আমার এক নিকটাত্মীয়ের ঘটনা দিয়ে শুরু করা যাক। স্বামীর অকাল মৃত্যুর পর দুই সন্তান নিয়ে জীবন যুদ্ধে দিশেহারা এক মা। পুরোদস্তুর গৃহিণী থেকে জীবন ও জীবিকার তাগিদে কর্মজীবী নারী হয়ে উঠেন। স্বামীর অফিস সহকর্মীদের মানবিকতায় একই অফিসে কোনমতে চলার মত একটি চাকুরি জুটে। ছোট দুটি শিশু সন্তান নিয়ে বিধবা মায়ের যাপিত জীবন হয়ে উঠে খাড়া পাহাড়ে উঠার চেয়েও কঠিন। তবুও সন্তানদের চাহিদা মাফিক সব এনে দিতে তিনি দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। এ বিষয়ে তাঁর হৃদয় গহীন থেকে উঠে আসা আবেগপ্রবণ ভাষ্য, " বাবা বেঁচে নেই বলে কোন অপূর্ণতা যেন আমার সন্তানদের পেয়ে না বসে "। আমাদের দেশের বেশিরভাগ মায়েরা এমনই কোমল হৃদয়ের হয়ে থাকেন। কিন্তু যেখানে সংসার চালাতেই হিমসিম দশা, সেখানে বাড়তি খরচ যদিও বিলাসিতা, তবুও তিনি সাধ্যাতীত চেষ্টা করেন সন্তানদের চাহিদাগুলো চাহিবা মাত্র পূরণ করতে। ছেলেরা বড় হয়। বড়জন কলেজে ভর্তি হয়েছে সবে। উঠতি বয়স। এই বিদেশ বিভূঁইয়ে বসে একদিন খবর পাই, এতটুকুন ছেলেটিকে তাঁর মা বহু কষ্টে শিষ্টে একটি মটর সাইকেল কিনে দিয়েছেন। এ ছাড়া আর কী-ই বা করার ছিল ! ছোট ছোট চাওয়াগুলো পূর্ণ করতে গিয়ে একদিন বড় চাওয়া এড়াবার সাধ্য ছিল না। একটি মটর সাইকেল কিনে না দেয়ায় পরিবারটিতে যে অশান্তির সৃষ্টি হচ্ছিল, এ থেকে নিষ্কৃতির জন্যে কিনে দিতে বাধ্য হয়েছেন। এদিকে ছেলেটির বন্ধু জুটেছে বেশ। লেখাপড়া গোল্লায় গেল। অজানা আশংকায় বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠে আমার। কেননা, পত্রিকার পাতায় অহরহ দুর্ঘটনার খবর দেখতে পাই। দুর্ঘটনায় নিহত, আহতদের নাম পড়ি। সেখানে নিজের আপনজনের নাম না দেখে স্বার্থপরের মত স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলি। বছর না ঘুরতেই আমার আত্মীয় টিনএজ ছেলেটির ফেসবুক স্ট্যাটাসে শোকের ছায়া দেখতে পাই। তাঁর দুই বন্ধু মোটর সাইকেলটি চেয়ে নিয়ে গিয়েছিল এক বিয়ের দাওয়াতে। পথিমধ্যে দুর্ঘটনার মুখে পড়ে তাঁরা। মটর সাইকেল দুমড়ে মুচড়ে আরোহী বন্ধু দু'জনের রক্তাক্ত দেহ পড়ে থাকে পিচঢালা পথে। হাসপাতালে নেবার পথে একজনের মৃত্যু হয়। অন্যজন আশংকাজনক অবস্থায় অচেতন পড়ে ছিলেন। এরপরের খোঁজ আর নেয়ার সাহস হয়নি। আমার নিকটাত্মীয় ছেলেটির কিছু হয়নি যদিও, কিন্তু তাঁর বন্ধুর অস্বাভাবিক এই মৃত্যুর দায় কে নিবে ? কার ভুলে এই মৃত্যু হোল ? জীবন দেখবার আগেই ঝরে গেল প্রাণ ? সেই বাবা-মা-ই বা কি সান্ত্বনা নিয়ে বাকি জীবন বেঁচে থাকবেন ? এমনসব প্রশ্নবোধক চিহ্ন বুকের বা পাশে জমিয়ে রেখে কয়দিন তীব্র মনখারাপের সময় কেটেছে আমার এই দূরদেশে। আমাদের আশেপাশেই বাস্তব এমন উদাহরণ অহরহ দেখা যায় যা দেখে শেখা যায়, সচেতন হওয়া যায় অনায়াসে। আমার এখনো মনে আছে, আমার ছেলেটির বয়স যখন পাঁচ কী ছয়, অর্থাৎ আব্দার করার বয়স, আমি কখনোই ঘর ভর্তি খেলনা কিনে দেইনি তাঁকে। 'খেলার ছলে শেখা' যায় এমন কিছু খেলনা কিনে দিয়েছি বৈকি ! তবে বাইরে গেলে ১ ডলার বাজেট দিয়ে দিতাম। সে খেলনার দোকানে গেলে দোকানিকে পছন্দসই খেলনার দাম জিজ্ঞেস করতো, হাউ মাচ ইজ ইট ? এক ডলারে কী পছন্দসই খেলনা জুটে ! অতঃপর বাইরে ফুটপাতে পসরা সাজিয়ে বসা চায়নিজ দোকানির কাছ হতে পকিমন কার্ড নিয়ে বাড়ি ফিরত খুশি মনে। এবং এভাবেই সে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। কোন কিছু নিয়ে জেদ কিংবা অভিমানের সুযোগ নেই। তবে স্কুলে ভাল ফলাফল করলে কিছু আব্দার করেছে, যার মূল্য সর্বসাকুল্যে পাঁচ ডলার।

