মনে পড়ে ১৯৯৫ সালের ২৪ আগষ্ট ১৩ বছর বয়সী কিশোরী ইয়াসমিনের কথা।  হয়তবা কালের প্রবাহে অনেকেই পুলিশের সংঘবদ্ধ ধর্ষণ আর নির্মম নিষ্ঠুরভাবে হত্যার শিকার দিনাজপুরের কিশোরী ইয়াসমিনের কথা ভুলেই গেছেন। ভুলে যাওয়ারই কথা কেননা দেশে নারী শিশু ধর্ষণ নির্যাতন যৌন হয়রানী নিপীড়ন এবং খুনের সংখ্যা ক্রমশ বেড়েই চলেছে। প্রতিনিয়ত নতুন নতুন দুঃখজনক অনাকাঙ্ক্ষিত অনভিপ্রেত ভয়াবহ নারী ধর্ষণ আর খুনের ঘটনা ঘটছে।  একটা ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই আরেকটি ঘটনা ঘটছে যা পূর্বের ঘটনাকে ভুলিয়ে দিচ্ছে। যদিও দিনাজপুরের কিশোরী ইয়াসমিন দেশে নারী নির্যাতনের ভয়ংকর নিষ্ঠুর নির্মম মর্মন্তুদ ভয়বহতার পাশাপাশি সম্মিলিত প্রতিবাদের মূর্ত প্রতীক হয়ে আছে অদ্যাবধি। দুঃখজনকভাবে পুলিশের সংঘবদ্ধ ধর্ষণ ও হত্যার শিকার ইয়াসমিনকে (১৩) স্মরণ করে প্রতি বছর ২৪ আগষ্টের দিনটিকে ‘নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস’ হিসেবে পালন করা হয়। “১৯৯৫ সালের এই দিনে ঢাকা থেকে দিনাজপুরে বাড়ির উদ্দেশ্যে যাওয়া মেয়েটি ভোররাতে বাস থেকে নামে দিনাজপুর দশমাইল রোডে। বাড়ি পৌঁছে দেয়ার কথা বলে তাকে টহল পিকআপে তুলে নিয়ে ধর্ষণের পর হত্যা করেন তিন পুলিশ সদস্য। (সূত্রঃ প্র /আলো, ২৪ আগষ্ট’২১)। এমন পৈশাচিক বর্বরোচিত অমানবিক ঘটনায় এবং ইয়াসমিন হত্যার বিচারের দাবীতে দিনাজপুরসহ সারা দেশের মানুষ জনরোষে ফুঁসে ওঠে। ফলে ইয়াসমিনের পরিবার এই নির্মম জঘন্য হত্যাকাণ্ডের বিচার পায় ২০০৪ সালে দোষী তিন পুলিশ সদস্যের মৃত্যদন্ড কার্যকরের মাধ্যমে। আজ যদি ইয়াসমিন বেঁচে থাকতো তবে তাঁর বয়স হতো ৩৯ বছর। এক তথ্য থেকে জানা যায়, ২০১৮ সালের তুলনায় ২০২০ সালে ধর্ষণ বেড়েছে ১২২ শতাংশ। ২০১৮ সালে ৭৩২, ২০১৯ সালে ১ হাজার ৪১৩ এবং ২০২০ সালে ১ হাজার ৬২৭টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। অন্যদিকে বেসরকারি সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাব অনুসারে, গত তিন বছরে নারী নির্যাতনের মধ্যে অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে ধর্ষণ।

“দেশজুড়ে ধর্ষণবিরোধী বিক্ষোভের পর সরকার গত অক্টোবর’২০ মাসে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন সংশোধন করে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করে। এ বিষয়ে রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ জারি করা হয় ১৩ অক্টোবর’ ২০ অর্থাৎ ওই দিন থেকে নতুন সাজা কার্যকর হয়। আইন কঠোর করার ক্ষেত্রে সরকারের আশা ছিল, ধর্ষণের ঘটনা কমবে। বিশ্লেষণে দেখা যায়, আইন সংশোধনের পর এক মাসে যেসব ধর্ষণের ঘটনা বিভিন্ন সংবাদ পত্রে প্রকাশিত হয়েছে, তার বেশির ভাগ শিশু ও কিশোরী। এ সময় ভুক্তভোগী ১৮৩ জনের মধ্যে ১১৮টিই শিশু। শতকরা হিসাবে যা ৬৪ শতাংশ। উল্লেখ্য, এর মধ্যে ৮টি ছেলে শিশু। আলোচ্য এক মাসে ধর্ষণের শিকার হওয়া ৪৯ জনের বয়স ১৯ থেকে ৩০ বছর। বাকি ১৬ জনের বয়স এর চেয়ে বেশি। এ সময় সর্বোচ্চ ৫০ বছর বয়সী একজন ধর্ষণের শিকার হন। ( সূত্রঃ প্র/ আলো, ১৮ নভেম্বর’২০)। পাশাপাশি বাংলাদেশের থানাগুলোতে ২০১৬ থেকে ২০২০ সালের অক্টোবর মাস পর্যন্ত গত পাঁচ বছরে ২৬ হাজার ৬৯৫টি ধর্ষণের মামলা করা হয়েছে। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী-বাহিনী পুলিশের কতিপয় বিপথগামী সদস্যও ধর্ষণের মতো ন্যাক্কার এবং দুঃখজনক ঘটনায় জড়িয়ে পড়ছে। বেসরকারি সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের বরাতে জানা যায়, ২০১৮ সালে ৪ জন, ২০১৯ সালে ৩ জন, ২০২০ সালে ৪ জন এবং চলতি বছরে এখন পর্যন্ত ৪ জন পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগে মামলা হয়েছে। এমন কি এ বছরের মে মাসে ভারত থেকে দেশে ফেরা এক বাংলাদেশী নারী খুলনায় কোয়ারেন্টিনে থাকা অবস্থায় এক পুলিশ সদস্যের ধর্ষণের শিকার হন।

