গত ৩১শে জুলাই মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে হয়ে গেল তাজউদ্দিন আহমেদের ৯০তম জন্মবার্ষিকী। উনার জন্মতারিথ ২৩শে জুলাই, অনুষ্ঠানটি ঈদের কারনে যথাসময়ে করতে না পারায় ৩১শে জুলাই হলো। অনুষ্ঠানে তাজউদ্দিন আহমদের মেয়ে মাননীয় সাংসদ সিমিন হোসেন রিমি, ব্যারিষ্টার রফিকুল ইসলাম, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব সৈয়দ হাসান ইমাম বক্তব্য রাখেন। বক্তাগন সবাই তাজউদ্দিন আহমদকে অসাধারন মানুষ হিসাবে উপস্থাপন করেন। সাংসদ রিমি বলেন, উনি রাজনৈতিক ব্যক্তিগনের মতো উচ্চকন্ঠী বা চরম বাগ্নী ছিলেননা, ছিলেন সাধারন আর অত্যন্ত যূক্তিবাদী মানুষ। ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে অথর্নীতি বিভাগে অনার্স অধ্যয়নরত তাজউদ্দিন আহমেদ অবসরে মানুষের হালচিত্র দেখার জন্য ঢাকার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে বেড়াতেন এবং নিয়ম করে ডায়েরী লিখতেন। এই ডায়েরী এখন সাপ্তাহিক “সাপ্তাহিক” পত্রিকায় নিয়মিতভাবে তিনি প্রকাশ করছেন।
তাজউদ্দিন আহমেদ সম্পর্কে বেশ কিছু প্রসঙ্গের অবতারণা করেন তাঁর চেয়ে দশ বছরের কনিষ্ট সৈয়দ হাসান ইমাম। তিনি বলেন, প্রবাসী সরকার গঠনের পর ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তাজউদ্দিন আহমেদকে বলেন, আপনারা এমন একজনকে (বঙ্গবন্ধু) বাংলাদেশ সরকারের প্রধান (রাষ্ট্রপতি) করলেন, যিনি শত্রুর হাতে বন্দী। এখন উনি যদি শত্রুদের চাপে পড়ে আপোষ করেন, তখন বিপদে তো পড়বো আমি। নেতার উপর প্রচন্ড আস্থা ছিল তাজউদ্দিন আহমেদদের বলে তিনি বলেছিলেন, না উনি আমাদের সাথে আলোচনা না করে কোনদিনই কোনরকম আপোষ করবেননা শত্রুর সাথে, আপনি নিশ্চিত থাকুন। ৭ই মার্চ্চের ভাষনের পর হাসান ইমামরা কয়েকজন বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করতে গিয়েছিলেন তাঁর বাসায় এজন্য যে, ভাষনে তিনি বলেছিলেন, বেতার বন্দ্ব থাকবে, ঠিক কী পদ্ধতিতে তাঁরা বেতারের কাযর্ক্রম পরিচালনা করবেন, নাকি করবেনই না কোন কাযর্ক্রম পরিচালনা, সে-সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিতে। বঙ্গবন্ধু তাজউদ্দিন আহমেদকে ডাকেন এবং তাঁর সাথে কথা বলে উনাদেরকে নির্দেশনা দেন। রাজনীতির দীর্ঘজীবনে বঙ্গবন্ধু এভাবেই চলতেন সর্বদা।
মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় তাজউদ্দিন আহমেদ থাকতেন ১২ বাই ১৪ ফুট তাঁর (প্রধানমন্ত্রীর) অফিসঘরের পেছনে ছোট্ট একটি ঘরে। একটি মাত্র শার্ট ছিল তাঁর, সাপ্তাহিক ছুটির দিনে নিজ হাতে ধুতেন তিনি সেই শার্ট। অফিস ছাড়া কোথাও যেতেননা তিনি। শপথ ছিল, যতদিন দেশ স্বাধীন না হবে, সাংসারিক জীবন পালন করবেননা, যদিও তাঁর পরিবার থাকতেন কাছাকাছিই। তবুও ন্যুনতম দেখাও করতে যাননি কখনো। একসময় তাঁর একমাত্র ছেলের প্রচন্ড জ্বরের সময়ও তিনি দেখতে যেতে চাননি। তবে অনেকের পীড়াপিড়িতে শেষে মাত্র কয়েক মিনিটের জন্য তিনি ছেলেকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুধু চোখের দেখা দেখে আসেন এবং কিছু সান্ত্বনার কথা শুনিয়ে আসেন।
বঙ্গবন্ধুর প্রতি কতখানি বিশ্বস্ত ছিলেন, সেটা বোঝাতে সৈয়দ হাসান ইমাম আরো বলেন, বঙ্গবন্ধু জনাব তাজউদ্দিনকে মন্ত্রীসভা থেকে সরিয়ে দেয়ার পরের একসময় বঙ্গবন্ধুর বাবা মারা যান। আমি মৃত্যুর খবর শুনে বঙ্গবন্ধুর বাসায় গিয়ে দেখি, বাসার ছাদে বেশ কিছু মানুষ-পরিবেষ্টিত হয়ে বঙ্গবন্ধু বসে আছেন এবং তাঁদের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর সবচেয়ে কাছে বসে তাঁর হাত ধরে চুপচাপ বসে আছেন আর কেউ নন, স্বয়ং তাজউদ্দিন আহমেদ।

