বলতে মানা

রোকসানা খন্দকার রুকু ২ এপ্রিল ২০২৩, রবিবার, ০৩:০৪:২৩পূর্বাহ্ন সমসাময়িক ৫ মন্তব্য

বলতে মানা,,,,

ভাড়া বাসা থেকে মুল রাস্তা পায়ে হেঁটে আসতে ৫ মিনিট মতো লাগে। কোন কোনদিন দেরীতে বের হলে রিকশায় উঠলেই ১০ টাকা ভাড়া গুনতে হয়। এখন নাকি ৫ টাকার কোন মূল্য নেই, রিকশাঅলা পারলে টাকা ছুঁড়ে মারে। ১০ টাকা বাঁচাতে মবিনুর রহমান মেয়েকে নিয়ে দ্রুত রাস্তায় হেঁটে এলেন।

মোড়ে বেশ কয়েকটা রিকশা দাঁড়িয়ে। কিন্তু তিনি চলতি অটোতে উঠবেন। অটোতে মেয়েসহ অর্ধেক ভাড়ায় যাওয়া যাবে।

মবিনুর রহমান রিকশায় উঠেন না পরিচিত সব রিকশাঅলাই জানে। অবশ্য মবিনুর রহমানকে নিয়ে তাদের মাথা ব্যাথা নেই। তারা অপেক্ষা করছে উকিলদের। আশেপাশে অনেক উকিল বসবাস করেন। তারা উঠলে, তিনগুণ ভাড়া দিয়ে দেয়।
এমন একজন নামকরা উকিল আফতাব সাহেব পেছন থেকে এসে ধপ করে রিকশায় উঠে চলে গেলেন। কালো জ্যাকেটের পকেটে এখন হয়তো শুধু রিকশা ভাড়া কিন্তু বিকেলে পকেট ভর্তি হয়ে আসবে।
মবিনুর রহমান তখনও দাঁড়িয়ে। মেয়ে বিরক্ত হয়ে বাবার দিকে তাকিয়ে আছে। সে তো আর বাবার আর্থিক টানাটানি বোঝে না।

এসময় এক অপরিচিত রিকশাওয়ালা জানতে চাইলো -  স্যার যাবেন?
মবিনুর রহমান কিছু বলার আগেই পাশ থেকে অন্যরিকশাঅলা কটাক্ষ করে বললো - উনি অটোতে উঠেন, রিকশা উঠেন না।

মবিনুর রহমান অস্বস্তিবোধ করলেন দুটো কারনে। এক, প্রায়ই তাকে  এমন কথা শুনতে হয়। অভ্যাস হলেও মেয়ের সামনে শুনতে খারাপ লাগে। আর ' স্যার ' শব্দটা তার ক্ষেত্রে মনে হলো বেমানান। একজন মধ্যম গ্রেডের চাকরিজীবি তিনি। তাকে স্যার বলার দরকার কি?
মবিনুর রহমান ৩০ হাজারের সামান্য উপরে বেতন পান। উপরি কোন ইনকাম নেই। মাসে বাসাভাড়া, বিদ্যুৎ বিল, পানির বিল যায় ১০ হাজার টাকা। বড় ছেলে গতবার ভার্সিটিতে গেছে। তাকে মাসে ১০ হাজার টাকা দিতে হয়। আর বাকিটা দিয়ে পুরো মাসের চাল,ডাল,তেল, মাছ- মাংস, মেয়ের স্কুলের খরচ। কোন মাসে গ্রাম থেকে আত্নীয় এলে ধার করা ছাড়া উপায় থাকে না।

রিকশাঅলা এই হিসাব বোঝে না বলেই কটাক্ষ করে। সে জানে সরকার চাকুরীজীবিদের অনেক বেতন বাড়িয়েছে গরীবদের ঠকিয়ে। দেশের টাকা সব এমন চাকরীজীবি লোকদের দিতেই শেষ হয়ে যায় অথচ এসব লোকজন  রিকশাভাড়া দেবার সময় নানা অজুহাত দেখায়। এসব লোক হলো অভ্যাসী, ঘোর কৃপণ!