আমাদের পার্শ্ববর্তী পাড়ায় যতীন বাবু নামের একজন ডাক্তার ছিলেন।ছোটবেলায় আমি যখন আধো উচ্চারণে প্রথম চাঁদে যাওয়া মানুষদের নাম শোনাতাম, আব্বা অবাক হতেন এই ভেবে যে, এইসব কঠিন নাম কেমন করে শিখেছি। তখন যতীন কাকু বলতেন, তিন থেকে বারো বছর পর্যন্ত শিশুদের মস্তিষ্কের ধারন ক্ষমতা অর্থাৎ শেখার ক্ষমতা অনেক বেশি। ভালমন্দ শেখার, সুস্থ মানসিক গঠন গড়ে তুলবার উপযুক্ত সময়। এই সময়ে শিশুরা যা দেখে তা-ই শিখে। কথাগুলো পরবর্তীতে আরো বহুবার শুনেছি অগ্রজদের মুখে। একদিন নিজেই যখন মা হলাম, সেইসব কথা নিজের ভেতরে ধারন করার, সন্তানদের বেলায় মেনে চলার চেষ্টা করেছি। আমাদের স্বামী-স্ত্রী'র মাঝে যখন কোন বিষয়ে মতানৈক্য দেখা দেয়, তখন যুক্তি, পাল্টা যুক্তি দিয়ে একে অপরকে বোঝানোর চেষ্টা করি। আমার প্রথম সন্তানের বয়স যখন সাত কী আট ছিল। সে কম্পিউটারে গেইম খেলায় মগ্ন ছিল। আমার ধারনা, চুপচাপ, শান্ত এবং চাপা স্বভাবের ছেলেটি হয়তো আমাদের হৈচৈ এর দিকে মনোযোগ নেই। কিন্তু না, আমার ধারনাকে বারবারই ভুল প্রমান করে সে যখনই একলা পেয়েছে, জিজ্ঞেস করেছে, ' আম্মু, কি হয়েছিল তখন ?' বয়সের হিসেবে সে ছোট হতে পারে, কিন্তু আমি সবসময়ই তাঁকে সঠিক ঘটনা তুলে ধরেছি, ব্যাখ্যা করেছি। সব শুনে কখনো সে বলেছে, ' তোমার এটা বলা ঠিক হয়নি '। কখনো বা বাবাকে বলেছে,' আব্বুজি, তুমি এটা ফেয়ার করোনি, আম্মুকে সরি বল '। ওঁর বাবা কাঁচুমাচু হয়ে সরি বলেছে, কিংবা আমি বলেছি। ছোট বলে আমরা তাঁকে এড়িয়ে যাইনি। তাঁর মতামতকে গুরুত্বের সাথে গ্রহন করেছি। একবিংশ শতাব্দীতে এসে আমাদের এভাবেই যুগের সাথে তাল মিলিয়ে সন্তানদের গড়ে তুলতে হচ্ছে। অথচ গত শতাব্দীতে, অর্থাৎ আমাদের ছোটবেলায় কিন্তু এমনটি ভাবা যেত না। বড়রা কী বিষয়ে কথা বলছে তা জানার সাহস ছিল না। জানতে চাওয়াটাই বরং একরকম স্পর্ধা মনে করা হত। আবার আমাদের পাঠ্য পুস্তকের বাইরে অন্য কোন বই পড়াকে সময়ের অপচয় মনে করা হত। স্কুলের রুটিন পড়া, হোমওয়ার্ক, ধর্মীয় শিক্ষা এইসবই ছিল মুখ্য। এখন সময় পালটেছে। এই বিদেশ বিভূঁইয়ে আমাকে সন্তানদের জন্যে প্রতি দুই সপ্তাহ অন্তর এক গাদা বই নিয়ে আসতে হয় লাইব্রেরী থেকে। ফিকশন, নন-ফিকশন কিংবা অন্য বই। স্কুল হোমওয়ার্কের অংশ হিসেবে বাধ্যতামূলক প্রতিদিন ত্রিশ মিনিট বই পড়তেই হবে। ' যত পড়বে, ততো জানবে ' এই নিয়মে পড়া শেষে সব বই জমা দিয়ে আবার অন্য বই আনতে হচ্ছে।

