শৈশব, কৈশোরের বন্ধুদের ছেড়ে এই দূরদেশে যখন আসি, এখানে কিছু বন্ধু হয়।
সব তরুনের মাঝে আমি একমাত্র তরুণী। একমাত্র বিবাহিত কাপল, বিধায় আমি সকলের বন্ধু এবং ভাবী। বিদেশ বিভূঁইয়ের শুরুর দিনগুলোয় আমাদের সকলেরই গরিবী হাল। গাড়ি নেই কারোরই। কিন্তু ঘুরে বেড়ানো, আনন্দ, আড্ডা__ এসব তো আর থেমে থাকতে পারে না। সপ্তাহের ছুটির দিনগুলোতে গাড়ি ভাড়া করে ঘুরতে যাই দূর দূরান্তে। কখনো নায়াগ্রা ফলস্, কখনো ওয়াশিংটন ডিসি, কখনো আটলান্টিক সিটি সহ নতুন নতুন জায়গায়। প্রচণ্ড শীতের কিংবা তুষারপাতের সময়টাতে বাড়িতে বসে মুভি দেখা, আড্ডা, গান চলে রাতভর।
বছর গড়ায়। বন্ধুরা এদেশের নাগরিকত্ব পেয়ে একে একে দেশে গিয়ে বিয়ে করে।
স্ত্রীদের এদেশে নিয়ে আসে। সংসার বড় হয়। স্ত্রী'রা সকলেই হয়ে উঠে একে অপরের বন্ধু। এভাবেই আমাদের সবার সন্তানরাও একে অপরের বন্ধু হয়।আমাদের এই বোঝাপড়া, ভালোবাসা, বিপদে এগিয়ে আসা__ এইসব সুখ দুঃখের গল্পের মাঝে কেটে যায় বিশ'টি বছর।
চারিদিকে যখন বন্ধুদিবস, আমরা বন্ধুরা তখন বাড়ি থেকে ২১০ মাইল দূরে এক ভিলেজে। কাঠের দোতলা হোটেল রুমে বসে নির্ঘুম আড্ডায় মেতে থাকি। অল্প ঘুমিয়েই আবার জেগে উঠি। জায়গাটির নাম "লেক জর্জ"। বিশাল লেকটিকে ঘিরে গ্রামটি গড়ে উঠেছে। ছোট ছোট কটেজ চারিদিকে। রেস্তোরাঁগুলোও গাঁ'য়ের রেস্তোরাঁর মতন। ছোট একটি ঘর, বাইরে কিছু চেয়ার, টেবিল। সেইসবে বসে কিছু মানুষ সকালের নাস্তা খেতে খেতে নিচু স্বরে নিজেদের মাঝে গল্পে মশগুল। সেই ছোটবেলায় টিভিতে দেখা ইংলিশ ছবিতে যেমনটি দেখতাম, ঠিক তেমনটি। ভীষণ খরা গায়ে মেখে আমরা বন্ধুরা ভিন্ন ভিন্ন স্পীড বোট এ চড়ি। এক একটি বোট এক এক দিকে শাঁশাঁ করে ছুটে চলে। আকাশ, সে এক নিঃসীম নিলান্ত। চারিপাশে স্থির পাহাড়। আকাশের গাঢ় নীল পাহাড়ের গা ঘেঁষে নিচে নেমে এসে লেকের জলকেও থৈ থৈ নীল করে রাখে। আমরা গলা ছেড়ে গেয়ে উঠি__ ও রে নীল দরিয়া... আমায় দে রে দে ছাড়িয়া... " আমাদের গান শুনে অল্প দূরের স্পীডবোটে থাকা ভিনদেশী'রা হাত নেড়ে ভালোলাগা জানায়।
