তোমার ক্লান্তি লাগে না ?

রিমি রুম্মান ২৬ মে ২০১৬, বৃহস্পতিবার, ০৯:৩৫:৫৯পূর্বাহ্ন একান্ত অনুভূতি ৯ মন্তব্য

কেন যেন সারা বছর সুস্থ থাকা আমি হুট করে কোন কারন ছাড়াই পরীক্ষার আগে অসুস্থ হয়ে যেতাম। শরীর পুড়ে যাওয়া জ্বর কিংবা হাত, পা বরফের মত শীতল। আম্মা বলতো, “সারা বছর ঠিকমত পড়স না, এখন পরীক্ষার আগে টেনশনে অসুস্থ হইয়া যাস্‌ !” এমন সব ভৎসনার মাঝে রাত জেগে চিলেকোঠার রুমে পড়তেই থাকি। আমার ক্লান্ত মা নির্ঘুম বসে থাকে সমস্ত রাত। ঝিমায়। কখনো বিদ্যুৎ চলে গেলে নিজে ঘেমে নেয়ে একাকার, তবুও আমায় হাতপাখা দিয়ে বাতাস করে। আমি কোনদিন জানতে চাইনি, ” মা, তোমার গরম লাগে না, কিংবা হাত ব্যথা করে না ?”

সকালে পরীক্ষার হলে যাবার আগে ছাদ থেকে তুলে আনা ফুল হাতে দিয়ে বলে, ফুল সাথে থাকলে মন ভাল থাকে। মন ভাল থাকলে, পরীক্ষা ভাল হয়। আমি সেই ফুল জ্যামিতিবক্সে ভরে পরীক্ষার হলে যাই। মন ভাল হয় কিনা, জানিনা। শুধু জানি, পরীক্ষার সময়টুকুতে সেই চ্যাপ্টা হয়ে থাকা ফুল বেঞ্চির এক কোনায় পরে থাকে অবহেলায়। প্রথমপত্র পরীক্ষা শেষে টিফিন আওয়ারে আম্মা অফিস থেকে ছুটে আসে খাবার নিয়ে। আমি নোটবইয়ে চোখ বুলাই রুদ্ধশ্বাসে। আম্মা খাবার মুখে পুরে দেয়। দিতেই থাকে। দোয়া দরূদ পড়ে। মাথায় ফুঁ দেয়। পরীক্ষা শেষে ক’দিন বাদেই নতুন উদ্দামে আবারো ছুটে চলা। কোন টিচারের কাছে কোন বিষয়গুলো প্রাইভেট পড়বো খোঁজ নিতে থাকে। সারাদিন অফিস শেষে সন্ধ্যায় নিজেই নোট লিখে দেয়। আমি বিনা কষ্টে সেই রেডি করা নোট পড়ি। পরীক্ষা দেই। কোনদিন জিজ্ঞেস করিনি, ” মা, তোমার ক্লান্তি লাগে না, কষ্ট হয় না ?”

জ্বরের সময়টাতে সেবা শুশ্রূষার মাঝেও নতুন জামা কিনে দিয়ে বলতো, নতুন জামা পড়লে মন ভাল হয়। মন ভাল থাকলে শরীর সুস্থ হয়ে উঠে তাড়াতাড়ি। আমার মন ভাল হতো। সত্যিই অনেক ভাল বোধ হতো। কোনদিন বলিনি, “মা, তোমারও তো জ্বর হয়, তুমি নতুন শাড়ি কিনো না কেন ?”

তিন ভাইবোনকে নিয়ে ঈদের কেনাকাটায় যেতো যখন, আমার দামী জামাটির দিকেই নজর লেগে থাকতো। আম্মা সরাসরি না বলতো না। শুধু বলতো, আচ্ছা আরেকটু ঘুরে দেখি। সাগরিকা কিংবা বিউটি স্টোরে নিয়ে গিয়ে দোকানদারকে নিচুস্বরে কিছু বলতো। অতঃপর ওঁরা যা দেখাতো আমার পছন্দ হতোনা কিছুতেই। আমার যে সেই নজর লেগে থাকা দামী জামাটাই চাই। মা মলিন মুখে শেষে তা-ই কিনে দিতেন। কোনদিন মনে হয়নি, এই জামাটি কিনে দিতে গিয়ে কতদিক দিয়ে কত বাজেট কাটছাঁট করতে হয়েছে !

যখন বড় হই, বিদেশে এসে জব করি। নিজের রোজগার। মা’কে কত কি দিতে মন চায় ! যা কিছু একসময় তাঁর সখ ছিল, সব স-ব। সোনার চুড়ি, সুন্দর সুন্দর শাড়ি। কিনেও দেই। আমার চিরকালের সৌখিন আম্মা লাজুক চোখে তাকায়। বলে, ” এইসবের কি দরকার ছিল, আমার এখন এইসব পরার বয়স আছে নাকি ?” অতঃপর একসময় সকলের অগোচরে চুড়িগুলো হাতে দিয়ে দেখে। শাড়ি গায়ের সাথে জড়িয়ে দেখে। যেন পৃথিবীর সবচাইতে দামী জিনিষটাই এনে দিয়েছি ! আমার কোনদিন বলা হয়ে উঠেনি, “মা, ভালোবাসা দিতে দিতে তো নিঃস্ব হয়ে গেলা, সে তুলনায় তো তোমার জন্য কিছুই করতে পারিনি।”

চারটি বছর কেটে গেলো মা ছাড়া এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকা আমার।

আরেকটিবার আমার মায়ের সন্তান হয়ে জন্মাবার তীব্র ইচ্ছে জাগে শুধু এই বলতে না পারা কথাগুলো বলবার জন্যে।

আমরা প্রায় সকলেই এমন। বেঁচে থাকাকালীন সময়ে এই বিষয়গুলোকে তুচ্ছ ভেবে এড়িয়ে যাই, তাই না ?

