আজ ’বিশ্ব নারী দিবস’
সত্যিকার অর্থে বছরের ৩৬৫ দিনের এই একটি দিন আলাদাভাবে নারীর জন্য, আমি তা মনে করি না। মানুষ হিসাবে নর-নারী উভয়ের জন্য ৩৬৫ দিনই সমান। তবুও নির্দিষ্ট একটি দিনকে কেন্দ্র করে পৃথিবীর সকল নারীই তাঁদের অধিকারের আওয়াজ তুলেন। সে অধিকার সমানাধিকারের। সৃষ্টির শ্রেষ্ট জীব মানুষ। মানুষ হিসাবে নর এবং নারী উভয়েই সমান। তবে কেনো অধিকারের বেলায় নারী পিছিয়ে?

সৃষ্টির আদিকাল থেকেই পরিবারের, সমাজের নিয়ন্ত্রকের দায়িত্বে আছে পুরুষ। প্রকৃতি নর এবং নারীকে ভিন্ন ভিন্ন মাত্রা দিয়ে সৃষ্টি করেছে। পুরুষরা শক্তির প্রতীক আর নারী কোমলতার প্রতীক। দুয়ের সমন্বয়েই পরিবার, সমাজ, সংসার। কিন্তু দেখা যায় যে, শক্তির প্রতীক পুরুষেরা নিয়ন্ত্রকের ভুমিকায় থেকে শক্তির অপব্যবহার করে নারীকে সর্বদাই অবদমন করে রাখতে চায় আর এখানেই নারী আক্রান্ত।

অন্যদিকে প্রকৃতি নারীকে পরম মমতায় ভরপুর করে দিয়েছে বলেই হয়তো ‘মা’ রুপে নারী পৃথিবীর সবচেয়ে প্রিয় আশ্রয়স্থল। ’স্ত্রী’ বা ‘প্রেমিকা’ রুপে নারী পুরুষের প্রেরণার উৎস। ভিন্নতা যে নেই, তা নয় কিন্তু সামগ্রিক দৃষ্টিতে তাই প্রতিষ্ঠিত সত্য।

সেই আদিকাল থেকে এখনও নারী নিষ্পেষিত, বঞ্চিত, আক্রান্ত, অবহেলিত। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের নিয়ন্ত্রক যেহেতু শক্তিমত্তা পুরুষ, নিয়মগুলোর কারিগরও তাই তাঁরাই। ওদিকে আবার বেশিরভাগ নিয়মের সুফল ভোগকারীও কিন্তু পুরুষই এবং তাঁদের সে সুফল ভোগের যোগানদাতা হচ্ছে নারী। অধীনস্থ নারী বিনা বাক্য ব্যয়েই তা সম্পন্ন করে যায়। নাহ, সব সময়ই যে সে নাখোশ হয়ে তা করে তা কিন্তু নয়, কোমলতায় আচ্ছন্ন নারী অনেকটা খুশি মনেই তা করে। কিন্তু কোন কোন ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, নিয়মের নামে তাঁর উপর কিছু বিষয় চাপিয়েও দেয়া হয়। তাঁকে বলা হয় এটাই সমাজের নিয়ম।

পুরুষ! সে তাঁর নিজবাড়িতে যেমন মর্যাদাবান, শ্বশুড়বাড়িতেও তেমনি মর্যাদাবান। যেহেতু সে শক্তিমান। নিজবাড়িতে সে অন্নের যোগানদাতা আবার শ্বশুড়বাড়িতে তো আরো বেশি কদর তাঁর, কারন এ বাড়ির মেয়ের অন্নের যোগানদাতা যে সে! শুধু যোগানদাতাই নয়, সে মেয়ের দায় যে সে কাঁধে তুলে নিয়েছে।

কিন্তু নারী? তাঁর তো বাড়িই নেই!! তবুও শ্বশুড়বাড়িতে সে ঠাই পেয়েছে এই তো ঢের। জীবনের অর্ধেক সময় সে বাবার কাছে থাকে বলে, বাবার বাড়িটাই তাঁর নিজ বাড়ি। আবার বিয়ে হয়ে যখন বরের সাথে হাত ধরে ও বাড়িতে চলে যায়, ঠিক সেদিন থেকে আর সে বাবার বাড়িটিকে নিজের বাড়ি বলতে কোথায় যেনো একটু নিয়মের বেড়াজালে আটকে যায়। বলতে হয় বাপের বাড়ি। অন্যদিকে যে বাড়িতে যায় সেটিকে যদিও বলতে হয় নিজের বাড়ি কিন্তু তাই কি? পারে কি ভাবতে নিজের বাড়ি? ভাবে এটি তাঁর শ্বশুড়বাড়ি। কারন নিজের বাড়ি হলে সে স্বচ্ছন্দে চলাফেরা করতে পারতো। এমনি করে দীর্ঘকাল টানাপোড়েনে অতিবাহিত করার পর একসময় সে আস্তে আস্তে উপলব্দি করে এটাই হয়তো তাঁর নিজের বাড়ি। ভাবনা ওই পর্যন্তই। আবার এ ভাবনায়ও হঠাৎ ছন্দপতন ঘটতে পারে যদি কোন কারনে কাগজের সম্পর্ক স্বামীর সাথে তাঁর বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে। এ সবই হচ্ছে সমাজের নিয়ম। আর এ নিয়মের বেড়াজালে পড়ে নারীরাই কেবল ঘুরপাক খায়।

