বন্ধ জানালা

মামুন ১৯ ডিসেম্বর ২০১৪, শুক্রবার, ০৮:১২:৩৮পূর্বাহ্ন গল্প ৪ মন্তব্য

[ এক বন্ধু একবার আমাকে বলেছিল, শুধু প্রেম, ভালোবাসা নিয়েই লিখছ। এর বাহিরে একটু অন্য ধরণের লিখতে পার না? অনেক ভাবলাম, শেষে ভেবে ভেবে উদাস হয়ে গেলাম। কিন্তু এরপর যা লিখলাম, সেখানেও ঘুরে ফিরে হৃদয়েরই প্রাধান্য রইলো। কিন্তু এবার কল্পনা একটু পরাবাস্তবের সাথে মিশে গিয়ে কিছুটা অন্য ধাঁচের লেখায় পরিণত হল। কেমন হল, পাঠকই বলতে পারবেন। একটু বড় হয়ে গেলো, ধৈর্য ধরে সাথে থাকার অনুরোধ রইলো।]
১.

ছেলেটি প্রতিদিনের মতো আজও সকাল বেলায় এলো।

ছোট্ট সরু একটা সবুজ ঘাসের পায়ে চলা পথ ধরে সেই ঐ মাথা থেকে হেঁটে হেঁটে এই পুকুর পাড়ে আসে। এটা ওদের দুজনের পুকুর। এতো দূরে অন্যরা সাধারণত আসে না। তাই মেয়েটির সাথে এখানেই দেখা হয়... অসহ্য নীরব সময়ের গতিতে হাতে হাত ধরে দুজনে সারাদিন বসে থাকে।

পুকুরের ওপাশেই মেয়েটির বাড়ী। ছেলেটি যে ঘাটে বসে থাকে ঠিক তার বিপরীতে একেবারে সোজাসুজি একটা জানালা। মেয়েটির শোবার ঘরের। সেখান থেকেই মেয়েটি, ছেলেটি এলো কিনা দেখে থাকে। ছেলেটি ও মেয়েটির উপস্থিতি এখানে বসে দেখে।

একটা হিজল গাছের নীচেই শান বাধানো ঘাট। পলেস্তারার সিড়ি ধাপে ধাপে পানির অনেক গভীরে নেমে গেছে। কাকের চোখের মত কালো জলের রং। এই কালো গভীরতার পরিচায়ক- মেয়েটির চোখের মনির মত। সেখানেও ছেলেটি হারিয়ে যায়... অনেক গভীরে... দুস্প্রাপ্য মনি-মুক্তো তুলে আনার জন্য ডুবুরির অক্লান্ত পরিশ্রমের মত সেও মেয়েটির চোখের অতলে হারাতে চায়।

মুখে ঈষৎ হাসি টেনে নিয়ে হৃদয়টাকে মেলে ধরে ছেলেটি ওর জোড়া ভুরূর নীচের ভাসা ভাসা চোখ দুটি দিয়ে জানালার দিকে তাকিয়ে হঠাৎ হোচট খায়।

বন্ধ...

জানালাটা বন্ধ!

চোখ রগড়ে নিয়ে আবার তাকিয়ে দেখে। জানালার বন্ধ কপাটের তাতে কোনো হেরফের হয় না। ওটা যেভাবে ছিল- সেভাবেই থেকে যায়।

সময়ের টিক টিক করে বয়ে চলা থেমে থাকে না।

অলস মুহুর্তগুলোকে আরো দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর মনে হয়। বন্ধ জানালার দিকে তাকিয়ে থেকে থেকে চোখে জ্বালা ধরে যায়। কতবার যে চোখ ঝাপসা হয়ে যায়... গালের দু পাশে শুকনো দাগ রেখে গেছে... কষ্টের!

কত কথা মনে পড়ে গেল... কত আশ্বাস... প্রতিশ্রুতি... হৃদয় নিংড়ানো ভালবাসার টুকরো টুকরো শব্দমালা।

মেয়েটির দেয়া।

ছেলেটিকে।

'... আমার এই জানলা কখনো তোমার জন্য বন্ধ হবে না...' এইটা আমার মনের জানালা, সব সময় খোলা থাকবে-তোমার জন্য...'

