জীবন চিতা-(পর্ব৪)

আবু জাকারিয়া ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৫, বৃহস্পতিবার, ১০:৫৬:০২পূর্বাহ্ন সাহিত্য ৪ মন্তব্য

পর্ব-৪

সন্ধ্যা হয়ে আসছে। পশ্চিম আকাশের সূর্যটা রক্তের মত লাল দেখাচ্ছে। গাছের আড়াল থেকে উকি মারছে সূর্যটা । বাতাশের তালে তালে একবার মুখ দেখাচ্ছে, একবার মুখ গাছের আড়ালে লুকাচ্ছে। জামিলা ছোট বেলায় সূর্যের আলো ছায়া নিয়ে খেলা করত। বিকেল বেলা যখন সূর্যিটা তলিয়ে যাবে, জামিলা উঠোনে এসে সূর্যের হালকা আলোয় দাড়াতো। ফলে অনেক বড় একটি ছায়া তৈরী হত তার। জামিলা হাত নাচালে, ছায়াটাও হাত নাচাতো। তখন জামিলার বেশ মজা লাগত। সেই খেলাটা সব শেষ কবে খেলেছে, তা তার মনে নেই।
জামিলার ভ্যান গাড়ি উঠনে এসে তার বাপের ঘরের সামনে থেমে গেল। ছাগল ছানাটা একটানা ভ্য ভ্য করে চলছে। কয়েকটা কৌতুহলী চোখ জালানা দিয়ে উকি মারল। হঠাৎ করে জামিলা এমনভাবে উপস্থিত হওয়ায়, অবিভুত হল তারা। জামিলার বৃদ্ধ্যা মা ঘরের ভীতর বসেছিল। ছাগলের ভ্য ভ্য শব্দ পেয়ে জালানা দিয়ে উকি মেরে জামিলাকে দেখতে পেল।
জামিলার একমাত্র বোন মরিয়াম বলল, মা জামিলা আপা এসেছে।
দৌড়ে ছুটে গেল জামিলার মা। জামিলার বোনও ছুটে আসল। জামিলার মা জামিলাকে জড়িয়ে ধরে বলল, কখন আসলি মা আমার, তোর চেহারার একি অবস্থা হয়েছে?
জামিলা মাকে জড়িয়ে ধরে কেদে ফেলল, আর থাকতে পারলাম না মা, ওরা আমাদের থাকতে দিল না।
জামিলার মা শান্তনা দিয়ে বলল, কাদিশনা মা, সব পরে শুনবো, এখন ঘরে চল। জামিলার মা আর জামিলার বোন মরিয়াম জামিলাকে ধরে ঘরে নিয়ে গেল। অনেকগুলো মানুষ উৎসুক দৃষ্টিতে জামিলাকে দেখছিল দুরে দাড়িয়ে, সাথে কতগুলো বাচ্চা ছেলেমেয়েও আছে । হয়ত কিছুই বুঝে উঠতে পারছেনা তারা।
জামিলারা দুই বোন, কোন ভাই নেই। জামিলা বয়সে বড় আর ছোট বোন মরিয়াম । মরিয়ামের ছোট ছোট দুইটা ছেলেমেয়ে। ছেলেটা বড়, নাম ইমরান, সানির সমবয়সী । মেয়েটা মনির থেকেও ছোট, নাম সাদিয়া।
মরিয়াম ছেলে মেয়ে আর স্বামীকে নিয়ে বাপের বাড়িতেই থাকছে। স্বামী ফলের ব্যাবসা করে গ্রাম থেকে দুরের একটা বাজারে। সেখানেই থাকে। প্রতি শুক্রবার বাড়ি আসে। আবার শনিবার সকালে চলে যায়। আজ রবিবার। তাই মরিয়ামের স্বামী বাড়িতে নেই।