এবার অন্য প্রসঙ্গ। এদেশে পরিচয় হওয়া এক বড় আপার বাসায় যেতাম অবসরে মাঝে মাঝে। আপার ছোট্ট মেয়েটি স্কুল থেকে এসে কিছু সময় গেইম খেলতে চাইত। কিন্তু আপার কড়া নিষেধ। কঠোর এক নিয়মের মধ্য দিয়ে তিনি তাঁর সন্তানকে বড় করছিলেন। সপ্তাহে শুধুমাত্র শনি, রবিবার গেইম খেলার জন্যে দুই ঘণ্টা সময় বরাদ্দ করেছেন। ছোট্ট মেয়েটি কী ভীষণ বাধ্য ! মায়ের প্রতিটি কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করত। আর তা দেখে আমি যারপরনাই বিস্মিত, মুগ্ধ। আপাকে জিজ্ঞেস করতাম, কেমন করে এতটুকু মেয়েটিকে এমন সুবোধ বানিয়েছেন ? আপা বললেন, মাইরের উপরে ওষুধ নাই, বুঝলা ? বেশ কার্যকর পদ্ধতি। মাঝে কয়েক বছর দেখা নেই। তিনি ঠিকানা বদলেছেন। সময় গড়িয়েছে অনেক। মেয়েটি ততদিনে কিশোরী। বহুদিন পর একদিন বৈকালিক চা নাস্তার সময়ে রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে গল্প করছিলাম। মেয়েটি স্কুল থেকে ফিরেছে সবে। আপা তাঁকে গোসল সেরে ফ্রেস হয়ে খেতে আসতে বললেন। মেয়েটি তখনই তা করতে চাইল না। মা-মেয়ে মৃদু বিবাদে জড়িয়ে পড়লো। এক পর্যায়ে মেয়েটি বেশ ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলে উঠল, ' এটা আমার জীবন, আমাকে বিরক্ত করবে না '। অতঃপর সে হনহন করে চলে গেল। বিকট শব্দে দরজা বন্ধের শব্দ পেলাম। ঘটনার আকস্মিকতায় আপা পাংশু মুখে আমায় বলল, আজকালকার পোলাপানগুলা বেয়াদব হইয়া যাইতাসে, বিদেশে আইস্যাই ভুল হইসে। আমার তাড়া আছে বলে চা টুকু ওয়ান টাইম কাপে নিয়ে বাইরে এসে দাঁড়াই। বাড়ির দিকে পা বাড়াই। তখন হেমন্তের পাতাঝরা দিন। শীতল বাতাসের সাথে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। বৃষ্টির জল আর গরম চা মিলেমিশে একাকার। শুকনো পাতা মাড়িয়ে বাড়ি ফিরবার সময় আমার কেবলই মনে হচ্ছিল, শিশুদের কড়া নিয়ম আর শাসনের মধ্য দিয়ে বড় করা উচিত নয়। এখনই কর, এখনই খাও, এখনই ঘুমাও, এমন করে নিজের কথায় উঠবস হয়ত ছোটবেলায় করানো যায়। কিন্তু বড় হতে হতে তাঁদের ভেতরে তীব্র জেদ এবং ক্ষোভের জন্ম হয়। তাঁরা বাবা-মা'র কাছ থেকে দূরে, একান্তে, নিজের মত করে থাকতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। এভাবে সন্তানের সাথে বাবা-মা'র একরকম দূরত্ব সৃষ্টি হয়। নিজেদের অজান্তেই দুর্লঙ্ঘ্য এক প্রাচীর সামনে এসে দাঁড়ায়। ' মাইরের উপরে ওষুধ নাই ' এই নীতিতে নয়, বরং সন্তানের সাথে বন্ধুত্বসুলভ আচরণই দৃঢ় ভালবাসার বন্ধনে আটকে রাখবার কার্যকর পদ্ধতি।