শেষ বিকেলের আলো গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে ছেলেটির শরীরে পড়ে। সে শেষ বারের মত জানালার পানে তাকায়। নাহ! ওর জন্য এই জানালা বন্ধ হয়ে গেছে। প্রিয় পুকুর ঘাটে বসে ছেলেটি আশে পাশের সব কিছুকে দেখে নিল। আর এখানে আসা হবে না। বুকের ভিতর থেকে এক টানে হৃদয়টাকে বের করে শান বাঁধানো ঘাটে জানালার দিকে মুখ করে রেখে দিল। আশ্চর্য হয়ে অনুভব করল- কোনো ব্যথাই লাগছে না!!

এক হৃদয়হীনার জন্য নিজের হৃদয়টাকেও ছেলেটি দান করে গেল। যাতে করে আর কাউকে হৃদয় টেনে ছিড়ে দিতে না হয়।

মাথা নীচু করে সেই চির চেনা সরু সবুজ পথের উপর দিয়ে ফিরে চললো ছেলেটি... ঘাসগুলোকে লাল করে দিয়ে।
২.

নিজের হৃদয় কে ফেলে এসে সবুজ ঘাস মাড়িয়ে ছেলেটি একেবারে পথের শেষ প্রান্তে একটু থামে। পিছনে একবার তাকানোর ইচ্ছেটাকে বহু কষ্টে সম্বরণ করে। সামনে ভালবাসাহীন অনিশ্চিত জীবন। আদতে জীবন কি এখনো রয়েছে? পিছনে এক ছলনাময়ী আর ওর নখরে ছিন্ন ভিন্ন ছেলেটির নিজের সাবেক হৃদয়। কি করবে সে এখন?

সকল হৃদয়ের মূল উৎস- হৃদয়ের সৃষ্টিকর্তা এতক্ষণ সব কিছু দেখছিলেন। ছেলেটির কষ্টে আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলেন না। তার আকারহীন রুপেই তিনি ছেলেটির সামনে এলেন। ছেলেটি তাকে না চিনলেও ওর শরীরের সমস্ত অনু-পরমানু দিয়ে সে অনুভব করল কেউ একজন ওর সামনে। সে প্রবল আবেগ নিয়ে আসতে চাইলেও হৃদয় না থাকাতে নিয়ে আসোটে পারে না। অদম্য কান্নায় ভেঙ্গে পড়তে চায়। তা ও পারে না। প্রচন্ড ক্রোধে ফেটে পড়তে চায়। সেখানেও ব্যর্থ... এবারে কিছুটা ভয় পেতে চায়। কিন্তু সে যে তার সকল অনুভুতির আঁধার বিনে পয়সায় এক হৃদয়হীনাকে দান করে এসেছে!

সৃষ্টিকর্তা এবারে সদয় হয়ে ওকে নিজের স্পেশাল মাষ্টার হৃদয়ের একটা অংশ কিছু সময়ের জন্য দান করলেন। ছেলেটি এবারে এক সাথে ওর সবগুলো অনুভুতির প্রকাশ করতে চাইলো। কিন্তু একই সাথে কি সব করা যায়! অবশেষে সে তার হৃদয় হারানোর বেদনায় নীল হয়ে প্রেম হারানোর কষ্টে কাঁদতে থাকে। সৃষ্টিকর্তা স্নেহাতুর হয়ে ওকে কাঁদার সুযোগ করে দেন।

কান্না থামলে সৃষ্টিকর্তা ওকে জিজ্ঞেস করলেন-

: আমায় কি চিনতে পারছ?

: হ্যা! আমি তোমার অংশ।

: কেন এতো কষ্ট পেতে চাচ্ছ?

: তুমি দিচ্ছ কেন?

: ভেবে বল, তুমি কি কষ্ট পেতে চেয়েছিলে না? নিরন্তর সুখকে ই কি চাও তবে?

: আমি 'ওকে' চেয়েছিলেম। তুমি কেন দিলে না?

