জাপানে হানামি উৎসবে

নীলাঞ্জনা নীলা ১৩ ডিসেম্বর ২০১৮, বৃহস্পতিবার, ১০:১৬:১৮পূর্বাহ্ন অন্যান্য, একান্ত অনুভূতি ২২ মন্তব্য

সাকুরা...চেরী ফুল ফোঁটার উৎসব...

পৃথিবীর বেশ কয়েকটি দেশে থাকা হয়েছে, এবং ঘুরেছিও। তার মধ্যে সূর্যোদয়ের দেশ জাপান অন্যতম। আমার বর তরুণ জাপানের ইয়োকোহামার কিও ইউনিভার্সিটিতে পিএইচডি পড়ার সুযোগ পাওয়াতে আমি আর তীর্থ ২০০৩ সালের ডিসেম্বরে ওখানে যাই। প্রায় পাঁচ বছর জাপানে ছিলাম। সেই সূত্রে বহু জায়গা বেড়ানো হয়েছে এবং প্রচুর কিছু দেখেছিও। সত্যি বলতে কী জাপানের মতো আর কোথাও এতো ঘুরে, বেড়িয়ে ভালো লাগেনি।

চেরি ফুল...

জাপানের একটা বিশেষ উৎসব হলো "হানামি(ফুলের সৌন্দর্য উপভোগ করা)," চেরি ফুল ফোটার উৎসব। "হানা" অর্থ ফুল, আর "মি" অর্থ হচ্ছে দেখা। জাপানের জাতীয় ফুল হলো সাকুরা(চেরি গাছের ফুল)। ওই ফুল ফোটার মানেই হলো "বসন্ত এসে গেছে।" আর তখনই আবেগী মন নেচে ওঠে, "বসন্তে ফুল গাঁথলো আমার জয়ের মালা।" ফুলের উৎসবে নাম-না-জানা পাখী গান গেয়ে ওঠে, আর প্রেমিক মন "কান পেতে" থাকে তার ভালোবাসার পায়ের শব্দ শোনার জন্য, তার একটুকু ছোঁয়া"র জন্য। এক কথায় বলা যায়, আমাদের দেশের বসন্ত উৎসব, আর জাপানীদের সাকুরা উৎসব, অর্থাৎ "হানামি।" জাপানের মানুষেরা চেরি ফুলকে খুবই পবিত্র ভাবে। এদের যে কোনো ডেকোরেশনে চেরি ফুল থাকবেই। এমন কোনো রাস্তা নেই, এমন কোনো জায়গা নেই, যেখানে চেরি গাছের উপস্থিতি নেই।

শুভ্রতা...

মার্চের মাঝামাঝি থেকে সম্পূর্ণ এপ্রিল জুড়ে চেরি তার পাঁপড়ি মেলে রাখে। অবশ্য প্রতি বছরই আবহাওয়ার উপর নির্ভর করে হানামি উৎসবের তারিখ নির্ধারণ করা হয়ে থাকে। আমি প্রথম চেরি ফুলের এই উৎসব দেখি ২০০৪ সালের এপ্রিল মাসের কোনো এক রবিবারে টোকিওর Ueno পার্কে। চেরি ফুলের সৌন্দর্য অবলোকন করার সবচেয়ে জনপ্রিয় এই পার্ক। এতো বেশি লোক সমাগম হয়ে থাকে যে, চোখে না দেখলে নয়! সেই প্রথম চেরি ফুল দেখে এতোটাই মুগ্ধ হয়েছিলাম যে খেয়ালই করিনি আর কিছুই। আমার দুই বছরের ছেলেটার ছুটে এসে এই স্তব্ধতা ভেঙ্গে দিলো। তখন চেয়ে দেখি আমার চারপাশে প্রচুর মানুষ। প্রত্যেকেই মাদুর নিয়ে এসেছে, সাথে খাবার এবং পানীয়। ঠিক যেনো পিকনিক চলছে। আমরা প্রথমবার গিয়েছি, তাই অনেককিছুই জানা নেই। তীর্থ খুবই মজা পেলো। এদিক-ওদিক ছুটছে, পড়েও যাচ্ছে। কেউ কেউ গিটার নিয়ে এসেছে, গান গাইছে। একটা কথা না বললেই নয়, পরবর্তীতে শুনেছিলাম, ফুল দেখার সাথে পানীয়ও পান করতে হয়, তাতে নাকি সৌভাগ্যলক্ষ্মী সাথে থাকে। আমরা তিনজন তরুণ, আমি ও তীর্থ গিয়েছিলাম। ফুলের প্রচুর ছবি তোলা হলো।