এবার আসি নিজের উঠতি বয়সী সন্তানের বিষয়ে। একবার নিউইয়র্ক সিটি ষ্টেট টেস্টের রেজাল্ট বের হল। ছেলেটি ইংরেজিতে আশানুরূপ ভাল করেনি। তাঁর ক্লাসের একমাত্র বাঙালি বন্ধুটি বেশ ভাল করল। বন্ধুর মায়ের উচ্ছ্বসিত কণ্ঠ ফোনের অন্যপ্রান্তে। কথা শেষে ছেলেকে বললাম, অমুক কিন্তু খুব ভাল ফলাফল করেছে। এতে সে ভীষণ আহত হল। অশ্রুসজল চোখে বলল, ' আম্মু, তুমি আমাকে অন্যের সাথে কম্পেয়ার করো না, এতে আমার খারাপ বোধ হয়'। আমি চমকে উঠলাম। সত্যিই তো ! আমি কি হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেললাম ? এমন করে কেন বলছি ? খুব দুঃখিত স্বরে বাপজানকে জড়িয়ে ধরে সরি বলেছি। পরবর্তীতে ভাল ফলাফল না করলেও শান্তনা দিয়ে বলেছি, চেষ্টা করলে পরেরবার নিশ্চয়ই ভাল করবে। আরেকবারের কথা। আমার এক বন্ধুর ছেলে স্কুলে বরাবরই রাইটিং এ ভাল করছিল। যেমন হাতের লেখা, তেমন লেখার ধরন। আমি মুগ্ধ। বছর শেষে সেইসব রাইটিং নোটবুক চেয়ে নিয়ে আসতাম ছেলেটির মায়ের কাছ থেকে। আমি বাংলাদেশী স্টাইলে আমার ছেলেকে বললাম, তুমি লেখাগুলো পড়ে দেখো, এতে তোমার ধারনা জন্মাবে কীভাবে লিখলে ভাল নাম্বার পাবে। সে বিরক্ত হয়ে বলল, ' আম্মু, আমি কাউকে কপি করবো না, আমি আমার মত করে লিখব। আমি লজ্জিত হয়ে বললাম, তুমি কাউকে কপি করার দরকার নেই, শুধুমাত্র লেখার ধরন সম্পর্কে ধারনা নিবে। সেদিন আমি বুঝে যাই এদেশে জন্ম এবং বেড়ে উঠা আমাদের সন্তানদের আত্মসম্মানবোধ প্রখর। এরপর থেকে সে যা-ই লিখে আমি পড়ি, মুগ্ধ হই, উৎসাহিত করি। শ্রেষ্ঠ বন্ধু হয়ে উঠি। বিশ্বাস করুন, পরবর্তী বছর থেকে সত্যিই সে ইংরেজিতে ভাল করতে শুরু করে। তাছাড়া সকলের মেধা তো আর এক নয়। প্রত্যেকেই তাঁর সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত মেধা অনুযায়ী এগিয়ে যাবে, সেটাই স্বাভাবিক।

