ষিতার কাতর চিৎকার শুনি আজো আমি তন্দ্রার ভেতরে…
এ দেশ কি ভুলে গেছে সেই দু:স্বপ্নের রাত, সেই রক্তাক্ত সময় ?
বাতাসে লাশের গন্ধ ভাসে
মাটিতে লেগে আছে রক্তের দাগ।

 

 শেরপুর জেলা থেকে ৩৬ কিঃ মিঃ দূরে নালিতাবাড়ী উপজেলার সীমান্তবর্তী ইউনিয়ন কাকরকান্দি,গারো পাহাড়ের কোল ঘেঁষে নিভৃত এক গ্রাম নাম সোহাগপুর।গল্পের কোন গ্রাম এর কথা শুনলে চোখের সামনে যেমনটি ভেসে উঠে বাস্তবে ঠিক তেমনি একটি গ্রাম ছিলো সোহাগপুর।

 

শ্রাবনের ১০ তারিখ(২৫জুলাই,১৯৭১)গ্রামের মানুষ যখন ক্ষেতে খামারে গিয়ে কাজ শুরু করার প্রস্তুতি নিচ্ছে।হাসেন বানু স্বামী আব্দুল লতিফ হাল চাষের জন্য ক্ষেতে পাঠিয়ে রান্নাঘরে বসলেন ১৭ বছরের বানু ,ঘরে তার বৃদ্ধ শুশুর-শাশুড়ি।পাশের বাড়ির খেজুর আলী বাড়িতে ঘুমাচ্ছিলেন সেদিন,খেজুর আলীর স্ত্রী জরিতন বেওয়া কোলে বুকের মানিক হাশেম কে নিয়ে উঠানে রোদ পোহাচ্ছে,পাশের বসে আছে জরিতনের দেওড়।

 

এমন সময় গ্রামে পা দিলো পাকিস্তানী আর্মি সাথে আলবদরের বড় নেতা কামারুজ্জামান, কাদির ডাক্তার, বগাবুড়া ছাড়া গ্রামের কিছু কীট পাকবাহিনীর সঙ্গে ছিল।গ্রামটি প্রত্যন্ত অঞ্চলে অজপাড়াগাঁ। রাস্তাঘাট ছিল না,মাটির রাস্তা। পাকসেনাদের আগমনের খবর পেলে রাস্তা কেটে রাখা যেত।সেনা চলাচল হতো দুঃসাধ্য। কিন্তু গাঁয়ের কেউ জানতে পারেনি। কাকপক্ষীও না। চার-পাঁচজন রাজাকারের কীর্তি। তারাই সাধের পাকিস্তান রক্ষা করার জন্য পাকসেনা ডেকে এনেছে।এরপর এরপর কি?

 

সবাই যার যার কাজে ব্যস্ত ছিলো।কৃষকরা কেউ ক্ষেত নিড়ানি দিচ্ছেন,কেউ পরিচর্যা করছেন,কেউ বা শাকসবজি তুলছেন।কেউ মেঠো পথ বেয়ে বা আইল ধরে হেঁটে যাচ্ছেন এমনি সময় বর্বর পাকসেনাদের আক্রমণ।পাখি শিকারের মতো। মানুষ দেখলেই গুলি। বিশেষ করে পুরুষ মানুষ। যে যেখানে যেভাবে ছিল, তাকে সেখানে সেভাবেই গুলি করে হত্যা করা হল।ধান নিড়াতে থাকলে ধানক্ষেতেই মৃতদেহ লুটিয়ে পড়ল। নামাজ পড়তে থাকলে নামাজরত অবস্থায় শহীদ।বিশ্রাম নিতে থাকলে গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে চিরবিশ্রাম। হাঁটতে থাকলে পথিমধ্যেই অনন্তশয়ন। ঘরের মধ্যে উঁকি মারছে মুসলিম লীগের লোকেরা অর্থাৎ রাজাকাররা পুরুষ মানুষ দেখলেই হাতের ইশারায় শেষ। একটি চিৎকার রক্তের প্রস্রবণ আর লাশের মিছিল।

 

 

