ডানাহীন এক নীল পরী: (ছোট গল্প)

মামুন ২৯ নভেম্বর ২০১৪, শনিবার, ০২:২৫:১৭অপরাহ্ন গল্প ১৪ মন্তব্য

" ... ভেবেছিলাম মধ্যাহ্ন নিদ্রায় কিংবা প্রতিটি মধ্য নিশীথে

তোমার শরীরের শিরায় শিরায় তুলে দেবো

বৈশাখী বৃষ্টির মতো তৃপ্তির এক সুখানুভূতি,

ভেঙ্গে যাবে যামিনীর নীরাবতা তোমার সুখের উল্লাসে,

পরিতৃপ্তির আত্মচিৎকার ভেসে বেড়াবে

গভীর রজনীর হিমেল বাতাসে।..."

কবি জেবু নজরুল ইসলামের কবিতাটির এই লাইনগুলো ওকে এতোটা নিবিঢ় ভাবে টানবে, ভেবেছিলো কি? পুরো কবিতাটি কয়েকবার পড়া হয়ে গেছে। মাঝের এই পংক্তিগুলোতে ওর নিজের জীবনের কি যেন মিশে আছে।

কি সেটা?

থেকে থেকে ফিরে আসা এক অতৃপ্তি? হিরন্ময় অতীত যাকে খুব সন্তর্পনে বুকের মাঝে মা পাখির মতো আগলে রেখেছে। মন খারাপের প্রচন্ড কোনো নির্জন অপরাহ্নে বা অস্তরাগে ভানু বিসর্জনের মায়াবী সাঁঝের মুহুর্তগুলোতে এই অতৃপ্তি ওকে নাড়া দিয়ে যায়!

কিছু স্মৃতি... একজনের চলে যাওয়া... আর একাকীত্বের মৌন বেলাভূমিতে সোনালী স্মৃতির পাখিরা ওকে কাঁদায়।

নিজের বারান্দায় এই মুহুর্তে মৌনতার শিকগুলোকে স্পর্শ করে বাইরের একটানা টিপটিপ বৃষ্টির শব্দ আর ইতঃস্তত ছিটকে আসা জলকণার স্পর্শ মেখে দাঁড়িয়ে আছে নিলু... এক নীল পরী! নিজের বুকের ভিতরের অবদমিত কান্নাগুলো বৃষ্টির ফোটা হয়ে ঝরে পড়ছে। তাতে প্রকৃতি শান্ত হলেও নিলুর তপ্ত দেহ ক্রমেই উত্তপ্ত হচ্ছে। প্রচন্ড এক শীতের রাতে হঠাৎ করে থার্মোমিটারের পারদের উর্ধব গতি লাভের মতো এই বর্ষণমুখর মধ্যাহ্নে নির্জন বাসা বাড়িটিতে নিলু ঘুম ভেঙ্গে একাকী স্মৃতির উষ্ণতর সোপানে আরোহন করতে চলেছে।

শরীরটা ক'দিন ধরে ভালো যাচ্ছে না। অফিস থেকে ছুটি নিয়েছে। কমপ্লিট রেস্ট নিবে ভেবেছিল। কিন্তু জীবন থেকে যতদিন ছুটি না নেয়া যাচ্ছে, কমপ্লিট রেস্ট আর হয়েছে! অবসন্ন মুহুর্তগুলোতে স্মৃতির পোকারা ওকে জাপ্টে ধরে। ঘুম ভেঙ্গে উঠে বিমুঢ় হয়ে যায়। এখন বারান্দায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টি ভেজা এই মধ্যাহ্নকে পার হয়ে নিলু স্মৃতির টানেল দিয়ে কিছুদিন আগে ফিরে যায়... ...

অফিস থেকে ফেরার পথে একই রিক্সায় ওরা দুজন। পথে ফুচকার দোকান দেখে থামে। নি্লুর মন খারাপের সেই দিনগুলোতে কীভাবে যেন জহির ওর বেশ কাছে এসে গেছে। একই সাথে চাকরি করার সুবাদে অনেক আগে থেকেই ওদের পরিচয়। কিন্তু সেভাবে কখনোই নিলু জহিরকে দেখেনি। কিংবা ফীল করেনি। তখন অনুভূতিগুলো যে অন্য কাউকে কেন্দ্র করে ছিল! কি প্রচন্ড এক অনুভূতির নিগড়ে ভেসে বেড়ানো... আর স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণের জন্য উন্মুখ হয়ে থাকা! যার জন্য এই উন্মুখতা সেই মানুষটি কিনা নিলুর সমস্ত ভালোবাসাকে নিঙরে নিয়ে পরিতৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে আশ্চর্যজনক নীরবতায় ওকে একা ফেলে চলে গেলো!!

