দ্বিতীয়জন

রিমি রুম্মান ৩ আগস্ট ২০১৬, বুধবার, ০১:৪০:৩৭অপরাহ্ন একান্ত অনুভূতি ২৩ মন্তব্য

আমার প্রথম সন্তান রিয়াসাত জন্মালো যখন, আমাদের উচ্ছ্বাসের সীমা নেই। তাঁর ছবি তোলার জন্যে ডিজিটাল ক্যামেরা কেনা হলো। স্বাস্থ্যকর আর সুস্বাদু "বেবী ফুড" খাওয়ানো হল। বছরখানেক কেনা পানি পান করানো হল। নিউইয়র্ক এবং বাংলাদেশে একাধিকবার জমজমাট জন্মদিন পালন করা হলো। বাড়িতে গানের আসর হলো রাতভর। যাকে নিয়ে এতোসব আয়োজন, সম্ভবত সে এসবের কিছুই বুঝেনি। কেননা এ নিয়ে তাঁর কোন উচ্ছ্বাস, অনুভূতি চোখে পড়েনি কখনো।  

...

দ্বিতীয়জন রিহান। জন্মের পর অযথা কান্নাকাটি নেই। হাত পা ছুঁড়ে হাসে। খাবার দিলে খায়, না দিলে ঝামেলা করে না। তাঁকে কেনা পানি খাওয়ানো হয়নি। পরিবারের অন্য সদস্যদের মতই রেগুলার খাবার খেয়ে বেড়ে উঠছে। তাঁর জন্ম জুলাই'তে, ওই সময়ে নিউইয়র্কের স্কুলগুলোতে গ্রীষ্মের ছুটি থাকে প্রতি বছর। বিধায় স্কুলে কখনোই কেউ তাঁকে জন্মদিন উইশ করেনি এবং করবেও না। কিন্তু প্রায়ই স্কুলে কারো না কারো "বার্থডে পার্টি" হয়। তখন বাড়ি ফিরে ভীষণ উচ্ছ্বাসে আমায় বলে, " আম্মু, তুমি জানো, টুমরো ইজ মাই বার্থডে ? "। রিহানের ধারনা, যেহেতু স্কুলে একে একে সবাইকে ঘিরে জন্মদিনের পার্টি হচ্ছে, নিশ্চয়ই আগামীকাল তাঁকে ঘিরে হবে। কিন্তু সেই আগামীকাল আর আসে না। জুনের শেষ সপ্তাহে স্কুলগুলোয় দু'মাসের জন্যে গ্রীষ্মের ছুটি শুরু হয়ে যায়।

ভীষণ সুখি সুখি উচ্ছলতায় সে যখন মাঝে মাঝেই আমায় বলে, " আম্মু, তুমি জানো, টুমরো ইজ মাই বার্থডে ?" আমরা সবাই হোহো করে হাসি। বলি, ধুর্‌ বোকা, প্রতিদিন কি কারো বার্থডে হয় নাকি ! এতে সে খানিক লজ্জা পায়। কিন্তু জন্মাবধি কেউ তো কখনো তাঁর চারিপাশ ঘিরে দাঁড়িয়ে একযোগে "হ্যাপি বার্থডে গান" গেয়ে উঠেনি। কিংবা হাততালি দিয়ে কেক কাটেনি। তাই হয়তোবা রিহানের শিশুমন প্রতিদিনই "বার্থডে বয়" হওয়ার স্বপ্ন দেখে।

এখন রিহান দিন, মাস বুঝে। অনেকদিন পর গত সপ্তাহে রাতে ঘুমোতে যাবার আগে আচ্‌মকা আমায় বলে, " আম্মু, তুমি জানো, টুমরো ইজ মাই বার্থডে ?" আমি চম্‌কে উঠি। তাই তো ! অতঃপর সে সারা বাড়ি হেঁটে হেঁটে তাঁর দাদু, ভাইয়া, চাচ্চু সকলকেই বলতে থাকে__ তুমি জানো, টুমরো ইজ মাই বার্থডে ? এবার আর আমরা হোহো করে হেসে উঠি না। তাঁকে জড়িয়ে ধরি। আগাম উইশ করি। ছোট্ট মানুষটি আকাশছোঁয়া আনন্দ নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুমন্ত রিহানকে দেখে আমার ভেতরের টুকরো টুকরো অনুভূতিগুলো নাড়া দিয়ে উঠে। কোন কারন ছাড়াই তাঁর মুখখানা বিষণ্ণ মনে হয়। বাতি নিভিয়ে ছোট্ট মানুষটির গালের সাথে গাল লাগিয়ে শুয়ে থাকি। বুকের ভেতরে এক চিন্‌চিনে সূক্ষ্ম ব্যথা বোধ করি। চার দেয়াল বেয়ে গাঢ় অন্ধকার নেমে আসে। সেই অন্ধকারে জানালার পর্দার ওপাশে লুকিয়ে থাকে ভীষণ এক নির্জনতা...

পরিবারের দ্বিতীয় সন্তান ভাব প্রকাশের অদ্ভুত এক ক্ষমতা দিয়ে সকলের মন জয় করে নেয় যদিও, কিন্তু তবুও তাঁরা প্রথম সন্তানের মত মনোযোগ পায় না। কি অবলীলায় এইসব ছোট ছোট অবহেলাগুলো আমাদের মনোযোগ এড়িয়ে যায় ! হায় ! ক'দিন বাদে রিহান হয়তো ভাববে, তাঁকে কেউ ভালোবাসে না। জীবনের অনেকটা সময় আমি নিজেও " আমাকে কেউ ভালোবাসে না " __ এমন একটি ধারনা নিয়ে বেড়ে উঠেছি। কেননা, আমি নিজেও যে "দ্বিতীয়জন" ছিলাম !

ভালোবাসায় ভালো থাকুক পরিবারের সকল "দ্বিতীয়জন"...

রিমি রুম্মান

নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র

0 Shares

২৩টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