: তুমি তোমার প্রকৃতির জন্যই দ্রত চেয়েছ। কিন্তু আমি তোমাকে এর থেকে ভাল হৃদয় দিতে পারি। চাও কি সেটা?

: না, আমি শুধু 'ওকে'ই চাই।

: তবে তো তোমায় আরো অনেক কষ্ট সহ্য করতে হবে।

: নিজের হাতে উপড়ে দিয়েছি আমার হৃদয়! আর কি সহ্য করব ?

: আমার সাময়িক ধার দেয়া হৃদয় সাথে নিয়ে তোমার হৃদয়কে অন্যের হতে দেখতে হবে... পাশে থেকে খুব সহজে তোমার 'ও' কিভাবে অন্যের হয়ে যাবে সেটা আক্ষেপ ছাড়া দেখতে হবে। পারবে?

: পারব। ... কিন্তু একটা কথা বলবে?

: বলো।

: কেন এমন করলে আমার সাথে!?

: তোমার হৃদয়ে আমি থাকার কথা ছিল। তুমি সেখানে আগে 'ও'কে ধারণ করেছ।

: তুমিই কি সেটা করতে বল নি? তবে কেন এতো মহব্বত সৃষ্টি করলে? কেন 'ও'কে আমার কাছে আনলে?

: সেটা সব ধীরে ধীরে জানবে। এখন যাও, তোমাকে আরো কিছুদিনের জন্য একটা হৃদয় ধার দেয়া হল। তবে আগের সব অনুভুতি তোমাকে ফিরিয়ে দেয়া হবে। ... আর কিছু কি চাও?

: না, ধন্যবাদ। তবে এমন কিছু কর না, যাতে সকল প্রেমিক প্রেম করতে ঘৃনা বোধ করে।

ছেলেটি এক ধার করা হৃদয় নিয়ে সবুজ সেই পথটি ধরে আবার হৃদয়হীনার কাছে ফিরে চলল।

ওদের (এখন শুধু ওর) সেই পুকুর ঘাটে... একটি হিজল গাছের নীচে শান বাঁধানো এক পুকুর ঘাট, যার পলেস্তারা করা সিড়ি অনেক গভীরে নেমে গেছে।

সেখানে ছেলেটি নিজের হৃদয়কে উপড়ে ফেলে এসেছিল।

সৃষ্টিকর্তা অলক্ষ্যে বসে হাসলেন একবার... মায়াভরা হৃদয় নিয়ে ছেলেটির জন্য আরো কিছু মায়া তৈরী করে চললেন।
৩.

ছেলেটি আবার পুকুর ঘাটে ফিরে এলো।

সন্ধ্যা নেমেছে। আজ পুর্ণিমা। গোল থালার মত সুকান্তের ঝলসানো রুটি পুকুর ও এর আশপাশ মায়াবি আলোয় ভরিয়ে দিয়েছে। মেয়েটির জানালা এখনো বন্ধ। তবে ছাদের উপরটা দেখা যাচ্ছে... স্পষ্ট।

হিজল গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে চাদের আলো এক যুবকের শরীরে পড়ছে। প্রকৃতি আজ নব সাজে সেজেছে। তবে যে জন্য এইখানে ফিরে আসা, সেই মেয়েটিকেই দেখছে না সে।

একটু পরিবর্তন হয়েছে কি? ভালভাবে চারপাশটা দেখল।

হ্যা।

ঐ যে মেয়েটির বাড়ীর সামনে আরো একটি অস্থায়ী ঘাটলা বানানো হয়েছে। ছোট একটা স্টীলের বোট ও দেখা যাচ্ছে। চাদের আলো ছাড়াও বাড়ীর ভিতরে এবং প্রাঙ্গনে কৃত্তিম আলোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। আজ ওর প্রিয়ার মনে এই মুহুর্তে কি চলছে খুব জানতে ইচ্ছে করছে। এই মুহুর্তে একটা কবিতা মনে পড়ছে –

‘... লালিমার রথে চড়ে

অস্তাচলে ডুবে গেল ভানু।

কোলাহল হয়ে এলো স্তিমিত প্রায়-

বাঁশ ঝাড়ের আড়াল থেকে হেসে উঠল চাঁদ!