ভ্যান গাড়িওয়ালা ভ্যান থেকে মাল জীনিস নামিয়ে ঘরে দিয়ে যাচ্ছে। ইমরান সাথে থেকে তাকে সাহায্য করছে। ছাগল ছানাটা আগেই একটা গাছের সাথে বেধে রাখা হয়েছে। সেখানে দাড়িয়েও এক টানা ভ্যা ভ্যা করে চলছে ছাগল ছানাটা। মাঝে মাঝে কালো লোমগুলো ঝাকিয়ে ধুলো ঝেড়ে নিচ্ছে। সানি উঠোনে দাড়িয়ে চারপাশ দেখছে অবাক হয়ে। মনি মুখে আংগুল পুরে দাড়িয়ে আছে।
জামিলার মা জামিলাকে নিয়ে ঘরে বসালো। একটা তাল পাখা দিয়ে বাতাশ করতে লাগল জামিলাকে। গরমে ঘেমে গেছে জামিলা, গালে -কপালে ফোটা ফোটা ঘাম ঝড়ে পরার অপেক্ষায় আছে। ঘামের ফোটাগুলোর মধ্যে দু'একফোটা চোখের পানি আছে কিনা বোঝা যাচ্ছেনা। কিন্তু ঝড়ে পড়ার আগেই ওগুলো তাল পাখার বাতাশে শুকিয়ে যাচ্ছে।
সব কিছু গুছিয়ে রেখে রাতে জামিলার মা এসে জামিলার পাশে বসল। জামিলা মন খারাপ করে বসে আছে। আর পাশে বসে আছে ছেলে দুইটা। জামিলার মা বলল, এবার বল কি হয়েছে?
জামিলা কোন কথা বলছে না। জামিলার মায়ের মনে মনে একটা ভয় কাজ করছিল, জামিলাকে তালাক দিয়ে দেয়নিতো মুহাম্মদ। অথবা নিজে তালাক নিয়ে আসেনিতো।
জামিলার মা আরো একটু নরম গলায় বলল, বল, কি হয়েছে? হঠাৎ এত বছর পর চলে আসলি কেন?
জামিলা আবার কেদে ফেলল, বলল, আমার ওখানে ভাল লাগেনা।
-কেন ভাল লাগেনা। জামিলার মা অবাক হয়ে বলল।
-ওরা আমাদের তাড়ানোর জন্য এক বছর ধরে জাদু টোনা করছে। আমাকে দুই দুইটা বান মেরেছে। আর কিছুদিন থাকলে ওরা আমাকে তাবিজ কবজ করে মেরেই ফেলত। আমি অসুস্থ হয়ে পরেছিলাম। রাত হলেই ঘরে ঢিল ছুড়ে মারে ওরা।
-কারা তোকে যাদু টোনা করত? কারা তোকে দুই দুইটা বান মেরেছে? জামিলার মায়ের অল্প ছানিপড়া চোখদুটো বিস্ময়ে জ্বল জ্বল করছে।
জামিলা মায়ের কথার উত্তর না দিয়ে বলল, শুধু তাই না, ওরা চিতার মরা পোড়ানোর ছাই দিয়ে, মরা মানুষের চুল দিয়ে জাদুটোনা করা শুরু করেদিয়েছিল।
জামিলার মা বলল, কারা, তা বলবিতো।
জামিলা বলল, জব্বারের লোকজন, জহিরুল ভাই যাদের কাছে জমি বিক্রি করে দিয়েছে।
জামিলার মা অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো, জহিরুল জমি বিক্রি করে দিয়েছে?
-হ্যা মা। জামিলা মাথা নেড়ে জবাব দিল।
-কবে বিক্রি করেছে?
-বছর খানেক আগে। জামিলার চোখ থেকে পানি ঝড়ছে।
-সম্পূর্ন বিক্রি করে দিয়েছে?
-হ্যা। জামিলা উওর দিল।
-তোদের কিছু অংশ দেয়ার কথা ছিল না?
-ছিল, কিন্তু না দিয়ে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। তাছাড়া তার নিজের কেনা জমি থেকে আমাদের ভাগ কেন দেবে? এত বছর থাকতে দিয়েছে এটাই বেশি।
-দিতে পারবেনা, তাহলে দেয়ার কথা বলেছিল কেন?
