নিছক গল্প (শেষ পর্ব)

সাতকাহন ১৯ জুলাই ২০১৩, শুক্রবার, ১০:৪৩:৪০অপরাহ্ন গল্প ১৫ মন্তব্য

মজিদ সাহেব অনেক চেষ্টা করেও ছুটি গ্রহণের দিন নির্দিষ্ট করতে পারছিলেন না। জীবন হচ্ছে একটা পরিপূর্ণ সিরিয়াল ড্রামা। এর শুরু এবং শেষটা সবার জানা কিন্তু মাঝখানটা অজানা। মজিদ সাহেব টেলিফোন পেলেন নূরজাহান আপা বাথরুমে পড়ে গিয়ে পা ভেঙে ফেলেছেন। সংবাদটি পাবার পর মজিদ সাহেব অস্থির হয়ে পড়েন। মজিদ সাহেব দেশে ছুটে এলেন পরদিন সকালে। হাসপাতালে ঘন্টাখানেক কাটিয়ে তিনি বাসায় এলেন। হাসপাতাল থেকেই তিনি গাড়ি ছেড়ে দিয়েছেন। রিক্সার ঝাঁকুনিতে তিনি ঘেমে গেছেন। এখন সবচেয়ে জরুরী গোসল করা। ব্যাগ খুলে দেখলেন তোয়ালেটা আনা হয়নি। সুমনের ঘরের দরজা খোলা দেখে তিনি তোয়ালে আনতে গেলেন এবং ঘরের মধ্যে এক পা দিয়েই ছিটকে বেড়িয়ে এলেন।

মানুষের অভিজ্ঞতা যে কোনো বয়সে হতে পারে। এই মুহূর্তে তিনি যে অভিজ্ঞতা লাভ করলেন তা হলো কোনো নবদম্পতির ঘরে বিনা নোটিশে ঢুকে পড়া ঠিক না। আসলে সুমনের বিয়ের কথাটা মনেই ছিলো না মজিদ সাহেবের।

মজিদ সাহেব মাদারীপুর এসেছেন নির্বাচনের আগের দিন। ইমন বাড়িতে নেই, থাকার কথাও না। সুমনের ঘর তালাবদ্ধ। সম্ভবত ওরা নুরজাহান আপার ওখানে গিয়েছে। মজিদ সাহেব ইমনের ওপর থেকে রাগটা সরাতে পারছেন না। রাজনীতি চর্চার সুযোগ কি এখন ইমনদের মতো ছেলেদের আছে? মজিদ সাহেব নিয়ন্ত্রণ অযোগ্য বিষয় নিয়ে সময় কাটাতে চাইলেন না। তিনি ব্যাগ থেকে সেলিম আল দীনের স্বর্ণবোয়াল উপন্যাসটি বের করলেন। বইটি বহুবার পড়েছেন তিনি; এখন শুধু বিশেষ বিশেষ জায়গাগুলোতে চোখ বুলিয়ে তৃপ্তি পান।

সেলিম আল দীনের স্বর্ণবোয়াল উপন্যাসটি পড়া শুরু করলেই আর্নেস্ট হেমিংওয়ের ‘দি ওল্ড ম্যান এ্যান্ড দি সী’ উপন্যাসটির কথা মনে পড়ে মজিদ সাহেবের। হেমিংওয়ের লেখায় সমুদ্রের সুনীল জলরাশির উন্মত্ততা বৃদ্ধ বড়শীওয়ালার সংগ্রাম আর সেলিমের লেখায় মাটির অচিন গন্ধ আর ভাগ্য বিপর্যয়ের সহজ স্বভাবিক বয়ান।

মজিদ সাহেব পড়ে চলেছেন…

‘বিশাল সে মাছ। মাথায় আয়তন এক কি দেড়হাত যেন সে জলের বিস্তারিত সাম্রাজ্যের সম্রাট। চিরলীর গর্জনশীল নদী থেকে বেড়িয়েছিলো আষাঢ়ী বর্ষণের আনন্দ কাননে... যে জলনবীর সাধনা স্থলের চারপাশ পাহারা দেয় জলসিংহের ক্রোধে... স্বর্ণবোয়াল থামে। খলিশা মাঝির দিকে তাকায় অবেহেলায় যেনো সে এই বলে, কে আমাকে করবে শিকার ধন্যজাত শিকার কৌশল নক্ষত্রের অভিজ্ঞতার সঙ্গে।

দেখো মানুষ, এইভাবে প্রাচীন মহান শিকারীরা ক্ষিপ্র খর ফণাতোলা বাতাসে নীল ইজিয়ান, পারস্য, ভূমধ্যসাগর, ক্যারিবীয় ও বঙ্গোপসাগরের দিকে গিয়েছিলো তারপর তারা কেউ ফিরে নাই।