ওকে একা ফেলে...একবারও পিছু ফিরে দেখলো না সে!

কীভাবে পারলো?

কীভাবে পারে ওরা!!

প্রচন্ড এক মানসিক আঘাত নিলুকে বিপর্যস্ত করে তুলল। পরিচিত সবাই ওর ব্যাপারটা জেনে যায়... কারো চোখে সহানুভূতি... কেউ ইঙ্গিতপুর্ণ কুৎসিত ইশারার দৃষ্টি নিয়ে এলো... কাছের মানুষেরা ওকে কিছু না বলে 'সময়' দিয়ে গেলো। ঐ সময়টিতে ঠিক যেটার দরকার ছিল নিলুর ভীষণভাবে।

তখনই জহির সহকর্মী থেকে বন্ধু হতে হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। একজনের প্রত্যাখানের বেদনা বুকে নিয়ে আর এক জনের বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে নিঃস্বার্থ কাছে আসাকে প্রথমে নিলুর কেমন যেন লেগেছিল। ওর চোখে তখন সকল পুরুষই সব নিয়ে পিছু ফিরে না চাওয়া লোকটির মতো কেবলই একজন 'পুরুষ'। সেখান থেকে জহির একজন বন্ধুতে পরিণত হতে পেরেছে শুধুমাত্র একজন সত্যিকারের হৃদয়বান ভালো মানুষ বলেই।

সেদিন ফুচকার দোকান থেকে ওরা যখন বের হলো, আশেপাশে কোনো খালি রিক্সা পেলো না। নিলু হাঁটতে চাইলো। প্রশস্ত পেভমেন্ট ধরে ওরা দু'জন অন্য আরো ঘরে ফেরা মানুষদেরকে সাথে নিয়ে হেঁটে চলে। সন্ধ্যা নেমে এসেছে। স্ট্রীট ল্যাম্পের মৃদু সোডিয়াম লাইটের আলোয় পরিচিত জহিরকে কেমন অপরিচিত লাগে নিলুর। আকাশে গোল থালার মতো চাঁদ তাঁর মায়াবী আলো অকৃপণভাবে বিলিয়ে ওদের পিছু নিয়েছে। সেই আলোয় নিলু ওর চোখের ভিতরের অন্য এক আলোয় ক্ষণিকের জন্য জ্বলে উঠেই আবার নিভে গেলো। সেই অতি সামান্য সময়ে জহিরকে সে 'সেই মানুষটি' ভেবেছিলো। এই পথেই তো নিলুর হাত ধরে সেই হৃদয়হীন লোকটি কাটিয়েছিল অসংখ্য মুহুর্ত!

অনেকক্ষণ হেঁটে হেঁটে ক্লান্ত নিলু।

সামনে একটি যাত্রী ছাউনি। সেখানে একটু বিশ্রাম নিতে চাইলো। সিমেন্টের শান বাঁধানো বেঞ্চে জহিরকে পাশে নিয়ে বসতেই অনাহুতের মতো মেঘ বালিকাদের কান্না শুরু হল। প্রথমে ঝিরি ঝিরি... পরক্ষণেই ঝুম বৃষ্টি।

জহির বেশ ক'দিন ধরে নিলুকে ওর মনের কিছু না বলা কথা বলতে চাইছে। কিন্তু সেরকম পরিবেশ না পাওয়াতে আর কিছুটা মনের জোরের অভাবে বলা হয়ে উঠেনি। আজ কোনোরকম ইতস্তত না করে ওর মনের অব্যক্ত কথা নিলুকে বলেই ফেললো।

অনেকক্ষণ দু'জনে চুপ থাকে। জহির মাথা নীচু করে নিলুর উত্তরের প্রত্যাশায় উন্মুখ! নিলু নীরবতা ভেঙ্গে যখন কথা বলে- জহিরের মনে হয় এক সুদূরতম গহীন উপত্যকার চূড়ায় বসে নিলু কথা বলছে। বিষন্ন... নিরাবেগ কন্ঠে নিলু বলে চলেছে, ' আমাকে যেভাবে তুমি দেখছ, আসলেই কি আমি তেমন? হাতি যে দাঁত দেখায় সেটা দিয়ে সে খায় না। তোমার চোখে আমি কেমন তা জানি না। কিন্তু আমার ভিতরের আমিকে আমার চেয়ে ভালো আর কে জানে?'