জামিলা কোন উত্তর দিল না। জামিলার মায়ের বুঝতে বাকি রইল না যে, জহিরুল নিজের দরকারে জামিলাদের নিজের কেনা জমিতে ঘর বানিয়ে থাকতে দিয়েছিল। দরকার টা হল জমিটা দেখাশুনা করা, দখলে রাখা। কিন্তু জহিরুল এত বছর ধরে মিথ্যা আশ্বাস না দিলেও পারত। যাই হোক, যা ঘটার তাই ঘটে গেছে, নিজের কামাই করা টাকায় জমি কিনে ভাইকে অযথা দিয়ে দাওয়া ঠিক নয়, জহিরুল হয়ত এতদিনে সেটা উপলব্ধি করতে পেরেছে। জামিলার মায়ের মাথায় এখন অনেক দুঃচিন্তা এসে জমা হল। যদিও এত দিন মোটামুটি দুঃচিন্তা মুক্ত ছিল। মেয়ের এমন বিপদে মায়ের দুঃচিন্তা হবে, এটাই স্বাভাবিক।
কিন্তু বেশি দুঃচিন্তা করলে ফলাফলটাও খারাপ হতে পারে।
জানিলার মা মাশ খানেক আগে হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। সবাই ধরাধরি করে ডাক্তার খানা নিয়ে গিয়েছিল কোন মতে। ডাক্তার পরীক্ষা নিরাক্ষা করে বলল, ব্লাড প্রেশার আছে। জামিলার মা জানত না যে, ব্লাড প্রেশার কি। পরে জানতে পেরেছিল, রক্তচাপকে ইংরেজিতে ব্লাড প্রেশার বলা হয়। জানিলার মা কোরয়ান হাদিশ সম্পর্কে অনেক কিছু যানে, কিন্তু ইংরেজী বিষয়ে একেবারেই অজ্ঞ। তার বাবা অর্থাৎ জামিলার নানা মনে করত, মুসলমানদের ইংরেজি শিখতে নেই, কারন ইংরেজি বিজাতীদের ভাষা। তাই ঘরে বসে বসে কোরান হাদিশ আর বাংলা পড়তে শিখেছিল জামিলার মা।
ডাক্তার কিছু ওশুধ পত্র দিয়েছিল ব্লাড প্রেশারের জন্য, সেই সাথে কিছু নিয়ম কানুনও মেনে চলতে বলেছিল। নিয়মের মধ্যে অতিরিক্ত দুঃচিন্তা করতেও নিষেধ করে দিয়েছিল ডাক্তার। বলেছিল, অতিরিক্ত দুঃচিন্তা করলে ব্লাড প্রেশার বেড়ে যেতে পারে।
আজ জামিলার এই অবস্থা দেখে দুঃচিন্তা হচ্ছে জামিলার মায়ের। কিন্তু ব্লাড প্রেশার বেড়েছে কিনা বুঝতে পারছেনা সে।
"মুহাম্মদ এখন কোথায় আছে?" জামিলার মা জামিলার চোখ দুটোর দিকে তাকিয় প্রশ্ন করল, যে চোখ দুটোর পানি ইতিমধ্যে শুকিয়ে গেছে। কিন্তু চোখের পানির যে ছাপ এখনও রয়েগেছে, সেটা স্পস্ট দেখতে পেল জামিলার মা।
"শহরে, কাজ করছে।" উত্তর দিল জামিলা।
জামিলার বাবা মারা গেছে অনেক আগে, মেয়ে দুটো ছোট রেখেই। সেই থেকে মেয়ে দুটো নিজেই অনেক কষ্টে মানুষ করেছে, কোরয়ান হাদিশ পড়তে শিখেছে, তারপর একটু বড় হলেই বিয়ে দেওয়ার জন্য উঠে পরে লেগেছিল জামিলার মা। তখন জামিলার বয়সছিল ১৭ বছর আর মরিয়ামের বয়স ১৫ বছরের একটু কম। দুটো মেয়েই তখন বিয়ের যোগ্য। জামিলার মা তখন পাত্র খুজতে শুরু করল। কিন্তু ভাল পাত্র পাওয়া এত সহজ ছিলনা। কারন সব কিছু জামিলার মায়ের একারই ভাবতে হত। সাহায্য করার মত অন্য কেউ ছিলনা তার। অবশেষে মনসুর ঘটক জামিলার জন্য একটা প্রস্তাব নিয়ে এলো। মনসুর ঘটক তখন প্রচুর পান চিবোতো। অবশ্য এখন কমিয়ে দিয়েছে।
পান চিবোতে চিবোতে মুনসুর ঘটক বলেছিল, খুব ভাল ছেলে, ৫ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে।
জামিলার মা তখন খুব আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইল, ছেলে কি করে?
