জীবন চিতা-পর্ব(২খ)

আবু জাকারিয়া ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৫, মঙ্গলবার, ১০:৩৪:৪৮পূর্বাহ্ন সাহিত্য ৮ মন্তব্য

(২খ)

জামিলার চারপাশে মাটিতে দাগ কেটে একটা কুন্ডুলি আকল মুহিব। কুন্ডলীর ভীতর জামিলা বসে আছে। মুহিব পানি পড়ছে স্বচ্ছ কাচের গ্লাসে করে। পানি পড়া শেষ হলে পানি গায়ে ছিটিয়ে দিল জামিলার। তারপর বলল, আম্মা এখন চোখ বন্দ করে রাখেন।
জামিলা চোখ বন্দ করে কুন্ডলীর ভিতরে বসে থাকল। মুহিব দোয়া কালাম পড়তে লাগল। দোয়া কালাম পড়া শেষ হলে, কাচি দিয়ে মাটিতে রহস্যময় নকশা আকল মুহিব। আর তখনও আস্তে আস্তে দোয়া কালাম পড়ে চলছিল মুহিব। মুহিবের মুখে ছাগলের মত কয়টা দাড়ি আছে, দোয়া কালাম পড়ার সময় দাড়িগুলো কাঁপছিল।
মুহিব বলল, এবার চোখ খোলেন আম্মা। জামিলা আস্তে আস্তে চোখ খুলে তাকালো। মুহিব সুমাইয়ার দিকে তাকিয়ে বলল, বুঝলে সুমাইয়া বান একটা না, দুইটা। একটি বান মারা হয়েছে ওই পেপে গাছটার সাথে, আরেকটা দিঘির পাড়ের কলা গাছের সাথে। দুইটা বানই এখন কেটে গেছে।
মুহিব যে চোখ বন্দ করে পৃথিবীর অনেক অলৌকিক জিনিস দেখতে পারে, তার প্রমান আরো একবার পেল সুমাইয়া। মুহিব শাশুড়ি আর বউকে ডেকে নিয়ে দিঘির পাড়ে আসলো। রাতের বেলা দিঘির ওপারে মাঝে মধ্যে চিতার আগুন জ্বলতে দেখা যায়। দিঘির স্বচ্ছ পানি মৃদু ঢেউ খেলে চলছে।
মুহিন দিঘির পাড়ের কলাগাছটা হাতের ইশারায় দেখাল স্ত্রী সুমাইয়া ও শাশুড়ি জামিলাকে।
বান মারার কারনে কলাগাছটা মরে গেছে, ফুলো কলাগুলো হলুদ হয়ে গিয়েছে। পশুপাখিতেও কলাগুলো ছুয়ে দেখেনা। কোন গাছে বান মারা হলে হয়ত পশুপাখিরা বুঝতে পারে। তাই সেসব গাছের ফল খেতে আসেনা ওরা।
মুহিব বিজ্ঞ কবিরাজের মত বলল, শুধু বান মারেরি, রান্না ঘরের মেঝেতে ষোলটা তাবিজও পোতা হয়েছে। মুহিব সুমাইয়া আর জামিলাকে ঘরে ডেকে নিয়ে আসল। একটা সাবল দিয়ে রান্না ঘরের মেঝের এক কোনা খুড়তে লাগল। সবাই অবাক হয়ে দেখতে লাগল কি ঘটতে যাচ্ছে। মুহিব মাটি খুড়ে ১৬ টি তাবিজ বের করল। তাবিজগুলো একটা পলিথিনের কাগজে মোড়ানো অবস্থায় পাওয়া গেছে। সবার গা শিউরে উঠল তাবিজগুলো দেখে। আরেকটা পলিথিনের কাগজে পাওয়া গেল কতগুলো ছাই, মোড়ানো অবস্থায়। মুহিব ছাইগুলো জামিলাকে দেখিয়ে বলল, এগুলো কিশের ছাই বলেনতো আম্মা?
জামিলা মাথা নাড়ল, জানিনাতো
মুহিব ছাইগুলো বাইরে ছুড়ে মেরে ফেলে দিয়ে বলল, এগুলো চিতায় মানুষ পোড়ানোর ছাই। আপনাকে যাদু টোনা করা হয়েছিল।
সুমাইয়া আতংকের সুরে বলল, এখন কি হবে?