আমরা কখনো সরু সাঁকোয় বসে পায়ের পাতা ভিজাই। কখনো সবাই একযোগে লেকের পানিতে ডুবি, ভাসি, সাঁতারের প্রতিযোগিতায় নামি। দুপুর গড়িয়ে বিকেল শুরুর আগে সবুজ মাঠে ঘাসের ডগা ছুঁয়ে ছুঁয়ে হাঁটি। সূর্যাস্তের সময় দূর পাহাড়ের উপর এক টুকরো রোদ হাঁটতে হাঁটতে মিলিয়ে যায় গাঢ় অন্ধকারে, একলা অভিমানী নারীর মতন। লেকের তীরে ক্রমশ সন্ধ্যা নামে। চারিপাশের নির্জনতায় থেমে থাকে সাজানো গোছানো ছোট্ট গ্রামখানি।
দু'দিনের আনন্দ শেষে সাথে করে নিয়ে আসি শেষ বিকেলের রোদ আর কুড়িয়ে পাওয়া পাখির পালক। কিন্তু গাঢ় বাতাস পালকটি উড়িয়ে নিয়ে যায় খড়কুটোর সাথে প্রান্তর থেকে প্রান্তরের দিকে।আমরা ফিরি। সব ক'টি গাড়ি একযোগে রওয়ানা দেই।ধূধূ অন্ধকারে হাইওয়ে ধরে ছুটে চলে গাড়িগুলো। পিছনে পড়ে রয় একলা পিচঢালা ছাইরঙা পথ, শত বছরের পুরনো অন্ধকার, রাস্তার দু'ধারের প্রাচীন বৃক্ষ, গহীন বন আর বিগত সময়। আমরা সামনের দিকে যেতে থাকি। যেতেই থাকি। আমাদের বাড়ি যে ওইদিকে !
ছোট্ট এই জীবনে আমরা বাঁচি সম্পর্কের মায়ার বন্ধনে।
ভীষণ এক মায়া। বন্ধু থেকে পরিবার হয়ে উঠার মায়া।
আমার কেবলই দেরি হয়ে যায়, তবুও সবাইকে "বন্ধু দিবস" এর শুভেচ্ছা, ভালোবাসা ...
রিমি রুম্মান
নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র
৩৩টি মন্তব্য
নীলাঞ্জনা নীলা
রিমি আপু প্রকৃত বন্ধরাই একসময় পরিবারের অংশ হয়ে যায়। তা নইলে বিদেশ-বিভুঁইয়ে জীবনটা মাঝে-মধ্যে বে-হিসেবী হতো না। শুধু ছকে কাটা জীবনই সময়ের সঙ্গী হতো।
তোমার লেখনী এমনই, তুমি বেড়ালে, তোমার সাথে আমিও ঘুরে এলাম। -{@
রিমি রুম্মান
ভ্রমন নিয়ে লিখেছি কমই। কত জায়গায় ঘুরা হয়, বেড়ানো হয় । শুধু সময় স্বল্পতায় লেখা হয় না কত কি !