আজ যে তার আসার কথা...

জানি না কোন আবেগে আমার এ প্রগলভতা

হয়তো বা চাঁদকে দেখে।'

ছেলেটার এই আনন্দকে বেশীক্ষন স্থায়ী হতে দিলেন না ‘সকল হৃদয়ের অধিপতি’। দুটো ছায়ামুর্তি হাতে হাত রেখে ছাদে উঠে এলো। ছাদটাকে জোছনা দিনের মতো করে রেখেছে। ছেলেটি ওর মেয়েটিকে অন্য একজনের সাথে দেখে তার ধার করা হৃদয়ে ব্যথার এক ঢেউ অনুভব করা শুরু করল। কিন্তু হৃদয়ের অধিপতিকে দেওয়া কথা মনে হতেই সে নিজেকে সামলে নিতে চেষ্টা করল।

নাহ! সে কষ্ট পেতেই তো আজ এখানে এসেছে। মেয়েটিকে জয় করতে এটাই তার শর্ত ছিল। সে সব কিছু তার পাশে থেকে থেকে দেখবে-অনুভব করবে; কিন্তু যন্ত্রণায় নীল হতে পারবে না। একবারো ‘ওহ’ কিংবা ‘উফ’ করতে পারবে না।

পুকুরের এই পাড় এবং ওই পাড় ছেলেটির কাছে দুটি আলাদা জগত মনে হল। সে তার পাশের সিমেন্টের বেদীতে মেয়েটির জন্য রেখে যাওয়া নিজের উপড়ে ফেলা হৃদয়টির দিকে তাকালো। এখনো সেটি মেয়েটির জানালার দিকে তাকিয়ে আছে... নির্নিমেষ!

ছেলেটির এখন দুটি হৃদয়!

সে দুটি হৃদয় নিয়েই মেয়েটির জন্য গভীর ভালোবাসা অনুভব করছে!

এতো কষ্ট কেন ভালবাসায়?

এই জোছনায় মেয়েটিকে অন্য একজনের হাতে হাত রেখে ঘুরে বেড়াতে দেখে ছেলেটির ঐ গানের কথা মনে পড়ছে -

‘...হয়তো তোমার দেশে আজ

এসেছে নতুন রাতি

তুমি জোছনায় জাগিছো নিশি

সাথে লয়ে নতুন সাথী...

হেথা মোর দীপ জ্বালা রাতে

নিদ নাহি দুটি আঁখি পটে...’

হিজল গাছের নীচে শান বাঁধানো ঘাটে বসা একটি ছেলের দুটি হৃদয়ের সামনে দিয়ে তার প্রিয়তমা অন্য একজনকে নিয়ে স্টীলের একটা বোটে করে সারা পুকুরময় অভিসারে মেতে ঊঠে। বিধাতা তার সব মায়া যেন চাঁদের আলোর ভিতরে ঢেলে দিয়ে ওদের অভিসারকে আরো মধুময় করায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন।

ছেলেটি ধার করা হৃদয় দিয়ে ওর ‘হৃদয়ের অধিপতির’ সাথে সংযুক্ত হয়ে বলে, ‘ আমি বুঝতে পারছি, তুমি কি চাইছ!’

উপড়ে ফেলা হৃদয়টি বেদনায় নীল হয়ে হাহাকার করছে... তবে চাঁদের আলোর মত উদ্ভাসিত হয়ে ছেলেটি ঠোঁটের কোণে হাসি নিয়ে এক দৃষ্টিতে ওদের অভিসার দেখতে থাকে। একটুও যন্ত্রণা সে অনুভব করে না।

এটা তো তার ধার করা হৃদয়!

বিধাতও সব বুঝতে পারেন। তিনিও ছেলেটির দুটো হৃদয়ে যুগপৎ আনন্দ ও বেদনা ঢেলে দিতে থাকেন।

তিনি একজন খেলোয়াড়। খেলার জন্যই তো হৃদয়কে সৃষ্টি করেছেন।
৪.