আমার এই লেখাটি পড়ে যদি কোন সন্তানের মনের কোনে এতটুকু বোধ জন্মে যে___ ” তাই তো !”

যদি কোন সন্তান তাঁর মা’কে জড়িয়ে ধরে বলে, ” মাগো, তোমার কষ্ট হয় না, ক্লান্তি লাগে না ?”__ তবেই আমার লেখার সার্থকতা।

রিমি রুম্মান

নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র

0 Shares

৯টি মন্তব্য

  • জিসান শা ইকরাম

    মা এরা এমনই, আপনার লেখা পড়ে কতকিছু মনে পরে গেলো।
    দুই দিন পূর্বে দেশ থেকে অল্প কয়েকদিনের জন্য বিদায় নিচ্ছি আম্মার কাছ থেকে,
    আমার মাথা বুকে টেনে নিয়ে কতক্ষন দোয়া কালাম পড়ে মাথায় ফু দিয়ে দিলেন 🙂
    মা নেই এই ভাবনা মনেই আসেনা আমার।

    আপনিও এমন মা হোন যেন আপনার সন্তানেরা এমন করে লিখতে পারে আপনার সম্পর্কে এই দোয়া করি।

  • নীলাঞ্জনা নীলা

    রিমি আপু কতো কিছু যে মিলে গেলো তোমার জীবনের সাথে আমার। আমিও পরীক্ষার ঠিক আগে এমন করতাম। পরীক্ষা দিতে যাবার সময় মামনি মুখে তুলে খাইয়ে দিতো। তবে আমার মামনি আছে বেঁচে এটুকুই যা স্বস্তির-শান্তির। যদিও অনেক কষ্ট শেয়ার করিনা, অভিনয় করে বলি কোনো ব্যথা নেই, এখন সম্পূর্ণ সুস্থ। ভালো আছি। মামনিকে বলেছিলাম আমার প্রথম বেতন দিয়ে তোমাকে সোনার চুড়ি বানিয়ে দেবো। যে বেতন পেতাম, তা দিয়ে পারিনি। তখন ব্রোঞ্জের উপর সোনা দিয়ে চুড়ি বানিয়ে দিয়েছিলাম। তবে জাপান এসে চাকরীর বেতন দিয়ে হীরের পেন্ডেন্ট দিয়েছিলাম সোনার চেইনের সাথে। চেয়ে বলে “তোর কষ্টের টাকা, আমার জন্যে কেন? তোর শাশুড়িকে দিয়েছিস তাতেই আমি খুশী।” এই না হলে মা। আলাদা করিনি দুই মাকেই একই জিনিস দিয়েছি। তবে মা তো মা-ই। একটা কথা আমার বড়ো মাসী বলেছিলো আমাদের বড়ো বৌদিকে। “মায়ের বিকল্প কেউ হয়না। তুমি আমায় অনেক ভালোবাসো, জানি আমি। কিন্তু জন্মদাত্রী মায়ের সাথে আর কারুর তুলনা করতে যেওনা কখনো। আমি তোমার কেয়ার করি সব ঠিক আছে, তবে তোমার মায়ের মতো নয়।”

    আপু ভালো থেকো। -{@

  • ইনজা

    এখনো যখন জ্বরে পুড়তে থাকি তখন আম্মাকে ফোন দিই “আম্মা আসেন না, আমার জ্বর”, অনুভব করি মা পাশে থাকলে শান্তিই পাবো। আপনার মনের অবস্থা বুঝতে পারি আপু, মার জন্য আল্লাহর দরবারে দোয়া করছি যেন উনি মাকে জান্নাতুল ফেরদৌস দান করেন, আমীন।

  • ইকবাল কবীর

    ভাল থাকুক পৃথিবীর সব মা। অনেক দিন পর দেশে এসেছি, মায়ের পাশে পাশে থাকি সবসময়, সবাই বলে কিরে বিয়ে করিস নি অথচ ঘর থেকে বাইরে আসিস না, বিয়ে করলে কি করবি!!! ওদেরকে আমি বুঝাতে পারব না, প্রবাসে মাকে আমরা কত মিস করি। দেশে আসি কয়েকদিনের জন্য, এই সময়টা মায়ের পাশেই থাকতে ভালো লাগে।

  • মারজানা ফেরদৌস রুবা

    উফফ! মাআআআআআ……..
    সত্যি এই লিখা পড়ে যদি কেউ একবারের জন্যও মায়ের দিকে তাকায় তো সার্থক হবে আপনার লিখা। সন্তানকে সুখী দেখতে গিয়ে মায়েরা যে কতো স্যাক্রিফাইস করে!!

    মা’র বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করছি।

  • লীলাবতী

    আপু, লেখা পড়ে কান্না আসলো আমার। আমরা কত কিছু ভাবি মায়ের কথা। আপনার মত গুছিয়ে কতজনে লিখতে পারি। মা শব্দটাই তো মায়ায় জড়ানো। আপনার মা বেহেশত লাভ করুন।

  • মৌনতা রিতু

    লেখা পড়ে চোখে পানি ভরে উঠল। আচ্ছা মায়েরা এমন কেন ?
    আমার মা, বাসায় গেলেই শুধু কারনে অকারনেই মা বলে ডেকে উঠি।
    মায়ের আশিরবাদের ফুল সব সময় জ্যামিতি বক্সে না থাকলেও মনে থেকেই যায়।
    ভাল থাকুন। মা যেখানে থাকুন ভাল থাকুক। থাকবেও, কারন সে যে মা।

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