ভাল থেকো, নীলা’দি। -{@
নীলাঞ্জনা নীলা
রিমি আপু ভ্রমণ নিয়ে লেখো। পড়ে পড়ে সেসব জায়গা ঘুরে নেবো।
ভালো রেখো নিজেকে। -{@
শুন্য শুন্যালয়
লেখা পড়ার পর থেকে, ওরে নীল দরিয়া গাইছি আপু। নীল দরিয়ার সাথে আপনার ছবির নীল জল, নীল পাহাড়, নীল আকাশ সব মিলেমিশে গেছে। আচ্ছা বন্ধু দিবসে এত্ত মজা করে আমাদের দেরীতে বন্ধু দিবসের শুভেচ্ছা জানানো হচ্ছে? মানবো না, মানিনা। সুখদুঃখ এইভাবে জড়িয়েই বন্ধু নিয়ে আমরা সামনের দিকে এগিয়ে যাই, আমাদের বাড়ি যে অইদিকে, কী অদ্ভূত সুন্দর করে লেখা। বন্ধু দিবসের শুভেচ্ছা আপু এক ঝুড়ি। -{@
রিমি রুম্মান
এই “কোথাও কেউ নেই” এর দেশে বন্ধু থেকে পরিবার হয়ে উঠা চাট্টিখানি কথা নয়, শুন্য আপু। তাও আবার দীর্ঘ বিশটি বছর একসাথে চলা।
বন্ধু দিবসের শুভেচ্ছা দেরিতে দিলে কি হবে, সোনেলা সাথে ছিল, হৃদয়ে।
তাই তো ফিরেই লিখতে বসে গেলাম। 🙂
সিকদার
বিনে পয়সায় বেড়ানো হল সেই সাথে দারুন কাব্যিক এক অনুভতি । -{@
রিমি রুম্মান
অনেক শুভকামনা জানবেন। -{@
মৌনতা রিতু
দেরিতে শুভেচ্ছা পেলেও এমন বন্ধুময় আড্ডায় আমরা মেতে গেলাম। যদিও মনে মনে হিংসে হচ্ছে। যেতে ইচ্ছে হচ্ছে এমন যায়গাতে।
ছবিগুলো দারুন।
রিমি রুম্মান
জায়গাটি সত্যিই চমৎকার। আমাদের সবারই আবারো যেতে ইচ্ছে করছে। সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি কতো অদ্ভুত সুন্দর, বার বার কথাটি মনে হয়েছে।
অপার্থিব
প্রতিটা মানুষের জীবনে বন্ধুর খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু ভূমিকা থাকে । মনের অব্যক্ত কথাগুলো শেয়ারের জন্য বন্ধুর চেয়ে ভাল কেউ নেই।
ভাল লেগেছে লেখাটি।
রিমি রুম্মান
অনেক ভাল থাকুন।
শুভকামনা জানবেন।
ইকরাম মাহমুদ
ছোট্ট এই জীবনে আমরা বাঁচি সম্পর্কের
মায়ার বন্ধনে।
ভীষণ এক মায়া। বন্ধু থেকে পরিবার হয়ে
উঠার মায়া।♣♣
মায়ার মায়ায় পরেই তো জীবনের মায়ায় জড়িয়ে যাই আমরা। বন্ধু দিবসে বন্ধুদের নিয়ে লেখাটা ভালো লাগলো খুব। শুভেচ্ছা নিবেন বন্ধুর।
রিমি রুম্মান
ভাল থাকুন, নিরাপদ থাকুন।
শুভকামনা।
মোঃ মজিবর রহমান
ছোট্ট এই জীবনে আমরা বাঁচি সম্পর্কের মায়ার বন্ধনে।
ভীষণ এক মায়া। বন্ধু থেকে পরিবার হয়ে উঠার মায়া।
ভাল বলেছেন।
রিমি রুম্মান
ভাল থাকুন, সুস্থ থাকুন।
মোঃ মজিবর রহমান
আপনিও ভাল থাকুন।
ব্লগার সজীব
আপু এত মায়া দিয়ে কিভাবে লেখেন? কত সুন্দর করে লিখলেন, বন্ধুত্বের মায়ার কথা। নীল লেকের আপনি দেখে ওরে নীল দরিয়া গান না গেয়ে উপায় আছে? বন্ধু দিবসের শুভেচ্ছা আপু আপনি হলেন বন্ধু আপু 🙂 -{@ লেখাটি সম্ভবত প্রথম আলোতে প্রকাশিত হয়েছে। আমাদের আপন একজন আপুর লেখা নিয়মিত প্রথম আলোতে প্রকাশিত হয়, এটি ভাবতেও ভাল লাগে, আমাদের রিমি রুম্মান আপু, যাকে আমরা জানি, যিনি আমাদের জানেন 🙂