একটু থামে নিলু। মাথা নীচু করে থাকা জহিরকে একপলক দেখে... তারপর সামনের দিকে তাকায়। ইলেক্ট্রিক আলোয় পড়ন্ত বৃষ্টিকণাকে কেমন জান্তব মনে হয়। সে বলে, ' আমাকে কেউ একজন নীল পরী বলে ডেকেছিল। আমি চোখ বুজে উড়তে উড়তে এক এক করে সাতটি আসমান পার হই... চোখ খুলে দেখি, কী ভীষণ একা! আমার চারপাশে কেউ নেই... নেই... নেই... কেউ নেই! কষ্টের আগুনে আমার ডানা পুড়ে গেলো...আমি ধপ করে পড়ে গেলাম সাত আসমানের উপর থেকে... আমি চুর চুর হয়ে গেছি! যা একবার ভেঙ্গে যায় তা আর জোড়া লাগে না কখনো। সে ফুলদানিই হোক বা মানুষের মনই হোক।'

নিলু থামতেই জহির মাথা উঁচু করে। নিলুর দিকে তাকায়। ওর চোখের ভাষা বোঝার চেষ্টা করে। এরপর ধীরে ধীরে বলে, ' কি পরিমাণ দুঃখকে সাথী করেছ যে, সুখ কোনোভাবেই তোমার হৃদয়ের বার্লিন প্রাচীরকে ডিঙ্গাতে পারছে না? আসল বার্লিন দেয়াল তো সেই কবে ভেঙ্গে দেয়া হয়েছে। সেই প্রাচীরের মতোই তোমার কষ্টগুলোকে ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিচ্ছ না কেন? একবার তোমার ডানা পুড়েছে বলে এখন কল্পনাতেও উড়তে ভয় পাচ্ছ? একজনের নীল পরী ডাক শুনে কাছে গিয়ে শুন্যতাকে ফিরে পেয়েছ বলে, এখন অন্য কারো ডাক শোনার সময় একেবারে কানই বন্ধ করে রাখতে হবে?'

জহিরের চোখে চেয়ে নিলু উত্তর দেয়, ' আমার কাছে কল্পনা আলাদা নয়। সেটা সত্যের অন্য রূপ মাত্র। আমি যা করি মন থেকেই করি। এখন আমার মনই নেই... তাই সত্য নেই- কল্পনাও নেই।'

নিলুর কথাগুলো মন দিয়ে অনুভব করে জহির। একটু ব্যথিতও হয়। তবে মুখে হাসি এনে বলে, ' মন ছাড়া মানুষ... হৃদয় ছাড়া নারী- এ কি সম্ভব? এখন আবার আমাকে বলো না যে, তুমি নারীই নও। দেহহীন ভালোবাসা সম্ভব হলেও হৃদয়হীন ভালোবাসা কীভাবে সম্ভব বলোতো?'

নিলু কিছুই বলে না। রাস্তার উপর বৃষ্টির ফোটাগুলো প্রচন্ড গতিতে এসে কীভাবে ফেটে যাচ্ছে, এক দৃষ্টিতে তা দেখতে থাকে। জহির ওর মৌনতায় নিলুকে কিছু সময় দেয়। এরপর আবার বলে, ' ভাবছ নীরবতাই বদলে দেবে তোমার জীবন? বেশ, তবে নীরবই থাকো। তোমাকে জয় করা এক দুর্জেয় প্রচেষ্টা হবে আমার জন্য! হৃদয়ের স্বচ্ছতা আর অফুরন্ত ভালোবাসা... দেহকেন্দ্রিক ভালোবাসা নয়... তাই নিয়ে আমি অপেক্ষায় রইলাম তোমার জন্য। তোমার হৃদয়ের সকল কষ্টকে ব্লাড ক্যান্সারের রোগীর মতো দেহের সকল ব্লাড বের করে নতুন ব্লাড দেবার মতো করে সেগুলোকে দূর করার চেষ্টা করবো। আর তোমার মনের অদেখা সেই সব ঝিল্লিগুলোতে সে ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে... সেগুলোতে প্রলেপ দেবো নিঃস্বার্থ ভালোবাসা দিয়ে।'