মনসুর বক্তৃতার সুরে বলেছিল, ছেলে নদীতে মাছ ধরে। অনেক মাছ পায়। ওই এলাকার মধ্যে ওরাই সবচেয়ে বেশি মাছ পায়। মাছ বিক্রি করে টাকা আয় করে কাড়ি কাড়ি। জামিলা সেখানে রাজরানির মত থাকবে।
জামিলার মা জানত, ঘটকরা বানিয়ে বানিয়ে অনেক কথা বলে। তাদের কাজের সুবিদার্থে তিলকে তারা তাল বানায় আবার তালকেও তিল বানায়। যখন যেটা বলা দরকার, সেটা বলে। সত্য আর মিথ্যা মিশিয়ে বলে। এগুলো তাদের কাজের অংশ।
তারপরেও জামিলার মা রাজি হয়ে গেল। ছেলের নাম মুহাম্মাদ। রোদে পুরে নদীতে মাছ ধরে। তারপরেও টকটকে লাল চেহারা। নামাজের পবিত্র ছাপ লেগে আছে চোখেমুখে। জামিলাও ৫ ওয়াক্ত নামাজ পরে। সুন্দর চেহারা তার। মুহাম্মদের সাথে ভাল মানাবে। কপালের ডান পাশে একটা তিল আছে জামিলার। সেই তিলটা জামিলার চেহারার সৌন্দর্য আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। লোকে বলত, কপালের ডান পাশে তিল থাকা ভাল লক্ষন। ভনিষ্যতে শুখি হবে মেয়ে। জামিলার মা কখনই বিশ্বাস করতে চাইতোনা এসব কথা। এসব কথা বিশ্বাস করলে পাপ হয়, কোরয়ান হাদিশ পড়ে জেনেছে জামিলার মা। তাছাড়া কার ভাগ্যে কি লেখা আছে তা একমাত্র আল্লাহ ছাড়া কেউ বলতে পারেনা। খুব বেশি যাবাইবাচাই না করেই জামিলার বিয়েটা হয়ে গেল মুহাম্মদের সাথে। কারন, বেশি যাচাইবাচাই করতে গেলে ছেলে হাত ছাড়া হয়ে যেতে পারে। আর যাচাইবাচাই করার দরকার ছিল না, যে ছেলে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পরে সে আর যাই হোক, একেবারে খারাপ হতে পারেনা। আসলে সব দিক থেকেই ভাল, কিন্তু একটা দিকই খারাপ ছিল মুহাম্মাদের। সেটা হল মুহাম্মদের বাড়িটা। অল্প জায়গা নিয়ে কাঠ-গোলপাতার বাড়িটা ছিল একেবারে নদীর পাড়ে। যে কোন সময় ভেংগে নদীর পেটে চলে যেতে পারে। কয়েক বছর পর তাই ই ঘটল শেষ পর্যন্ত। বাড়িটা নদীর পেটে চলে গেল। মুহাম্মদ হয়ে পড়ল ভুমিহিন।
আজও জামিলার কপালের ডানপাশের সেই কালো তিলটা দেখা যায়। কিন্তু আগের মত উজ্জল মনে হচ্ছেনা। একেবারে ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে।
সকালে জামিলার বড় ছেলে সানি ছাগল ছানাটা নিয়ে ঘাস খাওয়াতে গেল। ছাগল ছানাটা ঘাসের মধ্যে বেধে রাখল। ঘাস খাচ্ছে ছাগল ছানাটা। পাশেই বড় একটা খাল। খালে একটা লোক নৌকায় চড়ে বড়সি ফেলে মাছ ধরছে। সানি খালের পাড়ে বসে বসে মাছ ধরার দৃশ্য দেখতে লাগল। অনেকক্ষন ধরে বসে আছে লোকটা, কিন্তু একটা মাছও ধরতে দেখেনি সানি। লোকটার নৌকায় একটা মাছের খাড়ই আছে। মাঝে মধ্যে খাড়ইটা কেপে ওঠে। হয়ত ওটার মধ্যে মাছ আছে। সানি এখানে আসার আগে ধরেছিল লোকটা। সানির খুব ইচ্ছা করছে একটা মাছ ধরার দৃশ্য দেখতে। কিন্তু লোকটা যখনই বড়শিতে টান মারে, তখনই ব্যার্থ হয়।
