জননীর জীবনের গল্পটা

আরাফ কাশেমী ৩ মে ২০১৫, রবিবার, ০৩:১৫:৪৫পূর্বাহ্ন বিবিধ ৬ মন্তব্য

এ এমন জননীর গল্প যিনি খলীল জিবরানের প্রফেট থেকে লাইন আউড়ে মনকে শক্ত করেছেন,পুরো পরিবার যেন নীলকণ্ঠ।পুরাণে এক দেবতা বিষ নিজের গলায় ধারণ করে বাঁচিয়েছিল বিশ্ব,নিজে হয়েছিল নীলকণ্ঠ।এই পরিবার ,এই গল্প,এই পিতা পুত্র জননীরাও যেন তাই।আমরা দুর্ভাগ্যবান তাদের নষ্ট বীজ আজো বিষবৃক্ষ ছড়িয়ে দিচ্ছে শ্যামল বাঙলায়,যার জন্য গল্পের জননীকে,আমাদের জননীকে পেতে হয় রাষ্ট্রদ্রোহীর অভিধান। এরচেয়ে বড় জঘণ্য অনাচার পৃথিবীতে আর কি হতে পারে?

11209722_1596704763911596_8277491779850250492_n

চল্লিশের দশকে পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার সুন্দরপুর গ্রামে একটি রক্ষণশীল বাঙালি মুসলমান পরিবারে সৈয়দা হামিদা বেগম আর তার ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট স্বামী সৈয়দ আবদুল আলীর ঘর আলো করে ১৯২৯ সালের ৩ মে জন্ম নিলো এক ফুটফুটে কন্যা সন্তান।মেয়ের ডাক নাম বাবা-মা আদর করে রাখলেন জুড়ু পুরো নাম জাহানারা বেগম। পরে জুড়ু কে জাহান ও নামে ডাকা হতো।সাত ভাই-বোনদের মাঝে জাহান ছিলো সবার বড়।

জাহান যখন কিশোরী,তখন খুব পর্দা মানতে হতো মেয়েদের। কোথাও যেতে হলে বাহন ছিল গরুর গাড়ি। বিশাল পরিবার ছিলো তাঁদের। একান্নবর্তি না হলেও,শব-ই-বরাত থেকে রোজা-ঈদ-টানা তিন চার মাস গ্রামে দাদার বাড়িতে গিয়ে থাকতে হতো সবাইকে।দশ থেকে বারো বছর বয়স পর্যন্ত জাহানারার কেটেছে কুড়িগ্রামে। কুড়িগ্রামে থাকাকালীন জাহানারা ফ্রক পরে রীতিমতো সাইকেল চালিয়ে হুল্লোড়ে মেতে থাকতেন। জাহানারার বয়স বারো পেরোতেই সাইকেল চালানো বন্ধ হয়ে গেলো।নিষিদ্ধ হয়ে গেলো বাড়ির বাইরে পা ফেলা।বাবার বদলির চাকরির সুবাদে জায়গা বদল করতে হয়েছে বহুবার- কখনো সেতাবগঞ্জ, কখনো ঠাকুরগাঁ,কখনো খেপুপাড়া।

 

বয়ঃসন্ধিকালে জাহানারার প্রধান আশ্রয় ছিলো বই।ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেট বাবার কল্যাণে বাড়িতে নিয়মিত আসতো পত্রপত্রিকা। জাহানারার পাঠতৃষ্ণাকে উসকে দিয়েছিল দৈনিক আনন্দবাজার, অমৃতবাজার, আজাদ, ষ্টেটসম্যান, সাপ্তাহিক শনিবারের চিঠি, ইলাষ্ট্রেটেড উইকলি অব ইন্ডিয়া, মাসিক ভারতবর্ষ, প্রবাসী, বসুমতি আর মোহাম্মদী। বাড়িতে কলের গান ছিলো। আর ছিলো হারমোনিয়াম। সপ্তাহে দু’দিন গানের মাস্টার এসে গান শিখিয়ে যেতেন। জাহানারার সকাল দুপুর সন্ধ্যা ছিলো মাস্টার দিয়ে ঠাঁসা। একজন মাসলা-মাসায়েল শরা শরীয়তে হেদায়েত করেন তো আরেকজন আসেন উর্দু পড়াতে। পাঠ্য বইয়ের মাস্টার তো আছেনই। জাহানারার জীবনে বিনোদন বলতে শুধু কলের গান। তাঁর বাবা হিজ মাস্টারস ভয়েস-এর একটা গ্রামোফোন ও রেকর্ড কিনে আনবার পর আঙ্গুরবালা, ইন্দুবালা, হরিমতী, কৃষ্ণচন্দ্র দে, কমলা ঝরিয়া, আব্বাসউদ্দিন আহমদ, কনক দাস, শাহানা দেবী, যুথিকা রায়ের গান হয়ে উঠলো বিনোদনের সঙ্গী