হাসেন বানু বুঝতে পারলেন রান্নাঘর থেকে উঠে কোনমতে বৃদ্ধ শুশুর-শাশুরি কে নিয়ে বাড়ির পশ্চিম দিকে পালিয়ে গেলো।এর পর বিকেল যখন বাড়িতে ফিরে এলো তখন উঠানে ক্ষেত থেকে দৌড়ে পালিয়ে বাড়িতে আসা স্বামীর লাশ পড়ে তার সঙ্গে আরও দুই জনের লাশ পড়ে ছিল।স্বামীর লাশের কাছে গিয়ে দেখি নাভির দিকে গুলি ঢুকে পিঠ দিয়ে বেরিয়ে গেছে।বাড়িতে থাকা চাচাত ভাইদের লাশ।ঐখানে আরও যাদের লাশ পড়ে ছিল তাদের মধ্যে একজন তার ভাতিজা আনসার আলীর লাশ ছিল। আরেকটি ছিল জহুরুল হকের। পরবর্তীতে সন্ধ্যার দিকে লাশগুলো মাটিচাপা দেয়া হয়।

 

 

কিছু বুঝে উঠার আগেই খেজুর আলীর বাড়িতে চলে এলো আলবদরের নেতা কামারুজ্জামান ও তার ছানারা।ঘরের পথ আগলে দাঁড়ালো জরিতন বেওয়া কোলে বুকের মানিক হাশেম কে নিয়ে।শেষরক্ষা হলো না স্বামীরে ঘর টেনে উঠানে ফেলে প্রথমে ৬ডা গুলি করে।গুলি খাওয়ার পর পানি চাইলে আরেকটা গুলি করে।ওই গুলিতে উডানেই তার জীবন যায়।পরে বুকের সোনা মানিক বুকের ধন হাশেমরে ধরে নিয়া বাপের লাশের উপরে ফেলে গুলি করে।এরপর চোখের সামনে জরিতন বেওয়ার দেওর কে ধরে নিয়ে বন্দুকের নল দিইয়ে খোঁচাতে খোঁচাতে পরে মুখের ভিতরে গুলি করে।

 

 

তিনজন আর্মি এবং আলবদর একটি মেয়েকে ধাওয়া করে হাফিজা বেগমের ঘরের ভেতরে ঢোকায় এবং একজন পাক সেনা ঐ মেয়েটার ইজ্জত নষ্ট করে।বাকি দু’জন ঘরের দুয়ারে দাঁড়িয়ে বন্দুক দেখায় ১ মাস আগে স্বামীর ঘরে আসা হাফিজা কে।ঘরের ভেতর দাঁড়িয়ে ছিলো হাফিজা এর পর পাকবাহিনী বন্দুক দিয়ে আঘাত করে মাটিতে ফেলে দিয়ে হাফিজা বেওয়ার ইজ্জত নষ্ট করে অজরধারায় কাঁদেছিলেন হাফিজা কিন্তু মুক্তি পায়নি সেদিন সেদিন করফুলী বেওয়া,সমলা বেওয়াসহ অনেক মহিলার ইজ্জত নষ্ট করেছিল তারা।৭টা থেকে দুপুর পর্যন্ত ৬ ঘন্টা তান্ডবের পর হায়েনার দল সোহাগপুর ত্যাগ করে চলে যায়। নিস্তব্ধতা ভেঙে ঘটনাস্থলে ছুটে আসে লোকজন।আলবদরদের ৬ ঘন্টার তান্ডবে ওই গ্রামের ১৮৭ জন পুরুষ শহীদ হন।

 

 

এরপর সব শেষ। এমনি করে সোহাগপুর গ্রামের সব গৃহকর্তাকে হত্যা করা হল,সোহাগপুর গ্রামে সোহাগিনীদের বাঁচিয়ে রাখা হল,তাদের সোহাগ করার মতো কেউ বেঁচে রইল না। তাই বুঝি সোহাগপুর নামটিই অচল হয়ে পড়ল। বেঁচে থাকা সবাই বিধবা। সোহাগপুর গ্রামের সবাই বিধবা স্বামীহারা,সোহাগবঞ্চিত।গ্রামটিকে তখন থেকে সবাই ‘বিধবা পল্লী’ নামে চেনে কিংবা বিধবা পল্লী নামেই ডাকে।

 

 

স্বজনের লাশ সেদিন কলাপাতা,ঘরের বিছানা দিয়ে এক কবরে ৩ জন এক কবরে ৪ জন করে মাটি দিতে হয়েছিলো সেই স্মৃতি তারা এখনো ভুলতে পারেনি আজো তাইতো আজকের এত বছর পরের  খুশির সময় মরুময় ধরত্রীর বঙ্গীয় অঞ্চলে হয়তোবা বঙ্গমাতার কষ্ট দেখেই কাঁদে মেঘমালার দল, নাকি এ তাঁদের আনন্দ অশ্রু তা বোঝা যাচ্ছেনা।

 

0 Shares

১২টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