মাছ শিকারের অদ্ভুত যাদুকরী বর্ণনায় সাথে সাথে অনন্ত আকাশের নীচে গৃহজীবনের টানা পোড়েন…

দুর্ভাগ্য কপালে নিয়া আইলা মায়ের ঘরে

তোমার মাওরে তোমার বাপে তালাক দিল পরে

সুখের ঘরে দুখের আগুন কপাল খানা ভাঙা

ভাবিয়া চিন্তিয়া আমি তারে করলাম হাঙা’

সকাল আটটায় নির্বাচন শুরু হয়েছে। নির্বাচনী ফলাফলটা এখনও বিধাতার হাতে আর পুলিশের হাতে আইনশৃংখলা রক্ষার ভার। রাজকুমার এডওয়ার্ড ইন্সটিটিউশন নামের স্কুলটি ইমনদের নিকটবর্তী কেন্দ্র। কোনো অজানিত কারণে এই কেন্দ্রটির ভোট গ্রহণ মন্থর গতিতে চলতে থাকে। বেলা সাড়ে এগারোটার দিকে ইমন সমর্থকরা এ নিয়ে হট্টগোল শুরু করে দেয়। কর্তব্যরত ম্যজিস্ট্রেট লাঠি চার্জের আদেশ দেন। লাঠালাঠিতে অনেক সময় হিতাহিত জ্ঞান থাকে না পুলিশের। তার ভূমিকা থাকে ইবনে মিজানের ছবির ভিলেনের মতো। মিজান সাহেবের খলনায়কদের অভিনয়গুণ থাকার দরকার হয় না; মোটামুটি বদমাশ ধরনের চেহারা আর নায়িকা দেখামাত্র ঝাঁপিয়ে পড়ার দৈহিক ক্ষিপ্রতা থাকলেই ভিলেন ওকে।

পুলিশ দৌঁড় জানা বুদ্ধিমানদের নাগাল না পেয়ে ভোটারদের পেটাতে থাকে। ভোট দিতে এসে মার খাবার ঝুঁকি নিতে চায় না অনেকেই। ধীরে ধীরে ভোটার কমতে থাকে। ইমনের অনেকগুলো কেন্দ্র ঘুরে আসতে চারটা বেজে যায়। ততক্ষণে কিছু করার নেই। জীবনের প্রথম নির্বাচনে নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালে দৌড়াতে চায় না সে। ইমন চলে যায় সহকারী রিটানিং অফিসারের কার্যালয়ে।

প্রচলিত কয়েকটি শব্দের মধ্যে বাঙলাদেশের বাস্তবতার রূপ লুকিয়ে আছে। ওয়ান ইলেভেন মানে দুর্নীতিবাজদের দীর্ঘ তালিকা, গনেশ উল্টে যাওয়া পতন, সংস্কার মানে নিজেকে বাঁচানোর জন্য যা ইচ্ছে তাই বলা (জান বাঁচানো ফরজ), কালোরাত্রি, কালো পোশাক, অন্তিম দৌঁড়, জমাট রক্তে ঢেকে যাওয়া দূর্বাঘাস-এই অবস্থার এক কথায় প্রকাশ ‘ক্রসফায়ার শব্দটি’ এমনি একটি শব্দ ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং যা নির্বাচনী সকল অবৈধ কর্মকাণ্ডকে ধারণ করে। ইমন এই ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে একেবারে কাঁচা। তার কর্মকাণ্ড কাঠমিস্ত্রি মানের। হাইকমান্ডের কথা মেনে চললে বিজয় মিছিলটা হয়তো তার পেছনে পেছনে যেতো। মাত্র ২৬৮১ ভোটে হেরে যায় ইমন।

পরাজয়ের ব্যথার পরিবর্তে ইমনের মনটা গভীর আনন্দে ভরে ওঠে। তার প্রাপ্ত ভোটগুলো নির্ভেজাল-ভালোবাসা এবং গভীর আস্থায় সিক্ত। এই মানুষগুলোর ভালোর জন্য আজীবন কাজ করবে সে।