গ্রামের দুরন্ত কিশোরী জাহানারাকে মটকা চাচা (বাবার বন্ধু) বেছে বেছে এমন সব বই উপহার দিতেন যেগুলো তাঁর মেধা ও মননের জগৎকে আলোকিত করেছে। দৃষ্টিকে করেছে দিগন্তবিস্তৃত ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম,নারী শিক্ষা আন্দোলন,মুসলিম সমাজের জাগরণের প্রচেষ্টা,বেগম রোকেয়ার সাধনা- এসব বিষয়ের ওপর রচিত বইগুলো মটকা চাচাই নিয়ে আসতেন জাহানারার জন্যে।

বাংলা সাহিত্য এবং বিশ্বসাহিত্যের সঙ্গে জাহানারার পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন একজন গৃহশিক্ষক। জাহানারা তখন ক্লাস সেভেনের ছাত্রী। গৃহশিক্ষকের দায়িত্ব ছিলো ইংরেজী, বাংলা, অঙ্ক, ভূগোল আর ইতিহাস পড়ানোর। এই মাস্টারমশাই ছিলেন সাহিত্যপাগল। এই মাস্টারমশাই-এর কল্যাণেই,ওই বয়সেই টলস্টয়, ডস্টয়েভস্কি, ভিকটর হুগো, সেলমা লেগারলফ, শেক্সপীয়র, বার্নাড শ, ন্যুট হামসুন-এর অনেক বইয়ের বাংলা অনুবাদ জাহানারার পড়া হয়ে গিয়েছিলো।

রবীন্দ্রনাথ এবং শান্তিনিকেতন বিষয়েও জাহানারাকে প্রবলভাবে আগ্রহী করে তুলেছিলেন মাস্টারমশাই। জাহানারার স্বপ্ন ছিলো- বড় হয়ে শান্তিনিকেতনে পড়তে যাবে। কিন্তু সে স্বপ্ন তাঁর সফল হয়নি। মটকা চাচা বাবাকে বলে কয়ে রাজিও করিয়ে ফেলেছিলেন এমনকি ডাকযোগে শান্তিনিকেতনে ভর্তির প্রসপেকটাসও এসে পড়েছিলো। কিন্তু ১৯৪১ সালের ৯ আগস্ট পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যুর খবর পড়ে জাহানারার শান্তিনিকেতন যাবার স্বপ্নেরও মৃত্যু ঘটলো।

220px-Jahanara_Imam_1957

পড়াশুনা করতে জাহানারার ভালো লাগতো না। ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত পড়তেই তিনি অস্থির- আর পড়বেন না এরকম একটা সিদ্ধান্ত যখন প্রায় পাকা,তখনই মটকা চাচার কাছে পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরুর উচ্চশিক্ষিতা,সভা- সমিতিতে বক্তৃতা দিতে পটু এবং সাহেব-সুবোদের সঙ্গে কথাবার্তায় চৌকস বোন বিজয়লক্ষ্মী পণ্ডিতের ছবি দেখে মুগ্ধ জাহানারা সিদ্ধান্ত পাল্টালেন-’আমিও বিজয়লক্ষ্মী পণ্ডিতের মতো লেখাপড়া শিখব।’ -এভাবেই একজন বিজয়লক্ষ্মী পণ্ডিত গাঁয়ের দুরন্ত কিশোরী জাহানারা বেগম ওরফে জুড়ুর জীবনে প্রেরণার উৎস হয়ে তাঁর চিন্তায় মননে ও মেধায় জ্বেলে দিয়েছেন আলোর প্রদীপ।কিন্তু ষষ্ঠ শ্রেণীর দরজা উতরে গেলেন। তারপর স্কুলে যাওয়া বন্ধ। কারণ, তখন কুড়িগ্রামে মেয়েদের স্কুল ছিল না তাই ছেলেদের স্কুলে সপ্তম শ্রেণীতে জাহানের নাম থাকবে। সময়মতো তিনি পরীক্ষাও দেবেন কিন্তু ক্লাস করতে হবে না। বাড়িতে অবশ্য শিক্ষক নিয়োগ করা হলো দু’জন শিক্ষক।তাঁরা দু’বেলা এসে জাহানারাকে পড়িয়ে যান।১৯৪১ সালে কুড়িগ্রাম থেকে বদলি হয়ে তাঁরা চলে এলেন লালমনিরহাটে। লালমনিরহাটে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেবার সেন্টার ছিলো না। জাহানারা ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিলেন রংপুর থেকে। দ্বিতীয় বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করলেন জাহানারা ১৯৪২ সালে। ম্যাট্রিক পাস করে জাহানারা ভর্তি হলেন রংপুর কারমাইকেল কলেজে।

