922908_368180189970205_1213001184_nঘুমন্ত বাংলাদেশ,সময়ের চক্রাকারে ঘুমন্ত পৃথিবীর জীব জন্তু।গত হয়ে যাওয়া অন্যান্য রাতের ন্যায় আজ জোৎস্না ভরা চন্দ্রের আলো নেই,ঝিঝি পোকারাও লোকায়িত কোন নিরাপদ স্থানে,নেই শহরের আনাচে কানাচে লোকারন্যের কোলাহলের শব্দ দূষন,রাজ পথগুলোতে কেবল সুডিয়াম লাইটগুলো জনহীন ঠায় দাড়িয়ে।যদিও মাঝে মাঝে কিছু রিক্সাচালককে দেখা যাচ্ছে যাত্রী নিয়ে বিভিন্ন গন্তব্যের দিকে এগুচ্ছে।
তেমনি এক ভয়ার্ত পরিবেশে মা তার নিজ গৃহে সাত আট বছরের ছেলে এবং ছয় মাসের কন্যা শিশুটিকে নিয়ে ঘুমিয়ে ছিলেন।স্বামী ছিলেন অফিস ফেরা যাত্রী….ঘুমের এমন ভাব যে মা-ছেলে দু’জনেই নাক ডেকে ঘুমাচ্ছিলেন এর মধ্যে বুটের প্রচন্ড শব্দে বিল্ডিংটি কেপে উঠে,মা আচ করতে পারলেন বিল্ডিংটির নীচ তলায় কিছু ছাত্র ছিলো ভাড়াটে হয়তো ওদের উপর হামলা করেছে পাক পুলিশ।ছেলেটি ভয়ে চিৎকার দিতেই এক হাতে মা তার মুখটি চেপে ধরেন,কন্যা শিশুটির মুখটি অন্য হাত দিয়ে চেপে ধরেন যাতে ওদের চিৎকারের শব্দ বুঝতে না পারেন পাক বাহিনী।শিশুদ্বয়ের মা রাহেলা বানু কিছুক্ষণ পর বেশ কয়েকটি গুলির শব্দ শুনতে পেলেন,আবারো সন্তান দুটির মুখ চেপে ধরলেন।
আবারো বুটে শব্দ শুনা যাচ্ছে....নীচের ফ্লাটের কাজ শেষ করে ওরা এবার সিড়ি দিয়ে তলায় তলায় চেক করছে,,,আবারো গুলির শব্দ তাদের নীচ তলা হতে।ভয়ে ঘরে ঘাটের নীচে লুকিয়ে ছিলেন তারা।ওখান থেকেও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছিলেন তাই সে বুদ্ধি তার বুকের সামনে কন্যা শিশুটিকে পরিধেয় কাপড় দিয়ে পেচিয়ে নিজে লুকিয়ে পড়লেন বড় একটি কাঠের আলমারির ভিতর আর ছেলেটিকে রেখে আসলেন টয়লেটের ফলস্ ছাদের উপরে,ছেলেটি হ্যা না কোন শব্দই করলেন না মায়ের কথা মতো সে সেখানে চুপচাপ শুয়ে রইলেন।তার আগে রাহেলা বেগম বুদ্ধি করে ঘরের মেইন দরজা খুলে রাখলেন যাতে পাকিরা বুঝতে পারেন এই ঘরের লোক জন আগেই পালিয়েছেন।
দরজার সামনে এসে দরজাটি খোলা দেখে ওদের রাগ হয় ক্রিচের আঘাতে দরজাটিকে খন্ড দ্বিখন্ড করলেন এক পাকি।
-হারাম কা আওলাদ…..বাগগায়ে!