সামনে তাকিয়ে থেকেই নিলু বলে, ' আমি এখন কষ্ট বা সুখ কোনোটাই অনুভব করিনা। আমি এখন আর কাঁদতেও পারিনা। জহির বলে, ' তবে তুমি কি পারো?'

জহিরের দিকে ফিরে নিলু বলে, ' আমি স্মৃতির তীরে বসে নুড়ি কুড়াই। কখনও সুখের, কখনও অপমানের... বেদনার!

'আজীবন কি একজন সুখ-দুঃখের নুড়ি কুড়ানেওয়ালিই থেকে যেতে চাও?' জহির জিজ্ঞেস করে।

নিলু হাসে... পুর্ণ এক নারীর অপুর্ণ হাসি। যা কান্নার মতো দেখায়। সে বলে, ' জানো জহির, ওর বাম হাতের তর্জনী টার নখে একটা কাঁটা দাগ ছিল। ছোট বেলায় দা নিয়ে খেলতে গিয়ে কেটে গেছিলো। খুব দুষ্ট আর দুরন্ত ছিল সে। এখন কোনো মানুষের সাথে পরিচয় হলে আমার চোখের দৃষ্টি আনমনেই মানুষটার হাতের পানে চলে যায়। তাঁর হাতের সাথে নতুন মানুষটার হাত মনে মনে পাশাপাশি রাখি। তুলনা করি, অন্যমনস্ক হয়ে। তারপর ঘর ভাঙ্গে... আবার মর্তে ফিরে আসি।'

জহির নিলুর একটা হাত নিজের হাতে নেয়। এই প্রথম। নিলু কেঁপে উঠে। নিলুর চোখে পুর্ণ দৃষ্টি মেলে জহির বলে, ' তোমার জন্য যে কষ্ট আমার বুকে বয়ে বেড়াচ্ছি ইদানিং, এগুলো মুক্তোর মতো... স্বচ্ছ... নির্লোভ আর কামহীন। এখনো তুমি একজন বন্ধুই আমার। জানোতো, বন্ধুর সীমানা অনেক বড়। সেখানে একজন প্রেমিকার অবস্থান খুবই ছোট। তুমি আমার প্রেমিকা হতে ভয় পাচ্ছ। বন্ধু হয়ে আমার সাথে আকাশ পাড়ি দিতে ভয় কিসের? এখন আর সেখান থেকে ধপ করে পড়ে যাবার ভয় নেই। এই বন্ধু তোমাকে না ছুঁয়েই তোমার পাশে পাশে হাত ধরে থাকবে... আগুনে ডানা পুড়বার ভয়ও আর নেই। এখন তোমার হাতে সব কিছু। আমি আছি ... তোমার সিদ্ধান্ত আমাকে জানিও।

... ... ... ...

বৃষ্টি আরো চেপে বসেছে। বারান্দার শিক ধরে দাঁড়িয়ে নিলু ভাবছে, কি বলবে সে জহিরকে? ঘরপোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখে যেমন ভয় পায়- নিলুও সম্পর্কের গভীরে যেতেও ভয় পাচ্ছে। সেকি ফিরে যাওয়া একজনের ডানাহীন নীল পরী হয়ে থাকবে? নাকি নিলু হয়ে বন্ধুর হাত বাড়িয়ে দেয়া মানুষটিকে নিয়ে শেষ একবার উড়বার চেষ্টা করবে?

বাইরে অশান্ত প্রকৃতি... নির্জন এক বাসা বাড়িতে শান্ত এক নারী হৃদয়ে পার ভাঙা অশান্ত ঢেউকে শান্ত করবার চেষ্টা করে যায়। একবারে পারবে না সে অবশ্য... তাই তাঁকে বারবার চেষ্টা করে যেতে হয়।।
(শেষ)

0 Shares

১৪টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