ছাগল ছানাটা যেখানে বাধা রয়েছে, তারপাশেই আছে একটা ছোট শবজী বাগান। টুকটাক শবজীও জন্মেছে সেখানে। সবজীর মালিক সবজীগুলোর যত্ন নিচ্ছে, পানি দিয়ে তাজা করার চেষ্টা করছে রোদে ক্লান্ত হয়ে যাওয়া শবজীগুলো। ছাগল ছানাটা হঠাৎ দড়ি থেকে ছুটে গেল। সবজী বাগানে ঢুকেই সবজী খেতে শুরু করল। মালিক প্রথমে তা খেয়াল করেনি। এদিকে সানি অপেক্ষায় আছে একটা মাছ ধরার দৃশ্য দেখবে বলে। হঠাৎ শবজী বাগানের মালিক চেচাতে লাগল, এই ছাগলটা কার, এই ছাগলটা কার, বলেই ছাগল ছানাটার পায়ে ঠাস করে বাড়ি মারল। ছাগল ছানাটা দৌড়ে পালিয়ে আসল সবজী বাগানের ভীতর থেকে। সানি ছাগল ছানাটি ধরে আবার ঘাসের মধ্যে বেধে রাখল। বাদনটা বেশ শক্ত হয়েছে। এবার ছাগলছানাটা ছুটে যেতে পারবে না।
সবজী বাগানের মালিক দাত মুখ খিচিয়ে বলল, উমাইন্না জুটছে যতসব!
সানি আবার মাছ ধরার দৃশ্য দেখায় মনযোগ দিল। হঠাৎ করেই একটা বড় মাছ তুলল লোকটা। হয়ত কাতল মাছ হবে, সানি মনে মনে ভাবল।
ঘাস খাওয়ানো শেষ হলে ছানি ছাগলটা নিয়ে বাড়ি ফিরল। সানির মা জামিলা বারান্দার চৌকাঠের উপর বসে উঠোন দেখছে। এতগুলো বছর কেটে গেছে তার মধ্যে বাড়ির চেহারায় কোন পরিবর্তন ঘটেনি। উঠোনটা ঘিরে জামিলাদের ঘর ছাড়াও আরো দুইটা ঘর আছে। ঘরগুলো মালিক যারা তারা জামিলার দুঃসম্পর্কের চাচা হয়। তাদের ঘরগুলোও আগের মত রয়েগেছে। জামিলা ৭ বছর আগে একবার বাপের বাড়ি বেড়াতে এসেছিল। ৭ বছর আগে যেমন দেখেছিল, এখনও তেমন আছে। জামিলার বড় ছেলে সানি মায়ের পাশে বসল।
সানি বলল, মা উমাইন্না কাকে বলে?
সানির মা কোন কথা বলল না। পৃথিবীর নানান বিষয় নিয়ে চিন্তা করছে সে।
সানি প্রশ্নটা আবার করল, মা উমাইন্না কাকে বলে?
সানির মা রেগে গিয়ে বলল, কানের ধারে বসে ফ্যাট ফ্যাট করবিনা। দুরে যা। সানি ছাগল ছানাটা নিয়ে ঘরের পেছনে বেধে রাখল।
জোহরের আজান দিয়েছে। জামিলা এক ভাবে বারান্দার চৌকাঠের উপর গালে হাত দিয়ে বসে আছে। জামিলার মা রান্না ঘর থেকে চেচিয়ে বলল, কি হল জামিলা, গোসল করবিনা? জামিলা কোন জবাব দিলোনা। কিছুক্ষন পর জামিলার মা জামিলার কাছে এসে নরম গলায় বলল, চিন্তা করিশনা জামিলা, আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে, তোর মাতো এখনও বাইচা আছে, নাকি?