সারাটা রাত ছেলেটি দুটো হৃদয় নিয়ে একই যায়গায় বসে থাকে।

মেয়েটির নিরব অভিসারের একমাত্র সাক্ষী। একসময় সকাল হয়। ঊষার প্রথম কিরণ এসে পড়ে গাছে-পাতায়-পানিতে-শান বাঁধানো ঘাটে- ছেলেটির উপড়ে ফেলা হৃদয়ে। আর সর্বোপরি গাছের ডালপালা-পাতা ভেদ করে ছেলেটির অস্থি-চামড়া ভেদ করে, একেবারে হৃদয়ের শিরাগুলোতে। এইগুলো তার নিজের যেখানে ধার করা হৃদয়টা সাময়িক জুড়ে আছে।

এই আলোর সাথে যে এক মহাজাগতিক রশ্মির মিশেল দেয়া অপার্থিব অন্য এক আলো ছেলেটির ভিতরে প্রবেশ করল, সে জানতেও পারল না। কিন্তু ধার করা হৃদয়ে সে অস্বস্তি বোধ করতে লাগলো। এদিক সেদিক তাকিয়ে হারিয়ে যাওয়া কিছু একটা খুঁজতে থাকে। মেয়েটির জানালার দিকে তাকায়।

আর কেন জানি সেদিকে তাকাতে ইচ্ছে করছে না!

আশ্চর্য হয়ে সে অনুভব করে-এখন আর মেয়েটির জন্য তার নিজের ধার করা হৃদয়ে কোনো ফিলিং নেই। নিজের উপড়ে ফেলা হৃদয়টির দিকে তাকায়। সেটিও এখন আর জানালার দিকে তাকিয়ে নেই। একটু স্পর্শ করে... নাহ! সেখানেও কোনো কষ্টের অনুভুতি নেই। তবে দুটো হৃদয়েই এক মহা হৃদয়ের সাথে- এক মাষ্টার হৃদয়ের সাথে মিলনের তীব্র আকাঙ্ক্ষা।

সারা রাত ধরে ছেলেটি নিজের অজান্তেই এতটা কষ্ট সহ্য করেছে যে, তার জন্য নির্ধারিত পরীক্ষায় সে পাশ করেছে। যে ‘মাস্টার হৃদয়’ থেকে সকল হৃদয়ের উৎপত্তি- সেই হৃদয়ের সাথে জুড়তে হলে যে পরিমানে পরিশুদ্ধ হতে হয়, গত রাতেই সে তা অর্জন করেছে।

মেয়েটি গোসল করে চুল শুকাতে ছাদে এসেছে। একবার ছেলেটিকে নির্লজ্জের মতো দেখল। তবে তা ঐ একপলক ই। সারা ছাদে সে একাকী হেঁটে বেড়াতে থাকে। ছেলেটি পুকুরঘাট থেকে চলে যেতে চায়। কিন্তু মেয়েটির সাথে ওর সম্পর্কের চেয়ে এবার এই ঘাটটির এবং এর আশপাশের গাছপালা ও সবুজ ঘাসের রাস্তাটির সাথে এতোদিনের রিলেশন ওকে ব্যকুল করে তোলে। নিজের ছিড়ে ফেলা হৃদয়টিকে হাতে তুলে নেয়। চলে যেতে উদ্যত হতেই সেই ‘মাস্টার হৃদয়ের’ আওয়াজ শুনতে পায়-

: চলে যেতে চাইছ?

: হ্যা!

: কিন্তু তোমার প্রেমের কি হবে? ‘ও’কে না পেয়েই চলে যাবে?

: হ্যা! আর ‘ও’ কখনো আমার ছিল না। আসলে ‘ও’রা কখনো কারো হয় না।

: তবে এতো পাগল হয়েছিলে কেন?

: তোমার বানানো খেলার অংশ হিসেবে পাগল হতে হয়েছিল।

: এখন তবে আর ধার করা হৃদয়ের কি প্রয়োজন। তোমারটা ই নিয়ে নাও।

: নাহ! আমার এখন আর কোনো হৃদয়েরই প্রয়োজন নেই। আমি হৃদয় ছাড়াই অনুভব করতে শিখে গেছি।

: তবে আমার টা আমি নিয়ে নিলাম। আর এই উপড়ে ফেলাটার কি করতে চাও?