মজিদ সাহেব ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আছেন। এই বাড়ির নিস্তদ্ধতাই বলে দিচ্ছে নির্বাচনের ফলাফল কোনোদিকে গেছে। পূর্বদিকে আলোর আভা। কুড়ি-পঁচিশ মিনিটের মধ্যে একটা কুসুমরঙা সূর্য উঠে পৃথিবীটাকে চঞ্চল করে তুলবে। ইমনের ঘরে আলো জ্বলছে। সম্ভবত সে ল্যাপটপ নিয়ে বসেছে। এই ছেলেটা যেকোনো অবস্থায় ঠাণ্ডা মাথায় কাজ করতে পারে। রাজনীতিবিদদের ওপর মজিদ সাহেবের ক্ষোভ দীর্ঘদিনের। কোর্টে এদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলার আর্জি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়েন তিনি। ‘ইত্তর এক্সিলেন্সি’ বলে বিগলিত উকিল সাহেবরা তাদের বাঁচানোর জন্য দৌঁড়-ঝাঁপ করেন, জামিন প্রার্থনা করেন। এই ক্ষেত্রে টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া একটাই সাফাই বাক্য তার মক্কেল সরকারি দলের ষড়যন্ত্রের শিকার। জনগণ এইসব নেতার জন্য জেলখানার দুয়ারে ফুলের মালা নিয়ে অপেক্ষা করে।

ইমন রাজনীতি করুক এটা মজিদ সাহেব চাননি। মেধাবী ছেলেরা রাজনীতি না করলেও চলে। মজিদ সাহেব এই ভাবনাটা ভাবার সাথে সাথে মজিদ সাহেবের ভেতরের মানুষটা যিনি শুধু আইনের কাঠিন্য ও মর্যাদা বজায় রাখার জন্য জজিয়তি করেন না সেই বায়বীয় অবয়বের বিবেকী মজিদ সাহেবের সাথে জজ মজিদ সাহেবের দ্বন্দ্ব শুরু হয়ে যায়। ছায়া মজিদ বলছেন রাজনীতি শুধুমাত্র মেধাবী ছেলেদেরই করা উচিত। ইমনরা রাজনীতিতে না এলে দেশটা অন্ধকারে ডুবে যাবে। রাজনীতি তো দেশের দুটো পা, পা’দুটো সুস্থ না হয়ে গ্যাংগ্রিন আক্রান্ত হলে দেশ চলবে না।

ছায়া মজিদ সাহেব সরে যাবার পর মজিদ সাহেবের মনে হলো ইমনকে শান্তনা দেয়া দরকার। ছেলেটার সাথে অনেকদিন কথা বলেন না তিনি। ভেতর থেকে শার্টটা এনে বোতাম লাগাচ্ছেন এমন সময় শাদা রঙের একটা গাড়ি এসে থামে বাসার সামনে। গাড়ি থেকে ঘনীভূত জোছনা খণ্ডের মতো অপরূপ একটা মেয়ে নেমে দ্রুত পায়ে ইমনের ঘরে ঢুকে যায়। মজিদ সাহেব দোতলা থেকে আস্তে আস্তে নামছেন। ডান পাশে সুমনের ঘরে মৃদু শব্দে ‘সিনার লগে বাঁধি রাখুম তোয়ারে’ গানটি বাজছে। মজিদ সাহেবের মনে পড়ে মনকে এখনও থাপ্পরটা মারা হয়নি। ইমনের ঘরের সামনে গিয়েও ফিরে এলেন তিনি। তোয়ালে অভিজ্ঞতা দোতলায় ফিরিয়ে আনে তাকে।

মজিদ সাহেব দোতলায় দাঁড়িয়ে আছেন। ইমনের ঘর থেকে একটা কান্নার শব্দ আসছে। কি কারণে যেনো মজিদ সাহেবের চোখে পানি এসে যাচ্ছে। মজিদ সাহেব ইমনের জন্য প্রার্থনা করছেন। প্রার্থনার মধ্যেই ইমনের ঘরে ঢোকা মেয়েটির পরিচয় মনে পড়ে তার। কয়েক বছর আগে টিএসসিতে দেখা সুপ্রীতি, যার স্পর্শ থেকে বাঁচাবার জন্য তিনি ইমনকে এক সমুদ্র দূরে রেখেছিলেন। প্রেম সাত সমুদ্র দূরত্বে কিংবা এক যুগ সময়ের ব্যবধানে মরে যায় না। এমনকি তার ওপর বাঙলাদেশ দণ্ডবিধির ৩০২ ধারাও কার্যকর করা যায় না। মজিদ সাহেব সুপ্রীতির জন্যও দোয়া করছেন। এই মুহূর্তে পরাজয়ের ক্ষত সারাবার জন্য সুপ্রীতিকে খুব বেশি প্রয়োজন।

(সমাপ্ত)

 

আগের পর্বগুলোর লিংক :

নিছক গল্প-১

http://www.sonelablog.com/archives/3193

নিছক গল্প-২

http://www.sonelablog.com/archives/3229

নিছক গল্প-৩

http://www.sonelablog.com/archives/3286

নিছক গল্প-৪

http://www.sonelablog.com/archives/3370

নিছক গল্প-৫

http://www.sonelablog.com/archives/3443

নিছক গল্প-৬

http://www.sonelablog.com/archives/3557

 

 

 

0 Shares

১৫টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