দৈনিক প্রথম আলোর প্রতিবেদক নাজনীন আখতারের সঙ্গে মুঠোফোনে আলাপের এক পর্যায়ে কিশোরী ইয়াসমিনের মা স্বগোতক্তি করে বলেন, “আচ্ছা, কেন নির্যাতন বন্ধ হয় না ! আসলে শুধু সভা করলে কাজ হবে না ! যারা অন্যায় করে, তাদের মনে ভয় ঢুকাতে হবে”। (সূত্রঃ প্র/ আলো, ২৪ আগষ্ট’২১)। আসলে ইয়াসমিনের মায়ের ক্ষোভের মধ্যেই ধর্ষণ বন্ধ না হওয়ার কারণ বিদ্যমান রয়েছে। আইনজীবি, আইনের শিক্ষক, সমাজ বিজ্ঞানী, মানবাধিকার কর্মী এবং ভুক্তভোগীদের মতে ফৌজাদারি বিচারপ্রক্রিয়ায় প্রধান বাঁধা হচ্ছে, পুলিশের পক্ষে সঙ্ঘটিত ঘটনার প্রমাণগুলো যথাযথভাবে সংগ্রহ করতে না পারা। পাশাপাশি সাক্ষীদের আর্থিক অসঙ্গতি, নিরাপত্তাহীনতা এবং আইনগত সুরক্ষা না থাকায় অনেকক্ষেত্রে মামলার প্রধান এবং অন্যান্য সাক্ষিদেরও আদালতে হাজির করা যায় না। পুলিশের তদন্ত কর্মকর্তাদের এ বিষয়ে যথাযথ প্রশিক্ষণ এবং লজিস্টিক সাপোর্টের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। পাশাপাশি ভিক্টিমরা অসহায় এবং হত দরিদ্র পরিবারের হওয়ায় টাকার কাছে, ক্ষমতা, বাহুবল ও প্রভাব প্রতিপত্তিশালীদের কাছে অসহায় আত্ম-সমর্পণ করে সমঝোতা করতে বাধ্য হয়। অথচ ধর্ষণের মতো শাস্তিযোগ্য অপরাধের ক্ষেত্রে মধ্যস্থতা, সালিশ বা মীমাংসাকে ফৌজদারি অপরাধ হিসাবে ঘোষণা করেছে মহামান্য হাইকোর্ট।  তাছাড়া ভিক্টিমদের অনেকেই ভাসমান বলে তাঁদের নির্দিষ্ট ঠিকানা থাকেনা। ফলশ্রুতিতে দীর্ঘদিন সাক্ষীর অনুপস্থিতির কারণে আসামির জামিন হয়ে যায় বা খালাস পেয়ে যায়। “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক তাসলিমা ইয়াসমিন প্রথম আলোকে বলেন, “আইন একধরনের সুরক্ষা বোধ তৈরি করলেও নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে তা খুব একটা প্রভাব ফেলছে না। ধর্ষণের ক্ষেত্রে সাজার হার মাত্র ৩-৪ শতাংশ। আইন প্রয়োগের জায়গাগুলোতে জবাবদিহির শৃঙ্খলা তৈরি করা যায়নি। আইনের কার্যকারিতা দৃশ্যমান হলেই নারী নির্যাতন কমবে”। (সূত্রঃ প্রথম আলো, ২৪ আগষ্ট’২১)। প্রকৃতপক্ষে নারীর প্রতি রাষ্ট্র এবং জনগণের সৌজন্যমূলক এবং শ্রদ্ধাশীল আচরণের সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে। সমাজে নারীর প্রতি অবহেলা অবজ্ঞা বিদ্বেষ ত্যাগ করে পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির অবশ্যই পরিবর্তন আনতে হবে। পাশাপাশি আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের মানবিকতা এবং নৈতিকতা বিবর্জিত না হয়ে আইনের সুষ্ঠু যথাযথ ও নির্মোহ প্রয়োগ এবং দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে বিচার এবং শাস্তির বিধান কার্যকর করতে হবে। সুখী সুন্দর দেশ বিনির্মাণের জন্য ধর্ষণের নির্মম নিষ্ঠুর ভয়ংকর ভয়াবহতা থেকে দেশের মা বোনদের ইজ্জৎ আভ্রু মান সম্মান রক্ষা করা এখন খুব জরুরি হয়ে উঠেছে।

ছবিঃ সংগৃহীত।

0 Shares

১১টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