কলেজে পড়ার সময় পরিচয় হয় রংপুরের মুন্সিপাড়ার মোহাম্মদ আলী উকিলের কনিষ্ঠ ছেলে শরীফ এর সাথে। এই শরীফের সঙ্গে জাহান-এর একসময় হৃদয় বিনিময় হয়ে যায়। সেকালে দুজন তরুণ-তরুণীর প্রেম ভালোবাসা ব্যাপারটি এখনকার মতো এতোটা সহজ স্বাভাবিকভাবে দেখা হতো না। বিষয়টি উভয় পরিবারে আলাপ আলোচনার পর শরীফ-জাহানারার প্রেম অবশেষে পারিবারিক স্বীকৃতি পেলো। শরীফুল আলম ইমাম আহমদের সঙ্গে জাহানারা বেগমের বিয়ে সম্পন্ন হলো ১৯৪৮ সালের ৯ আগস্ট প্রচলিত রীতির বাহিরে গিয়র সাদা গাঊন আর বেলী ফুলের মালা গলায় পড়ে বিয়ের পীড়িতে বসেছিলেন জাহানার বেগম আর তার পর থেকে হয়ে গেলেন জাহানারা ইমাম।শরীফ ইমাম ছিলেন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার।

igal_With-husband-1948

নিপুণ ম্যাগাজিনের ১৫ বর্ষ পঞ্চম সংখ্যার প্রকাশিত শরীফ ইমামের ওপর স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে জাহানারা ইমাম বলেছিলেন,

“দেখা হয়েছিল সেই কিশোর বেলা। লালগোলাপের পাঁপড়িতে লিখে পাঠিয়েছিল,‘আমি তোমায় ভালোবাসাসি’। তুমিও কি। হ্যাঁ আমিও।

সেই কবেকার,চার দশকেরও ওই প্রান্তের ১৯৪৩ সালের কথা। দুজনেই তখন রংপুর কারমাইকেল কলেজে ইন্টারমিডিয়েট প্রথম বর্ষে পড়ি।পড়ার সুবাদে মুখচেনা ছিল। প্রথম সামনাসামনি দেখি কলেজের বার্ষিক ক্রীড়ানুষ্ঠানে।সেই প্রথম ভালো করে দেখা। তারপর সেও দেখেছে আমায়। স্মৃতির ছবিরা সার বেঁধে চোখের সামনে ভেসে ভেসে চলে আসছে। ধুতি,শার্ট পরা শরীফ সাইকেল চেপে কলেজে যাচ্ছে, আমাদের ঘোড়ায় গাড়ি তাকে পার হয়ে চলে গেল।কলেজের বার্ষিক নাট্যনুষ্ঠানে একলব্য অভিনীত হচ্ছে—তাতে গুরু দ্রোনাচার্য সেজেছে শরীফ।সে যা লাজুক, মুখচোরা ছেলে,তাতে প্রবল প্রতাপান্বিত, রাগী দ্রোনাচার্যের অভিনয়টাও ওই রকমই হয়েছ পরবর্তী সময় রক্ত গোলাপের পাঁপড়ি। সোনালী ফ্রেমের চশমার ভেতর দিয়ে দুচোখের মুগ্ধতা,তারপর প্রায় তিন দশক ধরে সে মুগ্ধতার আর শেষ ছিল না।