আবার দেখা যায় যে, সংসারে শক্তিমত্তা পুরুষের শক্তির মুল উৎস হচ্ছে অর্থ। যেহেতু সে অর্থের যোগানদাতা সেহেতু সংসারের একক কর্তৃত্বের নিয়ন্ত্রকও সে থাকতে চায়। অথচ নারী সারাদিন সংসারের জুতো সেলাই থেকে চন্ডিপাঠ যাবতীয় কাজের ঘানি টেনে গেলেও অর্থের যোগানে তাঁর কোন ভুমিকা না থাকার কারনে কর্তৃত্বের অংশীদার (দাবীদার নয়) সে হতে পারে না। তখনই আওয়াজ উঠে নারীর অর্থনৈতিক স্বাধীনতার। আর অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনই নারীকে সিদ্ধান্ত গ্রহনের ক্ষমতাও এনে দেয়। যদিও এই অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনেও তাঁকে পদেপদে বাধা পেতে হয়।

এ তো গেলো চার দেয়ালের ভিতরের কথা। সমাজের বাহিরের চিত্র!!

মানবসভ্যতা বিকাশের প্রয়োজনে প্রকৃতি নারীকে মাতৃত্ব ধারনের যে ক্ষমতা দিয়েছে, নারী-পুরুষের পার্থক্যটুকু শুধু সেই কারনেই এসেছে। একবার ভেবে দেখুন, মানবসভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সর্বংসহা নারীকে কতোটা যন্ত্রনা সহ্য করতে হয়। এই যন্ত্রনাতে পুরুষের কোন ভাগাভাগি নেই, এ কেবল নারীকেই পোহাতে হয়। এই একটা কারনেই পৃথিবীর অগ্রযাত্রার পথে বিশেষ ক্ষমতার দাবীদার নারী। এ জায়গায় যেমন নারী প্রকৃতিগত কারনে একাই দায় বহন করে চলেছে, ঠিক তেমনি প্রকৃতিগত কারনেই আবার কিছুকিছু ক্ষেত্রে নারীর জন্য পুরুষকে স্পেস ছেড়ে দিতে হয়। কিন্তু আমাদের সমাজ (পুরুষতান্ত্রিক প্রবনতা যেখানে বেশি কাজ করে)অনেক সময় সে সুযোগটুকুও নারীকে দিতে চায়না বা সহযোগিতাটুকু করতে চায় না।

এই যেমন ধরুন না, ঢাকা শহরে পথ চলতে গেলে আপনি পাবলিক বাসে উঠুন, দেখবেন সেখানে প্রতিবন্ধি, নারী ও শিশুর জন্য সংরক্ষিত আসন আছে ৯টি এবং সেখানে নির্দিষ্ট করে লিখাও থাকে। প্রতিবন্ধি এবং শিশু, এটি ঠিক আছে। কিন্তু নারী কেনো? নারী তো স্বাভাবিক মানুষ! এর বিপরীতে উত্তরটা যদি এমন হয় যে, গুটিকয় উশৃঙ্খল পুরুষই এর কারন। আপনি কি সেটা না মেনে পারবেন?

কিন্তু তারপরও কিছুকিছু পুরুষভাইদের এ নিয়ে ঘোর আপত্তি। হ্যাঁ তাই! আমিতো প্রতিদিন রাস্তায় বের হই। এই হরতালে আমাকে প্রতিদিনই পাবলিক বাসে চড়ে অফিস যেতে হয়। প্রায়ই পুরুষভাইদের থেকে শুনতে হয় নারীরা সমানাধিকারের জন্য গলা ফাটায় আর বাসে উঠলেই তাঁদের জন্য আলাদা বরাদ্দকৃত সীট ছেড়ে দিতে হয়।

আবার দেখা যায়, অনেকে রাগে বরাদ্দকৃত সীট ছাড়া যদি অন্য কোথাও কোন মেয়েকে বসতে দেখলো সেখানেও আপত্তি। আমি তখন একটু ঠাট্টা করেই বলি বরাদ্দকৃত সীটে তো লিখা আছে প্রতিবন্ধি, নারী ও শিশু বাকীগুলোতে তো লিখা নেই, বুঝবে কি করে? আমিও চাই কোন আলাদা ব্যবস্থা না থাকুক কিন্তু কিছু লোভী হাতের নোংরা কর্মকান্ড আমার সে চাওয়ার পথে বাধা সৃষ্টি করে।

কাজেই মানবসভ্যতা বিকাশের দায়িত্ব যেহেতু নারী একতরফাই বহন করে চলেছে (প্রকৃতি সে সন্মান এবং ক্ষমতা একমাত্র তাঁকেই দিয়েছে) আর বাদবাকী কর্মে তাঁকে সহযোগিতার দায়িত্ব কিন্তু পুরুষেরই গ্রহন করা উচিত, তবেই সমাজ আরও সুন্দর হবে। যদিও শহুরে সচেতন পরিবারগুলোতে এর প্র্যাকটিস অনেক আগে থেকেই আছে। তারপরও সমাজের সর্বস্তরে নারীর অধিকারকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। তাচ্ছিল্য বা অবদমন করে রাখা সুন্দর সমাজ গঠনে কাম্য নয়। আমরা মানুষ। সৃষ্টির শ্রেষ্ট জীব। আমাদের পৃথিবী হবে সুন্দর।

নর এবং নারী, দু’য়ে মিলেই বাড়ি(পৃথিবী)।

আশা: কামনা করি কোন একটা সময় নারীকে আর আলাদাভাবে ‘নারী দিবস’ পালনের মাধ্যমে অধিকার আদায়ের সংগ্রামে নামতে হবে না।

0 Shares

২৪টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