বিষন্ন হেসে ছেলেটি বলে-

: ওটা?-বন্ধ জানালার দিকে এক পলক তাকিয়ে বিধাতাকে উদ্দেশ্য করে বলে- ওটা ঐ হৃদয়হীনার বুকের একেবারে উপরে লাগিয়ে দাও। তুমি তো সব কিছু জানো। কেন ওটা দিতে বলছি সেটাও বুঝেছ নিশ্চয়ই।

: হ্যা! তবে এখন তুমি কোথায় যেতে চাইছ?

: আমি হৃদয় নিয়ে নাড়াচাড়া করে করে হৃদয় নিংড়ে যতটুকু কষ্ট এবং ভালবাসা বের করা যায়-সব বের করে এর মর্মার্থ জেনে গেছি।

: কি জানলে? কি বুঝলে?

: তুমি খুব ভাল করেই জানো।

: এসো তবে... আমার সাথেই মিশে যাবে চল।

ছেলেটি ধার করা হৃদয় বিধাতাকে দিয়ে আবারো হৃদয়শূন্য মানবে পরিণত হয়। তবে এবারে সে হারে না। সে মেয়েটির সাথে প্রেম করে মহব্বতের পেয়ালা পান করা শিখেছে। সেই পেয়ালায় চুমুক দিয়ে দিয়ে এতোটা ভালবাসা সে অর্জন করেছে যে, হৃদয়হীনা এক ছলনাময়ীর ভালবাসা তার কাছে এখন তুচ্ছ মনে হচ্ছে। আসল ভালবাসা যে সেই ‘মাস্টার হৃদয়ের’ ভিতরে এবং সকল ভালোবাসা শুধু তার জন্যই এটা বুঝে এসে গিয়েছে।

একটি হিজল গাছের ছায়ায় শান বাঁধানো এক পুকুর ঘাটের সিমেন্টের বেদীতে ছেলেটি টান টান হয়ে শুয়ে পড়ে। শ্রান্তিতে তার চোখ দুটি বুজে আসে। তবে তার আগে সে তার মনের চোখ দিয়ে মহাকালকে দেখে নেয়। এরপর আস্তে আস্তে সেই ‘মাস্টার হৃদয়ের’ সাথে বিলীন হয়ে যায়।

ছেলেটির দেহট নীরব পড়ে থাকে পুকুর ঘাটে।

মেয়েটি একা একা ওর কাছে আসে। মেয়েটির চোখে জল। কিন্তু এটা ওর নিজের নয়। ওর বুকের বাম পাশে অনেকটা যায়গা একটা হৃদয়ের আকৃতি নিয়ে ফুলে আছে। এটা ছেলেটার হৃদয়-যা সে মেয়েটিকে নিজ হাতে উপড়ে দান করে দিয়েছিল।

দুটি হৃদয় নিয়ে মেয়েটি ছেলেটির দেহের পাশে বসে কান্নার চেষ্টা করে। কিন্তু মেয়েটির নিজের হৃদয় থেকে কোনো অনুভুতি আসে না। বুকের উপরের দৃশ্যমান হৃদয় থেকে অনুভুতির আন্দোলন সে টের পায়-কিন্তু এটা যে ছেলেটির অনুভুতি!

ইচ্ছেকরে যে জানালাটিকে সে বন্ধ করে রেখেছিল একজন সত্যিকারের ভালবাসার মানুষের জন্য- আজ হাজার চেষ্টা করেও সে তার নিজের হৃদয়ের জানালাটিকে খুলতে পারে না।

একটা শান বাঁধানো পুকুরঘাটে একটি ছেলের দেহ আগলে দুই হৃদয়ের অধিকারিণী একজন হৃদয়হীনা নির্বাক বসে থাকে... একটি হিজল গাছের নীচে যেখানে সিমেন্টের পলেস্তারার সিঁড়ি পানির অনেক গভীরে নেমে গেছে।।

0 Shares

৪টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