মুহিব বলল, এখন আর ভয় নেই, বাড়ি বন্ধক দিয়ে দেব, তারপর আর কেঊ কোন ক্ষতি করতে পারবে না।
জামিলা বলল, এখন এই তাবিজগুলো কি করতে হবে বাবা?
-তাবিজগুলো আগুনে পুড়িয়ে ফেলতে হবে।
-তুমি নিজে পোড়াবে, নাকি আমার পোড়াতে হবে?
-আপনাকেই পোড়াতে হবে সবগুলো তাবিজ, আমি পোড়ালে কাজ হবে না।
-আচ্ছা এখনই পুড়িয়ে ফেলব, নাকি পরে।
-এখনই পোড়াতে হবে, ঘরে মোমবাতি আছে?
-না কোন মোম বাতি নেই ঘরে। জামিলা বলল।
মুহিব সানিকে কাছে ডেকে কিছু টাকা দিয়ে বলল, তুমি দোকান থেকে একটা মোমবাতি কিনে আনো।
সানি দৌড়াতে দৌড়াতে দোকানে চলে গেল মোমবাতি কিনতে। কিছুক্ষন পর ফিরে এসে বলল, দুলাভাই, সবগুলো দোকান এখন বন্দ আছে। মোমবাতি কিনতে পারিনি।
মুহিব বুঝতে পারল, ভর দুপুরে গ্রামের দোকান স্বাধারনতো বন্ধ থাকে। আর একটু বেলা না পরলে খোলে না।
মুহিব বলল, ঠিক আছে, বিকেল বেলা আমি নিজেই কিনে আনবো দোকান থেকে।
সানি টাকাগুলো মুহিবের কাছে ফেরত দিল।
সুমাইয়া বলল, মোমবাতি ছাড়া অন্য কিছু দিয়ে পোড়ালে হবেনা।
মুহিব মাথা নেড়ে জবাব দিল, না। এর অনেক নিয়ম আছে সুমাইয়া, তুমি বুঝবা না।
বিকেল বেলা দোকান থেকে একটা মোমবাতি কিনে আনলো মুহিব। মোমবাতিটা জ্বালিয়ে রাখল ঘরের মেঝেতে, মাঝখানে। মোমবাতিটা ঘিরে মাটিতে আচর কেটে একটা বৃত্ত আকলো মুহিব।
তাবিজগুলো খুলে জামিলার হাতে দিল। বলল, এবার দম বন্দ করে তাবিজগুলো মোমবাতির আগুনে পুড়িয়ে ফেলুন আম্মা। বলে বিড় বিড় করে কি যেন পড়তে শুরু করল মুহিব। জামিলা দম বন্দ করে একটি একটি করে সবগুলো তাবিজ পুড়িয়ে ফেলল। মুহিব রান্না ঘরে গেল। কোথা থেকে যেন একগোছা চুল খুজে এনে জামিলাকে দিয়ে বলল, এগুলোও পুড়িয়ে ফেলেন আম্মা।
সুমাইয়া অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, এগুলো কিসের চুল?
মুহিব বলল, এই চুলগুলো মরা মহিলাদের। চিতায় পোড়ানোর আগে সংগ্রহ করা হয়েছিল তোমার মাকে যাদুটোনা করার জন্য।
জামিলা কোন দিকে না তাকিয়ে চুলগুলোও মোমের আগুনে পুড়িয়ে ফেলল। বিশ্রি একটা গন্ধ নাকে আসছে পোড়া চুল থেকে।
মুহিব বলল, এখন একটা কাজ বাকি আছে।
সুমাইয়া বলল, কি কাজ সেটা?
-বাড়ি বন্দক দেয়ার কাজ।
-কখন দিবে
-সন্ধ্যার পর
-সন্ধ্যার পর কেন?
-তুমি বোকা নাকি, দিনের বেলা কেউ দেখে ফেললে সমস্যা হতে পারে। কিছুটা বিরক্ত হয়ে বলল মুহিব।
সন্ধ্যার পরে বাড়ি বন্দক করে দিল মুহিব। বাড়ি বন্দক করলে বাড়ির ভিতর খারাপ কিছু ঢুকতে পারেনা। কেউ বাড়ির কাউকে জাদুটোনা করতে পারেনা।
রাত অনেক হয়ে গেছে। জামিলার আজ কোন আতংক নেই। কারন তার মেয়ে ও মেয়ের জামাই মুহিব ঘরে আছে। তা হয়ত জব্বার যেনে গিয়েছে। তাই আজ রাতে কেউ ঘরের চালে ঢিল ছুড়ে মারতে আসবে না।
