বন্ধু

রিমি রুম্মান ১১ আগস্ট ২০১৬, বৃহস্পতিবার, ১২:০৯:৩৮পূর্বাহ্ন একান্ত অনুভূতি ৩৩ মন্তব্য

শৈশব, কৈশোরের বন্ধুদের ছেড়ে এই দূরদেশে যখন আসি, এখানে কিছু বন্ধু হয়।

সব তরুনের মাঝে আমি একমাত্র তরুণী। একমাত্র বিবাহিত কাপল, বিধায় আমি সকলের বন্ধু এবং ভাবী। বিদেশ বিভূঁইয়ের শুরুর দিনগুলোয় আমাদের সকলেরই গরিবী হাল। গাড়ি নেই কারোরই। কিন্তু ঘুরে বেড়ানো, আনন্দ, আড্ডা__ এসব তো আর থেমে থাকতে পারে না। সপ্তাহের ছুটির দিনগুলোতে গাড়ি ভাড়া করে ঘুরতে যাই দূর দূরান্তে। কখনো নায়াগ্রা ফলস্‌, কখনো ওয়াশিংটন ডিসি, কখনো আটলান্টিক সিটি সহ নতুন নতুন জায়গায়। প্রচণ্ড শীতের কিংবা তুষারপাতের সময়টাতে বাড়িতে বসে মুভি দেখা, আড্ডা, গান চলে রাতভর। 

বছর গড়ায়। বন্ধুরা এদেশের নাগরিকত্ব পেয়ে একে একে দেশে গিয়ে বিয়ে করে।

স্ত্রীদের এদেশে নিয়ে আসে। সংসার বড় হয়। স্ত্রী'রা সকলেই হয়ে উঠে একে অপরের বন্ধু। এভাবেই আমাদের সবার সন্তানরাও একে অপরের বন্ধু হয়।আমাদের এই বোঝাপড়া, ভালোবাসা, বিপদে এগিয়ে আসা__ এইসব সুখ দুঃখের গল্পের মাঝে কেটে যায় বিশ'টি বছর।

চারিদিকে যখন বন্ধুদিবস, আমরা বন্ধুরা তখন বাড়ি থেকে ২১০ মাইল দূরে এক ভিলেজে। কাঠের দোতলা হোটেল রুমে বসে নির্ঘুম আড্ডায় মেতে থাকি। অল্প ঘুমিয়েই আবার জেগে উঠি। জায়গাটির নাম "লেক জর্জ"। বিশাল লেকটিকে ঘিরে গ্রামটি গড়ে উঠেছে। ছোট ছোট কটেজ চারিদিকে। রেস্তোরাঁগুলোও গাঁ'য়ের রেস্তোরাঁর মতন। ছোট একটি ঘর, বাইরে কিছু চেয়ার, টেবিল। সেইসবে বসে কিছু মানুষ সকালের নাস্তা খেতে খেতে নিচু স্বরে নিজেদের মাঝে গল্পে মশগুল। সেই ছোটবেলায় টিভিতে দেখা ইংলিশ ছবিতে যেমনটি দেখতাম, ঠিক তেমনটি। ভীষণ খরা গায়ে মেখে আমরা বন্ধুরা ভিন্ন ভিন্ন স্পীড বোট এ চড়ি। এক একটি বোট এক এক দিকে শাঁশাঁ করে ছুটে চলে। আকাশ, সে এক নিঃসীম নিলান্ত। চারিপাশে স্থির পাহাড়। আকাশের গাঢ় নীল পাহাড়ের গা ঘেঁষে নিচে নেমে এসে লেকের জলকেও থৈ থৈ নীল করে রাখে। আমরা গলা ছেড়ে গেয়ে উঠি__ ও রে নীল দরিয়া... আমায় দে রে দে ছাড়িয়া... " আমাদের গান শুনে অল্প দূরের স্পীডবোটে থাকা ভিনদেশী'রা হাত নেড়ে ভালোলাগা জানায়।
image-0-02-01-5c9dc9a2b6a05f9b6afab7a6891ca5adc5702ae59bf6af3f14078439d5d680f6-Vআমরা কখনো সরু সাঁকোয় বসে পায়ের পাতা ভিজাই। কখনো সবাই একযোগে লেকের পানিতে ডুবি, ভাসি, সাঁতারের প্রতিযোগিতায় নামি। দুপুর গড়িয়ে বিকেল শুরুর আগে সবুজ মাঠে ঘাসের ডগা ছুঁয়ে ছুঁয়ে হাঁটি। সূর্যাস্তের সময় দূর পাহাড়ের উপর এক টুকরো রোদ হাঁটতে হাঁটতে মিলিয়ে যায় গাঢ় অন্ধকারে, একলা অভিমানী নারীর মতন। লেকের তীরে ক্রমশ সন্ধ্যা নামে। চারিপাশের নির্জনতায় থেমে থাকে সাজানো গোছানো ছোট্ট গ্রামখানি।
image-0-02-01-bf538056c5398d38b339c1f38631ea4e8b49db593fbe377ed9aeb16d97813689-Vদু'দিনের আনন্দ শেষে সাথে করে নিয়ে আসি শেষ বিকেলের রোদ আর কুড়িয়ে পাওয়া পাখির পালক। কিন্তু গাঢ় বাতাস পালকটি উড়িয়ে নিয়ে যায় খড়কুটোর সাথে প্রান্তর থেকে প্রান্তরের দিকে।আমরা ফিরি। সব ক'টি গাড়ি একযোগে রওয়ানা দেই।ধূধূ অন্ধকারে হাইওয়ে ধরে ছুটে চলে গাড়িগুলো। পিছনে পড়ে রয় একলা পিচঢালা ছাইরঙা পথ, শত বছরের পুরনো অন্ধকার, রাস্তার দু'ধারের প্রাচীন বৃক্ষ, গহীন বন আর বিগত সময়। আমরা সামনের দিকে যেতে থাকি। যেতেই থাকি। আমাদের বাড়ি যে ওইদিকে !

ছোট্ট এই জীবনে আমরা বাঁচি সম্পর্কের মায়ার বন্ধনে।

ভীষণ এক মায়া। বন্ধু থেকে পরিবার হয়ে উঠার মায়া।

আমার কেবলই দেরি হয়ে যায়, তবুও সবাইকে "বন্ধু দিবস" এর শুভেচ্ছা, ভালোবাসা ...

 

রিমি রুম্মান

নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র

0 Shares

৩৩টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