কটাক্ষকারী রিকশাওয়ালাও মবিনুর রহমানের মতোই ইনকাম করে। দৈনিক ৭০০/৮০০ টাকা করে হলে মাসে ২০-২৫ হাজার। এরপর তার বাসা ভাড়া অনেক কম কিংবা হয়তো দিতেই হয় না। ছেলেমেয়ে বড়জোর হাইস্কুল পর্যন্ত যায় কিংবা পড়াশুনা করে না। বরং পারলে তারা অল্প বয়সে কাজকর্ম করে ইনকাম শুরু করে। বউও অন্যের বাড়িতে কাজ করে, সেখান থেকে বেতন, খাবার সব পায়। বাড়িতে বয়সী মা- বাবা থাকলে সেও বৃদ্ধ ভাতা পায়।

রিকশাঅলার টিসিবি কার্ড আছে সেখান থেকে সে কমদামে তেল, চিনি, ডাল পায়। লাইনে দাঁড়িয়ে টিসিবির আটা পায়। মেম্বার রেশন কার্ড দিয়েছে সেখান থেকে চাল পায়। বাড়তি শুধু কিনতে হয় লবন, মরিচ, হলুদ, পেয়াজ। এগুলোর দাম বাজারে মোটামুটি সহনশীল। রিকশাওয়ালার ডায়াবেটিস বা অন্য জটিল কোন অসুখ নেই তাই ওষুধের কোন বিলও দিতে হয় না। সে আয়েশ করে নিশ্চিত জীবন যাপন করে। যে জীবনে কোন কৈফিয়ত নেই।

মবিনুর রহমান সারাক্ষণ কৈফিয়ত ও অপরাধ বোধে ভোগেন। তার উপর যারা ভরসা করে তিনি তাদের কিইবা দিতে পেরেছেন? বাসায় কাজের মানুষ নেই, বউ এর সারাদিন কাজ করতে হয়। সে কিছু বলে না কিন্তু ঠিকই মন খারাপ করে।

বাজার এখন বিলাসিতা বলা যায় সেটাও ঠিকঠাক করতে পারেন না। গত ক'মাস ধরে তিনি গরুর মাংস কিনতে পারেন না। শুধুমাত্র আত্নীয় এলেই কেনা হয়। তাদের খাওয়ানোর পর যা থাকে তাই খেয়েই তৃপ্তির ঢেকুর তুলতে হয়।

তেল, চাল, ডাল তো আছেই সাধারন লেবু, শশার বাজারেও আগুন। বাংলাদেশের জংলী ফল কলা, তার দাম ৫০ টাকা হালি। বাজারে দোকানীর সাথে অতি দরদাম করতে গেলে হরহামেশাই কটাক্ষ শুনতে হয় - সময় নষ্ট করবেন না, আসুন। ব্যবসায়ীদের হাতে নাটাই এর দড়ি। সাধারন যেন অসহায়।

মবিনুর রহমানরা নির্বোধ, বোবা, বোকা আর চাটুকার দরবারের চাকর। যেখানে সততার ঠোঁটে বড় স্কচটেপ মারা। সামনে সকাল বিকেল নদীর জোয়ারের মতো উন্ময়নের বড় বড় বিলবোর্ড।হাস্যেজ্বল সকালে হাওয়া ভর্তি স্বপ্নবেলুন। ছেড়ে দিলে সামান্য উড়ে  গিয়ে শেষ। কিছু মধ্যবিত্ত বাণী চিরন্তনী মাথায় করে জীবন- যাপন। যেন চাঁদের গায়ে শুক্র, যে কোন মুহুর্তেই অবস্থার পরিবর্তন হতেই পারে। সবকিছুই যেন ' অচীন দেশের রাজকুমার'। পথও পানে চেয়ে থাকাই মধ্যবিত্তের শেষ আঁশ। কবে ; কোথায় এর শেষ, কেউ জানেনা।

0 Shares

৫টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