রিমি রুম্মান
হ্যাঁ লেখাটি “প্রথম আলো ” তে প্রকাশিত হয়েছে।
আমি যেখানেই লিখি না কেন, “সোনেলা” য় লেখালেখির মাধ্যমে এ পথে এসেছি__ এটি দিনরাতের মতই সত্য। এখানকার মানুষগুলো আমাকে তাঁদের মন্তব্য দিয়ে প্রতিটি লেখায় উৎসাহ দিয়েছে। তাই “সোনেলা”র কথা আমাকে সবখানে বলতেই হবে। 🙂
গাজী বুরহান
“ও রে নীল দরিয়া… আমায় দে রে দে ছাড়িয়া” গানটি আমার ভিষণ পছন্দ
রিমি রুম্মান
বিদেশের মাটিতে কোন এক লেকের নীল পানি দেখে সমস্বরে “ও রে নীল দরিয়া” গানটি গেয়ে উঠার অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করার নয়।
ইঞ্জা
আপু, মন ছুঁয়ে যান বারবার আর এই জন্যই আমার লেখার এতো ভক্ত আমি। 🙂
রিমি রুম্মান
জেনে ভাল লাগলো।
এমন করে বললে, সব ছেড়ে ছুঁড়ে শুধু লিখতেই মন চাইবে যে ! 🙂
ইঞ্জা
লিখুন আপু, আমার আছি সাথে
অনিকেত নন্দিনী
মায়া। মায়া আটকে রাখে, মায়াই অদৃশ্য বন্ধনে জড়িয়ে রাখে। এই মায়া না থাকলে কী যে হতো!
লেক জর্জের নীলপানিতে ভাসার গল্প শুনে যেন চোখের সামনেই সব দেখতে পেলাম। এত্ত সুন্দর করে লিখেন আপু!
বন্ধু দিবসের বিলম্বিত শুভেচ্ছা।
রিমি রুম্মান
এমন ভালোলাগা কাজ করেছিল মনের গহিনে, যখন নায়াগ্রা জলপ্রপাত দেখি। এরপর সেই জলপ্রপাত দেখতে গিয়েছিলাম অগনিত বার। আমার বাড়ি থেকে যদিও নায়াগ্রা ৮/৯ ঘণ্টার ড্রাইভ, তবুও।
সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টির প্রতি মুগ্ধ না হয়ে পারা যায় না।
মনির হোসেন মমি(মা মাটি দেশ)
বন্ধুতো বন্ধুই তার কোন সীমানা নেই….আপনার সকল বন্ধুদের নিয়ে ভাল থাকুন এই কামনা।
রিমি রুম্মান
ভাল থাকুন আপনিও।
শুভকামনা জানবেন।
মেহেরী তাজ
আপনি দেরি করলে আমি তারচেয়ে অনেক বেশি দেরি করি। লেখা ১১ তারিখের। আর আমি পড়ছি আজ।
বন্ধু দিবসের শুভেচ্ছা আপু। 🙂
রিমি রুম্মান
অনেক শুভেচ্ছা। -{@
জিসান শা ইকরাম
বন্ধু ছাড়া জীবন চলে না,
বন্ধু হল বেঁচে থাকার প্রান, আলো।
সুন্দর, মায়াময় বর্ননায় বন্ধুতাকে বুঝিয়ে দিলেন।
বন্ধু দিবসের শুভেচ্ছা।
রিমি রুম্মান
শুভেচ্ছা দাদা ভাই। -{@
আবু খায়ের আনিছ
অনেক দেরিতে বন্ধু দিবসে শুভেচ্ছা আপু। নিউইর্য়ক, বুফালোর কিছু ছবি দেখেছিলাম তাও বছর পাচেক আগে এক বন্ধুর কল্যানে। জানিনা সে এখন কেমন আছে, কোথায় আছে। যোগাযোগ নেই, তবে খুব সন্দুর শহর মনে হয়।
রিমি রুম্মান
বাফেলো আমার বাড়ি থেকে ৮/৯ ঘণ্টার ড্রাইভ। ক্যানাডা আর আমেরিকার বর্ডার যাকে বলে। সেখানে “নায়াগ্রা জলপ্রপাত” । গিয়েছি অসংখ্যবার। অদ্ভুত সুন্দর জায়গা।