কোন তদবীর পছন্দ করতেননা তাজউদ্দিন আহমেদ। সৈয়দ হাসান ইমান বলেন, নাটকের লোক আমি। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেকার আমার কিছু ডকুমেন্টস্ সংগ্রহের জন্য আমি তাজউদ্দিন আহমেদের কাছে একটা লাইসেন্স পাওয়ার জন্য তদবীরে যাই। উনি বলেন, ‘আপনিও!’ আমি লজ্জা পাই এবং ফিরে আসি। নিজের অনেক আপনজনকে তিনি ফিরিয়ে দিয়েছেন। এরকমই ছিলেন তাজউদ্দিন।
মুক্তিযুদ্ধের সময় খন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বে একটা গোষ্টি দাবী তুলেছিল, তাজউদ্দিন আহমেদ চান শেখ মুজিব আর যাতে ফিরে না আসেন। এজন্য তিনি কোন আপোষের দিকে না গিয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন। একারনে যদি পাক সরকার শেখ মুজিবকে মেরে ফেলেন! তাজউদ্দিনের ব্যক্তিত্বের কাছে পেরে না উঠে সম্পূর্ন হিংসার বশবর্তী হয়ে এরকম দাবী উত্থাপণ করে মোশতাক এবং কিছু নেতা-কর্মী পেয়েও যায় এদাবীর পক্ষে। বিভিন্নভাবে এদাবী প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা করে মোশতাক তাজউদ্দিন আহমেদকে সরিয়ে দিতে চায়। কিন্তু কীভাবে ধোপে টিকবে এদাবী? তাজউদ্দিন আহমেদ তো কোন ষড়যন্ত্র করেননা, তিনি তো যোগ্য নেতার যোগ্য সহচর, নেতার ৭ই মার্চ্চের ভাষণেরই তো প্রতিফলন ঘটানোর কাজে নিয়োজিত তিনি। দৃঢ়ভাবে টিকে যান তিনি আর ষড়যন্ত্রকারী খন্দকার মোশতাক সমালোচিত হয় ভালোমতো।
প্রতিটি গণসংগ্রামের একজন নেতা থাকেন আর নেতার একজন ঘনিষ্ট আর বিশ্বস্ত সহযোগীর প্রয়োজন হয়। কারন নেতাকে অনেক চিন্তা, অনেক হিসাবনিকাশের মধ্য দিয়ে যেতে হয় প্রতিনিয়ত:। এমনকি মাথা ঠান্ডা রেখে দু’দন্ড চিন্তা করবেন, সে সময়ও থাকেনা নেতার অনেক সময়। তাই দলের স্বার্থে, দেশের স্বার্থে, সর্বোপরি নেতার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য থাকা চাই একজন যোগ্য সহচর। যিনি থাকবেন নেতার সাথে সাথে আর কাছাকাছি আর বাস্তবায়নের তদারকি করবেন নেতার দিক-নির্দেশণা। জনাব তাজউদ্দিন আহমদ ছিলেন সেরকম একজন নেতা যিনি বঙ্গবন্ধুর সাথে সাথে ছিলেন দীর্ঘদিন এবং দেশ ও দলের স্বার্থেই তাঁর সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন তদারকি করতেন সর্বদা।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান তাঁর জাতীয়তাবোধের মানসিকতায় আচ্ছন্ন হয়ে থাকতেন এবং তাঁর কথাবার্তায় সেরকম মানসিকতারই প্রতিফলন লক্ষনীয় থাকত সর্বদা। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ, একাত্তরের ৭ই মার্চ্চের তাঁর ভাষণ, যে ভাষণে সাড়ে সাতকোটি বাঙ্গালীর রক্ত চঞ্চল আর উত্তাল হয়ে উঠেছিল। রক্ত উত্তাল করা এরকমভাবে বাঙ্গালীকে আর কেউ কখনো ডাকেনি। সেই ডাককে পরিণতির দিকে নিয়ে যাওয়ার মতো কান্ডারীও যে একজন লাগে, আর তা ছিলেন জনাব তাজউদ্দিন আহমদ। একাত্তরের ২৫শে মার্চ্চ রাতে শেখ মুজিবরের বাড়ী থেকে বের হয়ে তিনি ভারত রওনা দেন এবং ভারতেও তিনি প্রবেশ করেননি তাঁকে সদ্য স্বাধীন ঘোষিত একটা দেশের নেতার মর্যাদা দিয়ে নিয়ে না যাওয়া পযর্ন্ত। আবার যুদ্ধশেষেও ভারতীয় কর্তৃপক্ষের “সুসম্পর্কের আহ্বানের” প্রতিউত্তরেও তিনি ‘স্বাধীন বাংলাদেশের মযার্দা ভারতের মতোই’, অন্য কথাচ্ছলে এটাও মনে করিয়ে দিতে ছাড়েননি তাঁদের।
আমাদের দেশের আরেক নক্ষত্র সরদার ফজলুল করিম বলেছিলেন, তোমরা জানোনা তাজউদ্দিন আহমেদ কতো বড় মাপের মানুষ।
আমি আমার এক লেখায় ভারতের প্রয়াত রাষ্ট্রপতি এপিজে আবদুল কালাম সম্পর্কে বলেছিলাম, আগামীতে কেউ হয়ত তাঁর গুনাবলীকে ছাড়িয়েও যেতে পারে। কিন্তু দ্বিধাহীনভাবে বলতে পারি, তাজউদ্দিন আহমেদের মধ্যে এমন কোন গুনাবলী নাই, যা ভবিষ্যতে কেউ অতিক্রম করে যেতে পারবে।
নব্বইতম জন্মবার্ষিকীতে অনেক শ্রদ্ধা জানাই বঙ্গবন্ধুর এই বিশ্বস্ত সহচর এবং অকৃত্রিম বন্ধু শ্রদ্ধেয় তাজউদ্দিন আহমেদকে।

0 Shares

১৬টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