জামিলা তারপরেও কোন কথা বলছেনা। এবার সে তাকালো দুরের নীল আকাশের দিকে। একটা চিল পাক মেরে বেড়াচ্ছে আকাশে। কোথাও হয়ত মুরগীর বাচ্চা দেখেছে ও। হয়ত একটু পরেই ছোবল মারতে নিচে নামবে।
জামিলার মা বলল, ঠিক মত নামাজ পড়, কোরান হাদিস পর। সব ঠিক হয়ে যাবে।
জামিলা কোন কথা না বলে পুকুরে গোসল করতে চলে গেল, সাথে নিয়ে গেল ছোট ছেলে মনিকে।
বিকেলে জামিলা আছরের নামাজ পড়ে কোরয়ান পড়তে বসল। প্রায় সন্ধ্যা হয়ে আসছে তারপরেও একভাবে ঘরে বসে কোরান পড়ছে জামিলা। জানিলার মা আর মরিয়াম রান্না ঘরে বসে রান্না করছে। জামিলার কোরান তেলয়াতের সুর ভেসে আসছে। জামিলার মা মরিয়ামকে পাঠিয়ে দিল জামিলাকে ডেকে আনার জন্য। কিন্তু জামিলা আসছেনা। রাত হয়ে গেছে, জানিলা তখনও কোরান পড়ছে। এবার জামিলার মা ডাকতে আসল জামিলাকে। জামিলা বলল, মা কোরান পড়তে খুব ভাল লাগে। অনেকদিন পড়া হয়না।
জামিলার মা বলল, আচ্ছা পরে আবার পড়িস। এখন আয়, আমার সাথে রান্না করবি।
জামিলা কোরয়ান শরীফ বন্দ করে রেখে মায়ের সাথে রান্না করতে আসল রান্না ঘরে। জামিলা আর জামিলার মা রান্না করছে। এমন সময় মরিয়াম আসলো কয়েকটা ডিম হাতে নিয়ে। বলল, বলতো আপা ডিমগুলো কোথায় পেয়েছি? পিঠে পিঠে বোন হওয়ায় মরিয়াম জামিলাকে তুই করে ডাকে।
জামিলা মাথা নাড়ল, জানিনাতো।
মরিয়াম বলল, চেষ্টা করে বলনা।
জামিলা আবার বলল, জানিনা, বললামতো।
মরিয়াম বলল,কিন্তু তোরই জানার কথা ছিল।
জামিলার মা মিট মিট করে হাসছে।
জামিলা বলল, কিনে এনেছিস হয়ত।
মরিয়াম বলল, আরে পারলিনা, তোর মুরগীর ডিম। কাল রাতে পেড়েছে।
জামিলা এবার হাসল, ও আমারতো একটুও মনেছিল না, যে আমি মুরগী নিয়ে এসেছিলাম।
বোনকে হাসাতে পেরে মরিয়ামের কিছুটা ভাল লাগছে। কারন, আসার পর জামিলার মুখটা ছিল পেচার মত। মুখে হাসি ছিলনা। কথাও বলেনি ঠিকমত। অথচ ছোট বেলায় দুই বোনের কত আনন্দে কেটেছে। সব সময় এক সাথে থেকেছে, একসাথে খেলেছে। আর আজ বোনকে কেমন অচেনা মনে হয় মরিয়ামের কাছে। ৭ বছর পর বোনকে দেখছে মরিয়াম, এর মধ্যে চেহারা অনেকটাই খারাপ হয়ে গেছে বোনের। আগে কপালে লাল টিপ ঠোটে লিপ ইস্টিক পরত। খুব সুন্দর লাগত তখন। এখন চেহারা কেমন ফ্যাকাসে হয়ে গেছে।
(চলবে.........)

0 Shares

৪টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