ছেলেটি যেহেতু হাইস্কুলে পড়ছে, তাই পড়ার চাপ বেড়েছে আগের চেয়ে কয়েকগুণ। রাত বাড়ে, কিন্তু তাঁর পড়া শেষ হয় না। প্রায়শই বিরক্ত হয়ে বলি, পড়া বন্ধ করে ঘুমাতে যাও। একদিন সে রেগে গিয়ে উচ্চস্বরে জবাব দেয়, পড়া শেষ না হলে ঘুমাতে যাব না। আমি আঁতকে উঠি। স্বভাবজাত শান্ত ছেলেটির কী হয়েছে ? এমন করে তো কোনদিন কথা বলেনি ! সে কী বিগড়ে যাচ্ছে ? বেয়াদবি শিখেছে ? তীব্র মনখারাপ নিয়ে আমি রুমে ফিরে আসি। চিন্তিত হয়ে উঠি। চুপটি করে বিছানায় শুয়ে থাকি। ক্ষণিক বাদে সে নিজের ভুল বুঝতে পেরে এসে জড়িয়ে ধরে, আমায় মনঃকষ্ট দেবার জন্যে সরি বলে। আমিও কেন যেন বেশ আবেগপ্রবন হয়ে উঠি। বলি, " এদেশে এসে কলেজে ভর্তি হয়েও পড়া হয়নি আমার, তোমার জন্মের দুইমাস আগে সেই যে চাকুরি ছেড়েছি, আর ফিরে যাইনি, তোমাদের সময় দেবার জন্যে, দেখভাল করার জন্যে। তোমার বাবা একাকী অর্থ উপার্জন করছে, কঠোর পরিশ্রম করছে তোমাদের জন্যে। এদেশে আমরা প্রথম জেনারেশন বলে আমাদের চলার পথ মসৃণ নয়। আমাদের জীবন যুদ্ধ অনেক কঠিন। আমাদের সব কষ্ট তোমাদের জীবনকে সহজ এবং সুন্দর করার জন্যে।" বিশ্বাস করুন, এরপর সে আর কোনদিনই উচ্চস্বরে কথা বলেনি। টিনএজ বয়সে ছেলেমেয়েরা কথায় কথায় রেগে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। আতংকিত না হয়ে আদর ভালবাসার পাশাপাশি শাসন দিয়ে বুঝিয়ে বললে তাঁরা বেশ বুঝে, এবং ভালভাবেই বুঝে।

আমি মাঝে মাঝেই আমার টেন্‌থ গ্রেড পড়ুয়া ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করি, বড় হয়ে কোন পেশা বেছে নিবে ? গত তিন বছর ধরে তাঁর একই উত্তর, মেডিক্যাল লাইনে পড়বো। আমাদের দেশের বাবা-মা'রা হলে হয়তো খুশি হতেন খুব এমন উত্তরে। কিন্তু আমার কেন যেন মনে হয় এদেশে আরো অনেক পেশা আছে বেছে নেয়ার মত। এমন একটি বিষয় পছন্দ করার কারণ জানতে চাইলে প্রতিউত্তরে সে বলে, সাইয়েন্সের সাবজেক্ট তাঁর ভাল লাগে। যাক্‌ সামনে আরো অনেক সময় বাকি। সময়ের পরিক্রমায় হয়তো বা তাঁর এই চাওয়া পরিবর্তনও হতে পারে। তবে যে বিষয়েই পড়ুক না কেন, যে পেশাই বেছে নিক না কেন, তাঁর চাওয়াটাকেই প্রাধান্য দিতে চাই। নিজের ইচ্ছেকে চাপিয়ে দিতে চাই না কোনভাবেই। শুধু চাই, সে সপ্তাহের পাঁচদিন নয়টা/ পাঁচটা চাকুরি করুক। বাকিটা সময় তাঁর পরিবারকে দিক। ছুটির দিনগুলোতে সুন্দর সুন্দর জায়গায় পরিবার সহ ঘুরতে যাক্‌। সুখে শান্তিতে মানবিক মন নিয়ে নির্ভেজাল একটা জীবন যাপন করুক। কারো ক্ষতি না করুক। বেঁচে থাকার জন্যে তো আর অঢেল অর্থ, সম্পদের প্রয়োজন নেই। কিন্তু পরিবারের সাথে কাটানো সুন্দর মুহূর্তগুলো বিলিয়ন ডলার দিয়েও কী কেনা যাবে ? এই যে দেশ ছেড়ে এই বিদেশ বিভূঁইয়ে এলাম প্রায় দুই যুগ আগে, সন্তানদের সুন্দর ভবিষ্যতের জন্যে লড়ছি প্রতিনিয়ত, তবুও এই ভেবে সুখি হই যে, আমার অসাধারন সুন্দর শৈশব ছিল, বাবা-মা'র ভালবাসাময় একটি পরিবার ছিল। খুব করে চাই আমার সন্তানরাও এমন সুখময় অনুভূতি নিয়ে বেঁচে থাকুক আমার না থাকার কালে।

রিমি রুম্মান

নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র।

 

0 Shares

৯টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