জাহানারা ইমামের কর্মজীবন শুরু হয় শিক্ষকতার মাধ্যমে। সহকারী শিক্ষিকা হিসেবে ১৯৪৮-১৯৪৯ পর্যন্ত তিনি ময়মনসিংহ- এর বিদ্যাময়ী গার্লস হাই স্কুলে কর্মরত ছিলেন।১৯৫১ সালের ২৯ মার্চ জাহানারা ইমামের কোল জুড়ে আসে শাফী ইমাম রুমী।বিয়ের পর ঢাকায় এসে ১৯৫২ সালে সিদ্ধেশ্বরী গার্লস স্কুলে সরাসরি প্রধান শিক্ষিকা হিসেবে যোগদান করেন এবং ১৯৬০ সাল পর্যন্ত তিনি এ পদে আসীন ছিলেন।জাহানারা ইমামের জীবিত একমাত্র সন্তান সাইফ ইমাম জামীর জন্ম ১৯৫৪ সালের ২ সেপ্টেম্বর।

images

ছোট বেলায় পড়ালেখা করতে না চাওয়া জাহানার বিয়ের পড়ে ২ সন্তান নিয়ে ও পরবর্তীতে ১৯৬০ সালে বি.এড. ডিগ্রি অর্জন করেন টিচার্স ট্রেনিং কলেজ থেকে প্রথম শ্রেণীতে। ১৯৬৪ সালে ফুলব্রাইট স্কলারশীপ পেয়ে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার সানডিয়াগো স্টেট কলেজ থেকে সার্টিফিকেট ইন এডুকেশন ডিগ্রি অর্জন করেন। যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফিরে ১৯৬৫ সালে বাংলায় এম.এ. পাস করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। পাশাপাশি জাহানারা ইমাম ‘গার্লস গাইড’, ‘পাকিস্তান উইমেন্স ন্যাশনাল গার্ড’, ‘খেলাধুলা’, ‘অল পাকিস্তান উইমেন্স এসোসিয়েশন’ এবং বিভিন্ন সমাজকল্যাণমূলক কাজের সাথে জড়িত ছিলেন। তিনি ঢাকা বেতারে উপস্থাপিকা হিসেবে অনেক দিন অনুষ্ঠান পরিচালনা করেছেন। জাহানারা ইমাম বাংলাদেশ টেলিভিশনে অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করেছেন। তিনি ‘ব্রিটিশ কাউন্সিল লাইব্রেরি মঞ্চে’ শেক্সপিয়ারের একটি নাটকে অভিনয়ও করেছিলেন।
.
.
৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধে তাঁর বড় ছেলে রুমীই একজন দুঃসাহসী গেরিলার ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে অমানুষিক নির্যাতন ভোগ করে শাহাদৎ বরণ করেন। স্বাধীনতার পর শহীদ রুমী বীরবিক্রম (মরণোত্তর)উপাধিতে ভূষিত হন।একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ কেড়ে নিলো তাঁর বুকের মানিক রুমীকে প্রিয়তম স্বামী শরীফকে। পুত্র এবং স্বামী হারানোর কষ্টকে বুকে ধারণ করে বেঁচে ছিলেন তিনি। প্রাণপ্রিয় সন্তান রুমীকে ঘিরেই জাহানারা ইমাম রচনা করেন অমর গ্রন্থ ‘একাত্তরের দিনগুলি।

11174836_10152912493308655_5367662792801367274_n

১৯৮২ সালে তিনি আক্রান্ত হলেন দুরারোগ্য ব্যাধি ওরাল ক্যান্সারে। প্রতি বছর একবার যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে চিকিৎসা নিতে হতো তাঁকে। এভাবেই যাচ্ছিলো তাঁর দিন। মুখের ক্যান্সার কেড়ে নিয়েছিলো অপরূপ লাবণ্যময়ী এই নারীর মুখশ্রীর অনিন্দ্য সৌন্দর্য।মরণব্যাধি ক্যান্সারের সংগে লড়াই করতে করতে অন্য আরেকটি লড়াইয়ের জন্যে মনে মনে প্রস্তুত হচ্ছিলেন জাহানারা ইমাম।

বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের লোভ এবং অদূরদর্শিতার কারণে স্বাধীনতাবিরোধী চক্র একাত্তরের ঘাতক দালাল রাজাকার আলবদরদের ক্রমশঃ উত্থান তাঁকে বিচলিত করে তুলেছিলো। ধর্মান্ধ মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী- মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির এই উত্থানকে রুখে দিতে মাথা উঁচু করে দাঁড়ালেন জাহানারা ইমাম, আশ্চর্য সাংগঠনিক দক্ষতায়। মাতৃত্ব থেকে অবলীলায় তিনি চলে এলেন নেতৃত্বে।