আকাশ পরিষ্কার যদিও সামন্য মেঘের গুড়মুড়ির শব্দ পাওয়া যায় তবুও “মন বলছে ভয় নেই,এখনই সময় শহরের ইটপাথর হতে দূরে থাকা “চলো এবার নিজের গ্রামে চলো”যেখানে মা বাবা পরিজনদের বসবাস,মরতে হলে ওদের সাথেই মরব…..মনটা খারাপ লাগছে স্বামী বেচার জন্য নিশ্চিৎ স্বামী তার ফিরে আসবেন তার খোজে…….এ কথা ভেবে সে সময় রাহেলাদের গ্রামে আর যাওয়া হলো না।
এক দিন গত হল সে আসেনি, ভাবনায় হৃদয় ভেঙ্গে খান খান তবুও অপেক্ষা বঙ্গ রমণীর স্বামী বলেতো কথা।সন্তান দুটোকে সাথে করে অপেক্ষা। ফ্লাটে পাকিদের হামলায় ধ্বংসস্তুপের এক কোনে,না খাবার-দাবার না জল কিছুই ছিল সেই ফ্লাটে।শিশুটিকে বুকের দুধে তৃষ্ণা মেটালেও সাত আট বছরের ছেলেটির ক্ষিদে কি দিয়ে মেটাবেন!খাবো খবো বলে ছেলেটি বার বার বায়না করছে মায়ের নিকট কিন্তু কোন উপায় খুজে পেলেন না তার মা অবশেষে পরিত্যাক্ত ডাষ্টবিনে পাকিদের ফেলে দেয়া ডেইট ফেইল একটি পাওরুটির প্যাকেট কুড়িয়ে নিলেন তা দিয়ে ছেলের ক্ষিদেকে আপাতত রক্ষা করলেন,পানি তৃষ্ণা মেটালেন বুকের দুগ্ধ দিয়ে।
12342653_1678107652436807_835162106527750697_nরাহেলা তত ক্ষনে বুঝতে পারলেন গত রাতটা ছিল ২৫শে মার্চ কালো রাত কেননা স্পষ্টই বুঝতে পরছেন খোলা আকাশে উড়ছে শত্রু শকুনের দল মাটিতেও আছে রাজাকার আলবদর।তার চোখের সামনে দিয়ে রাজ পথ দিয়ে গাড়ীতে ভ্যানে করে নিয়ে যাচ্ছে লাশ আর লাশ….বাতাসে ভেসে আসছে অগ্নিসংযোগকৃত জিনিসপত্রের তীব্র ঝাঝালো গন্ধ।মনে পড়ে যায় তার স্বামীর কথা
বেচারা হেই যে গেল অফিসে আর ফিরে এলো না।হতাশয় এক দীর্ঘশ্বাসে বুঝিয়ে দিল রঞ্জিত রাজ পথের লাল রংয়ের মাঝে বিয়োগ বা বিচ্ছেদের এক সুর তুলে গেলো।স্বামীর কথা আপাতত আর ভাবতে পারলেন না রাহেলা,জীবিত থাকলে নিশ্চয় এতো দিনে খোজ খবর নিতেন তার।
এমন একটি মুহুর্ত যে মুহুর্তে কারোর দিকে কারো তাকাবার সময় তখন কারোই ছিল না।ঢাকার পুরো আকাশটাই উড়ন্ত শকুনদের দখলে।রাহেলা স্বামীর অপেক্ষায় আর না থেকে সন্তান দুটোকে নিয়ে ছুটছেন গ্রামের দিকে।রাজপথ দিয়ে হাটছেন রাহেলা ট্রেন ষ্ট্যাসনের উদ্দ্যেশ্যে ঠিক সেই সময় মুক্তি কামী ছাত্র জনতার একটি মিছিল আসে…।রাহেলা একটু ভয়ার্ত থেমে আবার নিজেদের লোক ভেবে আবারও হাটা শুরু করলেন গন্তব্যের দিকে।কন্যা শিশুটিকে কোলে নিয়ে হাটতে হাটতে এক সময় লক্ষ্য করলেন তার সাত আট বছরের ছেলেটি কখন যে তার মুষ্ঠিবদ্ধ হাত হতে ফসকে কোথায় যে চলে গেলো তা আর টের পেলেন না।রাহেলা পাগলের মতো এ দিক সে দিক ডাকছেন কোথাও নেই।