জামিলার গোলপাতার ঘরে মোট দুইটা রুম আছে। আছে একটি বারান্দা ও ঘরের পেছনে বাশ ঝারের কাছাকাছি একটা রান্না ঘর। এক রুমে জামিলা তার দুই ছেলেকে সাথে নিয়ে ঘুমালো আর সুমাইয়া তার স্বামী মুহিবকে নিয়ে অপর রুমটা ঘুমালো।
গাঢ় অন্ধকার রাত। কোন সারা শব্দ নেই। আসলে জামিলাদের বাড়ির আসে পাশে অন্য কোন বাড়ি ঘর নেই যে সারা শব্দ পাওয়া যাবে। আর জামিলার ছেলে দুটোও ঘুমিয়ে যায় খুব তারাতারি। ওরা দুইজনই শান্ত প্রকৃতির। কথা কম বলে আর হৈ হুল্লোডতো করেইনা, একে বারেই করেনা। তাই বাড়িটা থেকে স্বাধারনতো কোন শব্দ পাওয়া যায় না। তবে বাতাশ বাড়লে বাশ ঝার থেকে অদ্ভুত শব্দ হতে থাকে। ঘরের চালে বাশ পাতার ঘষায় হিস হিস শব্দ আসে এবং বাশের সাথে বাশের ঘষা লাগার কারনে ক্যাত ক্যাত শব্দ পাওয়া যায় বাশ ঝার থেকে। তখন জামিলার খুব ভয় করে। বুক কাপতে থাকে ধর পর করে।
সুমাইয়া আর মুহিব কথা বলছে। জামিলার রুম থেকে শোনা যাচ্ছে সব কিছু
"আচ্ছা বান মারে কিভাবে?" সুমাইয়া মুহিবকে প্রশ্ন করল।
-তোমার জেনে কাজ নেই। এখন ঘুম পড়।
-আরে বলনা, মানুষ কিভাবে বান মারে?
-জ্বীন বেধে রাখে। মুহিব আস্তে আস্তে বলল।
-জ্বীন কিভাবে বেদে রাখে?
-খারাপ কালাম পরে জ্বীন আটকে রাখা যায়। যার নামে জ্বীন আটকে রাখা হয় সে দিন দিন পাগল হয়ে যায়। মাথা ঠিক থাকেনা তার।
-ও আচ্ছা, তাহলে মায়ের নামে পেপে গাছ আর কলা গাছের সাথে জ্বীন বেধে রাখা হয়েছিল।
-হ্যা।
-মায়ের কিছু হবেনাতো!
-কিছু হবেনা, আমি দুটো বানই কেটে দিয়েছি। এখন কোন সমস্যা হবে না।
-মা পেপে গাছের গোড়ায় পড়া পানি ঢালতে গিয়ে কি দেখেছিল।
-ওটা একটা বদ জ্বীন ছিল। ছাড়া পেয়েগেছে। এখন ও আর কোন ক্ষতি করতে আসবে না। আস্তে আস্তে করে বলল মুহিব। ঘুমে মুহিবের চোখ ধরে আসছে।

সকালে একটু বেলা হতেই মুহিব আর সুমাইয়া রওয়ানা হল। জামিলা আরো দু চারদিন থেকে যেতে বলেছিল ওদের। কিন্তু মুহিবের বাড়ি কাজ পরে আছে, মসজিদে নামাজ পড়াতে হবে। তাই ওরা থেকে যেতে পারল না। যদিও সুমাইয়ার ইচ্ছা ছিল তার বাবার সাথে দেখা করে যাওয়ার। কিন্তু তা আর হল না।
মুহিব আর সুমাইয়া ছোট ভাইদুটো ও মাকে বিদায় জানালো। সুমাইয়া ছোট ভাই মনিকে কোলে তুলে নিয়ে মাথায় হাত বোলাল। সানিকে ঠিক মত লেখাপড়া করতে বলল। তারপর চলে যেতে লাগল। বাশ ঝাড় থেকে তখনও শব্দ আসছিল, জামিলা স্পস্ট শুনতে পারছিল।(চলবে......)

0 Shares

৮টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