আনন্দ...

চেরী ফুল নাকি তারাদের মেলা?...

তখন আমাদের ডিজিটাল ক্যামেরা ছিলোনা। পার্কের মাঠে মেলা বসেছে। খাবারের বিভিন্ন স্টল আছে, যে যার মতো খাবার কিনে খাচ্ছে। ভাবলাম আমরাও খাবো, কিন্তু আমি যেহেতু সুসি, সাসিমি খাইনা, তাই তরুণ আর তীর্থ খেলো। আমরা বিকেল থেকে রাত প্রায় আটটা পর্যন্ত ছিলাম। উফ সে যে কী অসাধারণ দৃশ্য! ফুল নয় যেনো একেকটি তারা জ্বলে আছে গাছে। স্বর্গের নাম শুনেছি, মনে হচ্ছিলো এটাই যেনো সেই স্বর্গীয় উদ্যান। কিন্তু ফিরে তো যেতেই হয়। কারণ পরেরদিন অনেক ভোরে তরুণকে যেতে হবে বিশ্ববিদ্যালয়ে, তাই চলে এলাম। আসার সময় মনে মনে বলতে বলতে এলাম, আবার আসবো।

মানুষের মেলা...

পৃথিবীতে প্রায় সাড়ে চার'শ জাতের চেরি ফুল আছে। তবে হাল্কা গোলাপি ও সাদা চেরি ফুলটাই বেশি জনপ্রিয় জাপানে। আমি মনে করেছিলাম চেরি ফুলের এই গাছ থেকেই বুঝি চেরি ফল হয়ে থাকে। আসলে কিন্তু তা নয়। চেরি ফলের গাছ আলাদা। এই সাকুরা বা চেরি ফুল গাছ জাপানের সর্বত্র দেখা যায়। এই গাছকে সকলেই পবিত্র বলে মনে করে। যাক সেসব কথা। তারপর ওই পাঁচটি বছরই হানামি উৎসবে সাকুরা/চেরি ফুলের সৌন্দর্য উপভোগ করেছি। সাথে খাবার নিয়ে গেছি। মাদুর বিছিয়ে খেয়েছি, খোলা আকাশের নীচে বসে গান গেয়েছি। শুয়ে শুয়ে আকাশও দেখেছি। আজও মিস করি চেরি ফুলের ওই উৎসবটাকে। তারপর কতো জায়গাতেই চেরী ফুল দেখেছি, কিন্তু জাপানের মতো আনন্দ কখনোই হয়নি। একদিন হয়তো আবার দেখা হবে, সেই অপেক্ষাতেই আছি।

ফিরে আসা...

হ্যামিল্টন, কানাডা
১২ ডিসেম্বর, ২০১৮ ইং।

:--  সেই ২০০৪ সালের বেড়ানোর গল্প অনেকটাই ভুলে গেছি। যতোটুকু মনে আছে ততোটুকুই লিখেছি। আসলে ছবিগুলো হঠাৎ পেয়ে যাওয়াতেই লিখতে পেরেছি। দেখতে দেখতে সোনেলায় ছয়টি বছর কাটিয়ে দিলাম। এটা আমার ৩০১ তম পোষ্ট। ভাবতেই কেমন লাগছে, সময় বুঝি এভাবেই যায়!

0 Shares

২২টি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

মাসের সেরা ব্লগার

লেখকের সর্বশেষ মন্তব্য

ফেইসবুকে সোনেলা ব্লগ