জাহানারা ইমামের রাজনৈতিক জীবনের কথা বলতে গেলে প্রথমেই বলতে হয় অঞ্জলি নামের একটি মেয়ের কথা। কলেজে জাহানারা ইমামের সহপাঠী অঞ্জলি। এই অঞ্জলির মাধ্যমেই কমিউনিজমের পাঠ নেন জাহানারা ইমাম। অঞ্জলি তাঁকে এ সংক্রান্ত বইপত্র পড়তে দিতো। ডেপুটি ম্যাজিষ্ট্রেট যথেষ্ট উদার হলেও কমিউনিস্টদের পত্রিকা ‘জনযুদ্ধ’ দেখে ক্ষিপ্ত হয়ে ভর্ৎসনা করেছিলেন। মেয়ে রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকুক এটা তাঁর বাবা চাননি। শরীফও চাননি। তাই জাহানারা রাজনীতির পথ ত্যাগ করেন।

479860_10152614423100360_918157682_n1

১৯৯২ সালের ১৯ জানুয়ারী ১০১ সদস্যবিশিষ্ট ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মুল কমিটি’ গঠিত হয় জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে। এর পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী প্রতিরোধ মঞ্চ, ১৪টি ছাত্র সংগঠন, প্রধান প্রধান রাজনৈতিক জোট, শ্রমিক-কৃষক-নারী এবং সাংস্কৃতিক জোটসহ ৭০টি সংগঠনের সমন্বয়ে পরবর্তীতে ১১ ফেব্রুয়ারি ১৯৯২ ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটি’ গঠিত হয়। সর্বসম্মতিক্রমে এর আহ্বায়ক নির্বাচিত হন জাহানারা ইমাম। দেশের লাখ লাখ মানুষ শামিল হয় নতুন এই প্লাটফর্মে।যার ধারাবাহিকতা আজ ও চলছে।

জাহানারা ইমাম দীর্ঘদিন ক্যান্সারের সঙ্গে লড়েন। ধীরে ধীরে শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটলে ২ এপ্রিল ১৯৯৪ সালে চিকিৎসার জন্যে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্যে ঢাকা ত্যাগ করেন জাহানারা ইমাম। ২২ এপ্রিল চিকিৎসকরা জানান, চিকিৎসার আওতার সম্পূর্ণ বাইরে চলে গেছেন তিনি। তার মুখগহ্বর থেকে ক্যান্সারের বিপজ্জনক দানাগুলো অপসারণ করা সম্ভব নয়। বাকশক্তি হারিয়ে কথা বলা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল তার।এ সময় ছোট ছোট চিরকুট লিখে প্রিয়জনদের সঙ্গে প্রয়োজনীয় কথাবার্তা চালিয়ে যেতেন।সব কাজের অবসান ঘটিয়ে অসংখ্য গুনগ্রাহী রেখে মিশিগানের ডেট্রয়েট নগরীর সাইনাই হাসপাতালে ১৯৯৪ সালের ২৬ জুন মৃত্যুবরণ করেন এই মহীয়সী নারী।

মানুষ এক সময় পরিচিত হয় বাবার পরিচয়ে,তারপর নিজের পরিচয়ে, সবশেষে পরিচিত হয় সন্তানের পরিচয়ে। জাহানারা ইমাম এমনই একজন মানুষ যিনি সব পরিচয়ে পরিচিত।তার সব চেয়ে বড় পরিচয় তিনি শহীদ জননী।দেশ বিজয় লাভের পর রুমীর বন্ধুরা জাহানারা ইমামকে সকল মুক্তিযোদ্ধার মা হিসেবে বরণ করে নেন এবং ‘শহীদ জননী’ উপাধি দেন সেই থেকেই আমরা শহীদ জননীকে আম্মা ডাকি।

 

তথ্যসূত্র-
১. শহীদ জননী জাহানারা ইমাম স্মারকগ্রন্থ, লুৎফর রহমান রিটন, অবসর প্রকাশনা সংস্থা, ১৯৯৫ সাল।

0 Shares

৬টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