ছেলেটি কোথায় আর যাবেন সে তো যুদ্ধ-সংগ্রাম বুঝেন না তবে মুক্তিকামী মানুষের দল বদ্ধ ভাবে সমুচ্চোরে জয় বাংলা শ্লোগানটি রেডিওতে শুনতে শুনতে তার মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল।তার সেই শ্লোগানের মোহে ছেলেটি মিছিলটির পিছু নেয়।এবং এক হাত উচু করে ভাঙ্গা ভাঙ্গা শব্দে বলতে থাকেন জ-য়ই বাংলা

সম্মুখের কয়েকজন যুবক তাকে কিছু না জিজ্ঞাসা করে তার সুরে তাল মিলিয়ে তাকে মিছিলের অগ্র ভাগে নিয়ে যান।রাজ পথের প্রতিটি মোড় হতেই লোক জড়ো হতে থাকে মিছিলটিতে এক সময় বিশাল এক মিছিলে পরিনত হয় ক্ষুদ্রাকার মিছিলটি।পাক সরকার চিন্তিত যে করে হোক মিছিলটিকে ভাঙ্গতে হবে নতুবা ক্ষণে ক্ষণে মিছিলটি আরো দীর্ঘ হতে থাকবে।
প্রথমে ওরা বেরিকেট দিয়ে রাস্তা বন্ধ করে দেয় প্রথম ব্যারিক্যাটের সামনে সবাই দাড়িয়ে জয় বাংলা শ্লোগান দিতে থাকেন কেউ ব্যারিকেট ভাঙ্গার চেষ্টা করছেন না,সেই পিচ্চি ছেলেটি শ্লোগানের সহিত হেটেই চলছেন।ব্যারিক্যাটেকে উপেক্ষা করে…এক সময় সে ব্যারিকেটের অপর প্রান্তে চলে গেলো তার এমন সাহসীকতা দেখে সংগ্রামী জনতা দলবদ্ধ ভাবে ব্যারিকেট ভেঙ্গে সামনে অগ্রসর হলেন।অথচ ছেলেটি এটাকে এক প্রকার আনন্দ ভেবে তা করেছিল।উৎ পেতে থাকা পাক বাহিনী গুলি ছুড়লেন ছেলেটির ডানে বামে উপর দিয়ে কিছু গুলি গিয়ে লাগল সংগ্রামী জনতার কারো বুকে কারো বা মাথায় মুহুর্তে রাজপথ রাঙ্গিয়ে দিল বেশ কয়েকটি তর তাজা লাশ…উৎসুক জনতার মতো ছেলেটি চেয়ে রইল,প্রায় গুলিগুলো গিয়েছিল তার কর্ণদ্বয়ের আশ পাশ দিয়ে লক্ষ্যের ভেদ হয়নি বলে সে যাত্রায় সে বেচে যায়।প্রবাহিত রক্তের স্রোত দেখে ভয়ে ছেলেটির মায়ের কথা মনে করে মা….মা বলে চিৎকার দেয় কয়েক বার চারদিক তাকিয়ে মাকে খোজ করতে করতে মিছিল থেকে সরে এলো ছেলেটি,সূর্য্যের তীব্র তাপে তার দেহ হতে ঘাম ঝরছিল,দু,তিন যাবৎ পরিবারহীন ছেলেটি প্রায় পাগলের মতো রাজপথের এ গলি সে গলি মা বোনকে খোজে চলছে এরই মাঝে কোথাও কোথাও মিলিটারীর বুটের শব্দ পেলে ভয়ে এক জায়গায় জড়োসড়ো হয়ে লুকিয়ে পড়তো।
লক্ষ্য করল,এক ভদ্রলোককে পাকিরা জামাকাপড় খুলে নেংটো করে ফেলে পরিক্ষা করছে সে হিন্দু নাকি মুসলমান।প্রচন্ড ক্ষিদে চোখ যায় চারদিক যদি কোথাও কিছু পাওয়া যায়।অবশেষে ডাষ্টবিনে কুকুরের সাথে একত্রে খাবার ভগা ভাগি করে খাচ্ছে ছেলেটি সেখানেও দ্বন্দ তবে মানুষের নয় কুকুরের কুকুরের,ভয়ে সেখান থেকেও চলে আসে সে।
রাহেলা মেয়েকে নিয়ে চিন্তিত মনে রেল স্টেসনের কাছাকাছি লুট হওয়া একটি ছোট ভাঙ্গা দোকান ঘরের ছায়ায় নিজের ক্লান্তকে দূর করার চেষ্টা করছেন এবং মোটামোটি পর্দাশীলতায় মেয়েটিকে বুকের দুধ খাওয়াচ্ছেন।জীবন আর যেন চলতে চায় না ক্লান্ত ভূভুক্ষ পেটে সঙ্গে থাকা সেই ডেইট ফেইল শেষ রুটিতে খেতে যাবেন ওমনিই ছেলের কথা মনে পড়ে গেল সে বেচে আছে কি মরে গেছে কে জানে।
কোথাও তেমন কেহ নেই রাহেলা তত ক্ষনে বুঝতে পারলেন গত দিনের রাতটা ছিল হয়তো ২৫শে মার্চ কালো রাত কেননা স্পষ্টই বুঝতে পরছিলেন…খোলা আকাশে উড়ছে শত্রু শকুনের দল মাটিতেও আছে রাজাকার আলবদর।তার চোখের সামনে দিয়ে রাজ পথ দিয়ে গাড়ীতে করে নিয়ে যাচ্ছে লাশ আর লাশ….মনে পড়ে যায় তার স্বামীর কথা….।
বেচারা হেই যে গেল অফিসে আর ফিরে এলেন না কেমন আছেন কোথায় আছে কে জানে আল্লাহ তুমি রহম করো,,,,হতাশার এক দীর্ঘশ্বাস,রক্তাক্ত লাল রংয়ের মাঝে স্বজন হারা বিয়োগের এক সুর তুলে গেলো।স্বামীর কথা আপাতত আর ভাবতে পারলেন না রাহেলা,জীবিত থাকলে নিশ্চয় এতো দিনে খোজ খবর নিতেন তার।
কিছু ভোর আসে সু-বাতাস বয়ে কিছুটা কু-বাতাসও বটে।কারো জীবনের গতি হয় মশৃন কারো বা একে বেকে ভোর দেখেই বুঝা যায় আজ দিনটি কেমন যাবে।রাহেলা মায়েদের ত্যাগেরে মর্যাদা ধরে রাখতে পারব কি না জানি না,তবে সে সময় রাহেলার চোখের সামনে সন্তান হারানোর বাস্তবতা বলে দেয় পাকিদের অত্যাচার কতটা ভয়ংকর ছিল।দলে দলে যখন লাশের ভ্যান গাড়ী রাজপথ দখল করে রেখেছিল ঠিক তখন তার চোখের সামনে পড়ে রাজ পথ দিয়ে যাওয়া পুত্র বহনের ভ্যান গাড়ীটি।সাহস শক্তি কিছুই ছিলনা তখন যে ছেলের লাশটিকে ধরে রাখবে তখনো সেই লাশ বহনে আশপাশে পাকিদের প্রচুর আনাগোনা।পুত্র হারা মা অসহায়ের মতো শুধু চেয়ে চেয়ে নয়ন জলে ভেজালেন।
...............................................যাবার বেলায় শিশু মুক্তিযোদ্ধা হয়তো একটি কথাই বলছিল “জয় বাংলা”

0 Shares

১৩টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