নিঃশব্দতার সুরে ছায়ানৃত্য

সিনথিয়া খোন্দকার ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৪, মঙ্গলবার, ১০:৪৫:২৬অপরাহ্ন বিবিধ ৩০ মন্তব্য

অফিসের কাজে সিলেট যেতে হচ্ছে রুনার। কালাম ছেলেটা বেশ কাজের। রুনা চৌধুরীর নতুন পিওন সে। বাসের মাঝামাঝি জানালার পাশের সিট নিয়েছে । জার্নিতে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থেকে গান শুনতে ভাল লাগে রুনার। সকাল বেলা ঢাকা থেকে সিলেট যেতে ডান পাশে খুব রোদ লাগে। কালাম বুঝেশুনে বাম পাশের সিট নিয়েছে... এসব ভাবতে ভাবতে বাইরের দৃশ্য থেকে চোখ ফিরিয়ে হঠাত নিজের হাতের দিকে তাকায় রুনা। হাতের পিঠে জালের মত অজস্র চিকন রেখাগুলো আগের চাইতে অনেক বেশি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বয়স হয়েছে তো।
মাস তিনেক আগে শারিরিক সমস্যার জন্য ডাক্তারের কাছে গিয়েছিল রুনা। ডাক্তার সব শুনে বলে দিয়েছে প্রতিমাসের নিয়ম করে শরীর খারাপ করার ঝামেলা থেকে চিরতরে মুক্তি পেয়েছে সে। আটচল্লিশ বছর বয়স্কা একজন মহিলার জন্য এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এই কথা নিশ্চিত হবার পর টানা আড়াই দিন কেঁদেছে রুনা।
কেমন যেন শক্তিহীন আর নিঃসম্বল লাগছিল হঠাত করে। বিয়ে, স্বামী- সন্তান, সংসার এগুলো কখনই ছিল না তার জীবনে। তাও কেন যে এত দমবন্ধ করা কষ্ট, সব শেষ হয়ে যাবার কষ্ট, পাঁজর ভেঙ্গেচুরে যাবার কষ্ট...
রুনার ভার্সিটি জীবনের রুমমেট আর সবচে কাছের বান্ধবী লুতফা। লুতফার বিয়ে হয়ে গেছিল ফাইনাল পরীক্ষার পরপরই। তারপরে সংসার- বাচ্চা কাচ্চা, স্বামীর ঘন ঘন বদলীর চাকরি এসবের কারনে নিজের আর কিছু করা হল না, পুরোদস্তুর হাউজ ওয়াইফ হয়েই জীবন পার করে দিল।
এত যত্নআত্তি করেও ধরে রাখতে পারলো না লোকটাকে। থ্রম্বোসিস না কি এক অসুখে হার্টের রক্তনালী বন্ধ হয়ে মারা গেল। আজ প্রায় তিন বছর লুতফা একা। মেয়ে বিয়ে দিয়েছে, মেয়ের ঘরে এক নাতনী আছে। লুতফার কাছে "সুখ" শব্দের অর্থ আগে ছিল স্বামী- সন্তানের খুশি, আর এখন যোগ হয়েছে নাতনীর চারটে দাত দেখানো ভুবনভোলানো হাসি।
দুই বান্ধবীর হোস্টেল জীবনে অবসর সময়ের কাজ ছিল ফিলোসফি কপচানো। এই বয়সেও তারা একে অপরের একাকীত্ব ভুলে থাকার অবলম্বন। একদিন নাটকীয়ভাবে দুই একাকী প্রৌঢ়া ঠিক করে কিছুদিনের জন্য তারা তাদের সবকিছু অদল বদল করে দেখবে- জীবন কোথায় কেমন। অন্যের জীবনের প্রতি মোহ হয়ত মানুষের সহজাত।
লুতফা ওঠে রুনার বাড়ীতে। সেখানে সব রকম সুযোগ সুবিধা আছে। রুনার ঘরে এসি, কম্পিউটার, আরো অনেক কিছু যা লুতফা নিজের জন্য কখনো ভাবতেই পারে না। এসব জিনিস থাকে তার ছেলে মেয়েদের ঘরে। অথচ এখানে রুনার জন্যই সব আয়োজন। নিজেকে বঞ্চিত করে হাড়ভাঙ্গা খাটুনি করে গেছে শুধু ছেলে মেয়ে দুটোকে মানুষ করার জন্য। সেই ত্যাগের স্বীকৃতি বা বিনিময় কিছুই সে পায় নি, শুধু ছেলে মেয়েরা ভাল আছে- এটাই সুখ।
লুতফাকে এসে কালাম জিগেস করে- "ম্যাডাম, দুপুরে কি খাবেন?"
চমকে উঠে লুতফা। "ম্যাডাম" সম্বোধনটা ঠিক তার সাথে যায় না। তাকে তো সবাই "ভাবী" ডাকে। আর লুতফা কি খাবে এটা কেমন প্রশ্ন? এমন প্রশ্ন কেউ কবে করেছিল কিনা মনে করতে পারে না সে। তার যে ইচ্ছা অনিচ্ছা বলতে কিছু আছে সে নিজেই ভুলে গেছিল।
কালামকে বিদেয় করে পাশের ঘরে ঢুকে লুতফা। এই ঘরটা সবসময় বন্ধ থাকে। গেস্ট রুম ও নয়। হয়তো রুনার স্টাডি হবে। আস্তে করে দরজায় ধাক্কা দিয়ে ভিতরে ঢুকে চোখ বুলায় একবার। একটা শেলফে কিছু বই আর টুকটাক জিনিস। ফটোফ্রেমে এক কোকড়া-চুল যুবকের ছবি। আরে! ওটাতো আনিস! যাকে ভালোবাসতো রুনা। লুতফা রুমের সবকিছু নেড়েচেড়ে দেখে নিশ্চিত হয়- এই ঘরটা ভর্তি শুধু আনিসের স্মৃতিতে। এমনকি স্টাডি ট্যুরে গিয়ে আনিসের কিনে দেয়া ঝিনুকের মালাটাও আছে এখনো।
আশ্চর্য! একবারো এই ঘরটার কথা লুতফাকে বলেনি? আনিস এখন আমেরিকায়। ওখানকার সিটিজেন এক মহিলাকে বিয়ে করে সেখানেই রয়ে গেছে। আর রুনা পাগলিটা তার স্মৃতি দিয়ে আস্ত একটা ঘর সাজিয়ে বসে আছে!
লুতফার চোখ ফেটে জন বের হয় অভিমানে। সে তো কখনো প্রবীরের স্মৃতি এভাবে আগলে রাখার সাহস করে নি। বরং মনে আসা মাত্রই ভুলে যাবার জন্য নিজের সাথে কত প্রতারণাই না করেছে! আনিসের মত প্রবীর তো কাপুরুষ ছিল না। লুতফাই এই অসম্ভব সম্পর্ককে প্রতিষ্ঠা করার সাহস যোগাতে না পেরে ধুম করে বিয়ে করেছে অন্যকে। আজকে হঠাত নিজেকে অনেক ছোট মনে হচ্ছে তার। অনেকগুলো বছর পরে এতদিন দাবিয়ে রাখা স্মৃতিগুলো দুর্বলতার সুযোগে চারদিক ভেঙ্গেচুরে আসতে লাগলো।

এই সময়গুলোতে লুতফার বাড়িতে আছে রুনা। তেল চপচপে পরোটা আর ডিম সকালের নাশতা। রুনার ভাল না লাগলেও লুতফার ছেলেটা খুব তৃপ্তি করে খেল। এজন্যই এত মুটিয়ে গেছে লুতফা- ভাবছে রুনা। সারা ঘরে লুতফা আর তার স্বামীর অনেক ছবি সাজানো। কি সুখী সুখী চাহনি তাদের! নাকি নিজের ভিতরের শুন্যতার কারনেই এমন লাগছে রুনার? লুতফার একটা বিয়ের ছবি আছে শোবার ঘরে।সেটার দিকে তাকিয়ে অজস্র বলিরেখার মালকিন রুনা ভাবে, কেমন দেখাতো আমাকে বউ সাজলে? তা আর জানা হলো না... অনেক ভালোবাসা দিয়েছিল যাকে একদিন, সে বিনিময়ে শুধু মুক্তিটুকুও দিল না।
ছেলেটা রেডি হয়ে বাইরে যাচ্ছে। একটু অসন্তুষ্টি তার চোখে মুখে। হয়তো মা নেই বলে অসুবিধা হচ্ছে। হঠাত নিজের অপারগতার জন্য লজ্জা লাগলো রুনার। সে চাইলেও এই ছেলেটার মায়ের ভূমিকা পালন করতে পারবে না। এমন একটা ছেলে, নিজের নাড়ি ছেঁড়া- শুধু এই ভাবনাটাই যে কত নির্ভরতার অনুভুতি দিতে পারে তা রুনা কিভাবে জানবে?
বিকেলে আসল লুতফার মেয়ে আর নাতনী। রুনা অনেক চেষ্টা করেও বাচ্চাটাকে কোলে রাখতে পারল না। কি করে পারবে? মা মারা যাবার পরে কেউ তো একটু মমতার স্পর্শ দেয়নি তাকে- সে তো বরফ শীতল। কতগুলো বছর তার হাতদুটি অন্য কোনও হাতের উষ্ণতা পায়নি সে হিসাব কে রাখে! এই মায়ার জাল বিছানো চারপাশে নিজেকে বড় অবাঞ্ছিত লাগতে শুরু করে রুনার।
লুতফাও বুঝতে পারে- নিজের জীবন থেকে বেরিয়ে এসে অন্যের জীবনের স্বাদ নিতে চাওয়া ছিল অনেক বড় ভুল। গায়ে পড়ে অযথা এতগুলো কষ্ট ডেকে আনা।
পরদিন নিজ নিজ জগতে ফিরে এল দুইজনেই। ফোনে কথা বলে দুজনেই জানালো খুব ভাল লেগেছে এই একদিনের বৈচিত্র্য। ফোন রাখার আগে রুনা বললোঃ
- তোর বাসায় গিয়ে অনেক দিন পর মনযোগ দিয়ে গান শুনলাম। একটা গান খুব ভাল লেগেছে। এইমাত্র ডাউনলোড করে আবার শুনলাম।
- কোন গানটা?
- নচিকেতা নামের এক শিল্পীর। গানের প্রথম লাইন- "দেখে যা, যা অনির্বাণ। কি সুখে রয়েছে প্রান..."

0 Shares

৩০টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